ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েলি বর্বরতা থেমে নেই। তারা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা অব্যাহত রেখেছে। সর্বশেষ অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিনে হামলা চালিয়ে তারা ১০ জনকে হত্যা করেছে। বসতি স্থাপনকারীরা সেনাদের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
জেনিন ক্যাম্পে তাদের অভিযানে আহত হয়েছেন অন্তত এক ডজন লোক। গুরুতর আহতদের হাসপাতালে সেবা নিতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যুদ্ধে বিধ্বস্ত গাজায় পুনরুদ্ধার অভিযান চলছে। গত রোববার অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ২০০টি বিকৃত মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।
এএফপি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পশ্চিম তীরে হামলার পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন জেনিনের গভর্নর কামাল আবু আল রুব। তিনি বলেন, দখলদার বাহিনী জেনিন ক্যাম্পের বাড়িঘর, স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তারা গুলি করছে ও বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। ‘পরিস্থিতি খুব কঠিন’ উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইসরায়েলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হার্জি হালেভি পদত্যাগ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা তাঁকে সারাজীবন পোড়াবে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীতে বহু বছরের সেবা ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নিযুক্ত জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত দাবি করেছেন, ধর্মীয় বিবেচনায় অধিকৃত পশ্চিম তীরের ওপর ইসরায়েলের অধিকার রয়েছে। তবে জাতিসংঘের আরেকজন বিশেষ দূত সতর্ক করে দিয়েছেন, ইসরায়েলকে থামতে বাধ্য করা না হলে গণহত্যা কেবল গাজার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
অন্যদিকে, গাজায় যুদ্ধবিরতি বহাল থাকার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতি ধরে রাখা এই অঞ্চলের নেতাদের সম্মিলিত দায়িত্ব।
গাজায় পুনরুদ্ধার অভিযানে ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্তত ১১ হাজার লাশ মিলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে কেবলই হাড়গোড় মিলছে। কারও মৃতদেহ শনাক্ত করার উপায় নেই। গাজার খান ইউনিসের অধিবাসী মুহাম্মদকে খুঁজছিলেন তাঁর বাবা। তিনি উদ্ধারকারীদের নাইলনের ব্যাগ, হাসপাতালের মর্গ সব জায়গায় খুঁজেও ছেলের সন্ধান পাননি। কাউকে চেনার উপায় নেই। মাথার খুলি, চেয়াল ও হাড়গোড় আলাদা হয়ে গেছে।
মুহাম্মদের বাবা খুঁজে ফিরছেন হলুদ প্লাস্টিকের এক জোড়া স্যান্ডেল বা কমলা রঙের সোয়েটার, একটি কালো জ্যাকেট কিংবা ট্র্যাকস্যুট প্যান্ট। এসব পরা অবস্থায় মুহাম্মদ নিহত হয়েছিলেন। হত্যাযজ্ঞ দেখে তিনি শোক ও ক্লান্তিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
এদিকে যুদ্ধবিরতির সুবাদে ফিলিস্তিনের রাফাহসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে এসেছে। ১৫ মাস ধরে অবিরাম গোলাবর্ষণের ফলে গাজার প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন। তবে ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজায় হামাসের শক্তিশালী উপস্থিতি এখনও রয়েছে। তারা উদ্ধার অভিযানের সময় সামরিক পোশাক পরে ও বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, গাজায় এখনও হামাসের শক্তিশালী অবস্থান স্থায়ী শান্তির পরিকল্পনাকে জটিল করে তুলছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধে এ পর্যন্ত অন্তত ৪৭ হাজার ১০৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১১ হাজার ১৪৭ জন আহত হয়েছেন।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ
১৮৮৬ সালের ১ মেÑএকটি দিন, একটি দাবি, আর হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে রক্তাক্ত দাগ কেটে দিয়েছিল যে মুহূর্ত, তা আজ বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তখনকার দাবিটি ছিল স্রেফ ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের দাবি শুধু সময়
নয়Ñমর্যাদা, সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রশ্নও।
এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে”Ñএ যেন সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বার্তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বরং তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য এক যৌথ দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশের শ্রমচিত্র ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে শ্রমনির্ভর খাত থেকে। কিন্তু যাঁরা এই অর্থনীতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছেন, সেই শ্রমিকরা কি পেয়েছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা?
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বহু শ্রমিক পান না ন্যূনতম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা ছুটি সংক্রান্ত মৌলিক সুবিধা। নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিলÑযত্রতত্র হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, কিংবা নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে না তোলার ফলে এই খাতেও স্থিতিশীলতা আসছে না।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: দ্বন্দ্ব নয়, দরকার সহমর্মিতা
এক সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই ছিল দ্বন্দ্ব, ধর্মঘট ও হুমকি। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছেÑসহযোগিতাই টেকসই উৎপাদনের চাবিকাঠি। মালিকপক্ষ যখন শ্রমিককে কেবল “ব্যয়” হিসেবে না দেখে “সম্পদ” হিসেবে বিবেচনা করেন, তখন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। একইভাবে শ্রমিকও যদি বুঝেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে তার কর্মস্থলের স্থায়িত্বÑতাহলে দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের
ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এই বিশ্বাস গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি স্তম্ভ:
নীতিগত স্বচ্ছতা Ñ ন্যায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা দায়িত্বশীল মালিকপক্ষ Ñ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে উদ্যোগ সচেতন শ্রমিকশ্রেণি Ñ অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের মানসিকতা
নীতি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত ২০১৮ সংস্করণ অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন কৃষি, গৃহপরিচারিকা, গিগ-ওয়ার্কার) শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনও প্রায় উপেক্ষিত।
এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা বীমা, এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়া জরুরি। সরকার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলেও তা অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে’ দেশ গড়ার বার্তাটি যেন শুধুই স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি হোক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও মানবিক বিবেচনার এক বাস্তব প্ল্যাটফর্ম।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও নতুন শ্রম বাস্তবতা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও গিগ-ইকোনমি অনেক চাকরি বিলুপ্ত করছে, আবার নতুন দক্ষতা চাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, তাহলে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পুনঃস্কিলিং এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে মালিক ও রাষ্ট্র উভয়ের উচিত হবে, শ্রমিককে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করা, কারণ দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকে না।
মে দিবস: উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার প্রতীক
মে দিবস কেবল লাল পতাকা হাতে শোভাযাত্রার দিন নয়, এটি আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিফলন। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে ভবন গড়ে, কৃষি জমি চষে, রপ্তানি পণ্য তৈরি করেÑতার জন্য আমাদের উচিত মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।
এবছর, আসুন আমরা সবাই রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকÑএকটি মানবিক, উৎপাদনশীল ও শীদারিত্বভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাই। শ্রমিকের হাতে গড়া এই বাংলাদেশ হোক তার জন্যই গর্বের জায়গা।
লেখক পরিচিতি:
মীযানুর রহমান
সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইলঃ ০১৭৫৪১০৯০৭২
যোগাযোগ: : [email protected]