মূল্যস্ফীতির পারদ খানিকটা নেমেছে। সরকারি হিসাবে নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে এক অঙ্কের ঘরে (৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ) নেমে এসেছে। চার মাস পর এই সূচক সিঙ্গেল ডিজিটে নামল।

গত বছরের জুন মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাইয়ে তা বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। আগস্টে তা কিছুটা কমে হয় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পরের মাস সেপ্টেম্বরে তা আরো কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়।

এরপর থেকে তা ১০ শতাংশের ওপরেই অবস্থান করছিল। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই সূচক ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে।  
তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) রয়েছে। জানুয়ারিতে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

ডিসেম্বরে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই জানুয়ারিতে সেই একই পণ্য বা সেবা পেতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছিল বাংলাদেশ। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।

নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বিবিএসের হিসাবে জানুয়ারি শেষে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার (২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি) ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

গ্রামে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি

সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নামলেও গ্রামে এই সূচক এখনও ১০ অঙ্কের ওপরে। জানুয়ারিতে শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি ছিল।

পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে নতুন বছরের প্রথম মাসে গ্রামীণ এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আগের মাস ডিসেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ; খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

অন্যদিকে, জানুয়ারিতে দেশের শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৯শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০দশমিক ৯৫ শতাংশ; খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ।

ডিসেম্বরে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ; খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।

মজুরি সূচক ৮.

১৬ শতাংশ

মানুষের আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি।

গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে বিবিএস।

মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে।

বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এরকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি মতো।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭ দশমিক শূন্য তিন শতাংশে ওঠে।

এভাবে প্রতি মাসেই অল্প অল্প করে বেড়ে অক্টোবরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে ৮ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ হয়। নভেম্বরে আরও কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ হয়। ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।

জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নামবে: অর্থ উপদেষ্টা

আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে বলে আশা করছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “বাড়তি মূল্যস্ফীতিতে মানুষ সমস্যায় রয়েছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে তা কমাতে ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি কমতে আরও ২ থেকে ৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে।

“জুনের মধ্যে যদি আমরা মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে আমরা এটিকে সন্তোষজনক বলে মনে করব।”

তিনি বলেন, ‘‘সরকার আসন্ন রোজায় নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি রাতারাতি কমানো যাবে না। এর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’’

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে জ্বালানি, সার, চাল এবং ভোজ্যতেল আমদানি সহজতর করার জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করা হবে।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম স্থিতিশীল করার জন্য ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে বলেও তিনি জানান।

ঢাকা/হাসান/এনএইচ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ল ৯ দশম ক ৮ দশম ক ব ব এস সরক র বছর র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ