ছন্দে থাকা বোলার এবাদত হোসেন দুর্ভাগ্যক্রমে চোটে পড়েছিলেন ২০২৩ সালে। ইংল্যান্ডে অস্ত্রোপচার করা, ১৫ মাস চোট পরিচর্যা, লড়াই করার মানসিকতায় ফেরার সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। জাতীয় লিগ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে ফিরেছেন। খেলেছেন এনসিএল টি২০ টুর্নামেন্টে, বিপিএলে পাঁচ ম্যাচ খেলেই জাতীয় দলে ফেরার অপেক্ষায় আছেন এবাদত। দেড় বছরের সংগ্রাম, নিজেকে ছন্দে ফিরে পাওয়া ও জাতীয় দলে ফেরার অপেক্ষা নিয়ে সেকান্দার আলীর কাছে মন খুলে কথা বলেছেন এবাদত হোসেন।
সমকাল : বিপিএলের লিগ পর্বে ৯ ম্যাচ বসে ছিলেন। ওই সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?
এবাদত : একজন খেলোয়াড় ম্যাচ খেলার জন্য সব সময় উন্মুখ থাকে। আমারও আকাঙ্ক্ষা ছিল। বিপিএলে খেলার জন্য সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। সব সময় চেয়েছি সুযোগ পেলেই নিজেকে মেলে ধরতে। এমনভাবে খেলতে চাইনি, যেন টিম ম্যানেজমেন্ট বলে– ‘তোমাকে সুযোগ দিলাম, অথচ প্রতিদান দিতে পারলে না।’ বরং আমি চেয়েছি এমনভাবে খেলব, যেন ম্যানেজমেন্ট আফসোস করে আরও আগে কেন সুযোগ দিলাম না। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত রেখেছি। সুযোগ পাওয়ার পর আমাকে কিন্তু আর বসে থাকতে হয়নি।
সমকাল : মিরপুরে খুলনার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলার সময় মনের ভেতরে কী কাজ করেছে?
এবাদত : বিপিএলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি। ১৭ মাস পর হাইভোল্টেজ টি২০ লিগে ম্যাচে খেলতে নামার পর একটু নার্ভাস ছিলাম। এক-দুটি বল যাওয়ার পর জড়তা কেটে গেছে। যেটা করতে চেয়েছি, সেটা হচ্ছিল। মুশফিক ভাই বলছিলেন, তুই যেভাবে বলছিস সেটাই করতে থাক। উইকেট পাওয়ার পর চাঙ্গা হয়ে উঠি। আগের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। প্রথম ম্যাচে ৪৫ রান দিয়ে একটি উইকেট পেয়েছি। ওই ম্যাচের পর ম্যানেজমেন্ট আমার ওপর আস্থা রেখেছে; প্লে-অফের কোয়ালিফায়ার ও ফাইনাল ম্যাচ খেলেছি।
সমকাল : জিমি নিশামের মতো অলরাউন্ডার থাকার পরও ফাইনালে খেলার সুযোগ পাওয়া কতটা সম্মানের?
এবাদত : আমি ও আলি পেস বোলার হিসেবে খেলছিলাম। মুশফিক ভাই বল হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোরা দুইজন ছন্দে আছিস। বোলিং ভালো হচ্ছে। ছন্দটা ধরে রাখ।’ মুশফিক ভাই বা তামিম ভাইয়ের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারদের কাছ থেকে ওই রকম কথা শোনার পর ভালো না করে থাকা যায় না। আমরা ভালো করাতেই শেষ চার ওভারে আমি, মায়ার্স ও আলি ৩১ রান দিয়েছি। স্লগে রান চেক দেওয়া সম্ভব না হলে চিটাগংয়ের রান দুইশ ছাড়িয়ে যেত। ওটা হতে না দেওয়ায় মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা ছিল।
সমকাল : চোট পরিচর্যা করার সময় মনোযোগ ধরে রাখা কতটা কঠিন ছিল?
এবাদত : অনেক কঠিন ছিল। কিছু করারও ছিল না। পেশাদার খেলাধুলায় আবেগের কোনো মূল্য নেই। আমি জানতাম, আমাকে পুরোপুরি ফিট হয়ে ম্যাচে ফিরতে হবে। জাতীয় লিগ দিয়ে শুরু করি। এনসিএল টি২০তে পাঁচ ম্যাচ খেলে ১০ উইকেট নিই। ওই টুর্নামেন্টে পারফরম্যান্স করায় বিপিএলে দল পেয়েছি। প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে কঠোর অধ্যবসায় দিয়ে। ধৈর্য, একাগ্রতা না থাকলে যে কোনো ইনজুরি থেকে ফেরা কঠিন।
সমকাল : ইনজুরির কারণে দুটি বিশ্বকাপ ও একটি এশিয়া কাপে ছিলেন না। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও মিস করবেন। এই টুর্নামেন্টগুলোতে দল আপনাকে কতটা মিস করেছে?
এবাদত : অনেক মিস করেছে। কারণ আমি পুরোনো বলের বোলার। বিশ্বকাপে পুরোনো বলে বল করার মতো কেউ ছিল না। এ কারণে কোচ, অধিনায়ক বারবার আমার কথা বলেছেন। একটি দলে সব ধরনের বোলার থাকলে অধিনায়ক পরিস্থিতি অনুযায়ী বোলার পরিবর্তন করতে পারেন। আমার চেষ্টা থাকে ব্রেক থ্রু দেওয়া। সেট জুটি ভেঙে দেওয়া। বিপিএলেও তাই করেছি।
সমকাল : বিপিএলে যখন ম্যাচ পাচ্ছিলেন না, আপনাকে প্রতিদিন জিমে দেখা যেত। নেটে বোলিং করতেন নিয়মিত। এগুলো কি রুটিন কাজ ছিল?
এবাদত : হ্যাঁ, রুটিন কাজ ছিল। ফিজিও নাথান যে রুটিন দিয়েছিলেন, সেটি অনুসরণ করেছিলাম। পেশির শক্তি বাড়াচ্ছিলাম। পুরো ছন্দে বোলিং করতে পেরেছি পুনর্বাসন ভালো হওয়াতে। সামনে আরও ভালো হবে। এক-দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলতে পারলে আরও নিখুঁত হবে বোলিং।
সমকাল : প্রধান কোচের সঙ্গে কথা হয়েছে? তারা আপনার বোলিং দেখে কী বলেছেন?
এবাদত : আমাদের অধিনায়ক শান্ত ভাই খুব প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, টেস্ট খেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পরই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ আছে। ইনশাআল্লাহ সেখানে খেলব। কোচও বলেছেন, ভালো হচ্ছে। ট্রেনার নাথান বলেছেন, ১৪২ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করতে পারছে মানে ফিট। যে কোনো সংস্করণে খেলতে পারবে।
সমকাল : চোট পরিচর্যার লম্বা সময়ে সবার কাছ থেকে কেমন সাপোর্ট পেয়েছেন?
এবাদত : বিসিবি আমাকে সর্বাত্মক সাপোর্ট দিয়েছে। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ, মেডিকেল বিভাগ সব সময় পাশে ছিল। জাতীয় দলের সঙ্গে ভারতে নিয়ে গেছে নেটে অনুশীলন করার জন্য। এই যে জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া, তা মেন্টাল গেম। একজন খেলোয়াড়ের জন্য যেটা বিরাট সাপোর্ট। কারণ আমি ভাবতে পেরেছি, আমাকে দল নিজেদের একজন মনে করছে। আমাকে তারা দলে চায়। এর বাইরে যেটা আছে, আমার ছোট ভাই খুব যত্ন নিয়েছে। প্রতিদিন নিয়ম করে পা ম্যাসাজ করে দিত। ওকে ধন্যবাদ।
সমকাল : টেস্ট দিয়ে শুরু করে তিন সংস্করণের নিয়মিত বোলার হয়ে উঠেছিলেন। পুরোনো জায়গা ফিরে পেতে কতটা সময় লাগতে পারে?
এবাদত : খুব বেশি সময় লাগার কথা না। ওয়ার্ক লোড ম্যানেজ করে, কঠোর পরিশ্রম করতে পারলে দ্রুত পুরোনো জায়গায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হতে পারে।
সমকাল : কোন সংস্করণ বেশি উপভোগ করেন?
এবাদত : টেস্ট। কারণ, যে টেস্টে ভালো করবে, সে বাকি দুই সংস্করণ অটো খেলতে পারবে। টেস্টের বোলিং নিখুঁত হতে হয়। বাজে বল পেলে ব্যাটার মেরে দেবে। এ কারণে বোলারদের টেস্ট খেলা উচিত। আমি তিন সংস্করণের বোলার হতে পেরেছি টেস্টে ভালো করার কারণে।
সমকাল : সামনে তো লাল বলের খেলা নেই, কীভাবে টেস্টের প্রস্তুতি নেবেন?
এবাদত : সামনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলব। লিগের খেলা খেলতে খেলতেই লাল বলে প্র্যাকটিস করব। প্রসেস অনুসরণ করতে পারলে কোনো সমস্যা হবে না।
সমকাল : শেষ প্রশ্ন, বিপিএলে ফিরেই চ্যাম্পিয়ন হলেন, কেমন লাগছে?
এবাদত : এটা দারুণ একটা ব্যাপার। আমাদের দলটি সেরা ছিল। জাতীয় দলের ক্রিকেটারে ঠাসা। সেখানে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া কঠিন। আমি জায়গা করে নিতে পেরেছি এবং ফাইনাল খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এটা দারুণ একটা ব্যাপার। ২০১৭ সালে রংপুরের হয়ে জিতেছি, এবার বরিশালের হয়ে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব প এল জ ত য় দল স স করণ বল ছ ন র জন য ট পর চ ব প এল সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)
আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।
১. এটাই জান্নাতের পথ
এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’
এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি
বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।
তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’
এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।
৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট
মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?
এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।
৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা
পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।
৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।
আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫৭. পালিয়ে যাওয়া
ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।
৮. সহনশীলতার খেলা
পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।
৯. অস্বস্তিকর আলাপ
মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।
১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা
পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা
গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
১২. নিয়তের পবিত্রতা
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)
যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।
১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা
পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন
একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)
এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা
চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’
এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’
১৬. মায়ের শক্তি
আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।
১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত
আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।
১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট
পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।
২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব
এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।
সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪