রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রের ভাষা ও গণতন্ত্র
Published: 11th, February 2025 GMT
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি উর্দুবিরোধী ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু ছিল কি সে ইংরেজিবিরোধী? হ্যাঁ, সেটাও হওয়ার কথা ছিল বৈ কি। কেননা, আন্দোলন ছিল– বাঙালি নিজের পায়ে দাঁড়াবে; বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে; যেখানে মানুষের পরিচয় ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা অর্থনৈতিক শ্রেণি দ্বারা চিহ্নিত হবে না। পরিচয় হবে ভাষার দ্বারা।
কিন্তু রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথে যায়নি। বাংলাদেশে অন্তত একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশাটা ছিল। বৃষ্টিহীন দুপুরের রংধনুর মতোই সে আশা মিলিয়ে গেছে। আশার স্মৃতিটা এখন পীড়া দেয় তাদের, যাদের হৃদয় আছে। বাংলাদেশে সাবেক পাকিস্তানের মতোই একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের মূল কথা যে অধিকার ও সুযোগের সাম্য; জনগণের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলোর কার্যকর স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে সর্বস্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা, তার কোনো কিছুই আজ বাংলাদেশে নেই।
এই রাষ্ট্র বস্তিবাসীকে উৎখাত করে; বলে, সন্দেহ হচ্ছে তোমরা খাঁটি সন্ত্রাসী। কিন্তু ব্যাংক লুট করা প্রকৃত ও খুনের মামলার আসামি যে সন্ত্রাসী, তাকে সে পাহারা দেয়। এই রাষ্ট্র হুঙ্কারের, ধমকের ও হুকুমের। এর ভাষা জনগণের ভাষা, অর্থাৎ বাংলা ভাষা হবে– এ সম্ভাবনা বহুভাবেই ক্ষীণ।
স্বাধীনতার পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা ইংরেজিবিরোধী ছিল না, বরং ইংরেজির দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। কেননা, ক্ষমতায় এসেছে মধ্যবিত্ত, যে-মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদকেই আদর্শ মনে করে এবং শ্রেণিগতভাবে যারা মোটেই উপনিবেশবাদের বিরোধী নয়। এরা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করে। কেননা, আমলাতন্ত্র এদের নিয়েই গঠিত। পুঁজিবাদে এদের সুবিধা। কারণ ওই পথেই ধনী হবার সম্ভাবনা। পরের নেতৃত্ব আগের নেতৃত্বকে ছাড়িয়ে গেছে এক ব্যাপারে। সেটা হলো পুঁজিবাদের জন্য পথ প্রশস্তকরণ। আর ওই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভাষা তো বাংলা নয়। তার ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। রয়েছে নির্ভরতা। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র মোটেই স্বাবলম্বী নয়, বরং তার পরনির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ঋণ-সাহায্য, এনজিও তৎপরতা; সবই রয়েছে পুরোদমে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের নির্দেশ অনুযায়ী। এদের ভাষা বাংলা নয়। বাঙালি এখন জীবিকান্বেষণ ও শিক্ষালাভের আশায় বিদেশে যেতে পারলে যত খুশি হয়, তত খুশি কম জিনিসেই হয়ে থাকে। এ জন্য তাকে ইংরেজি শিখতে হয়।
দেশের ভেতরে ধনী গৃহের সন্তানেরা ইংরেজির মাধ্যমেই পড়াশোনা করে। ঢাকা শহর এখন ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার চেয়ে কম যায় না ইংরেজি শিক্ষার উন্মাদনায়। দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে। এ শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই যে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাবে, তা নয়। অনেকেই দেশে থেকে যাবে এবং আমলাতন্ত্রের উচ্চতর স্তর, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন পেশা; আগামী রাজনীতিতেও এরা নেতৃত্ব দেবে। ওই নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনই ইংরেজি মিশ্রিত বাংলায় কথা বলে। ভবিষ্যতে মিশ্রণটা থাকবে না; ইংরেজিতেই কথা বলতে পছন্দ করবে এবং যারা পারবে না, তারা নিজেদের হীনম্মন্য ভাবা শুরু করবে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো অবশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে প্রধান ধারা। কিন্তু এই ধারা ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাকে জোরদার করা হচ্ছে, যেখানে বাংলা ভাষার চর্চা কম। এখানে যারা শিক্ষিত হচ্ছে, পরবর্তীকালে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তারা; রাষ্ট্রকে আরও দক্ষিণ দিকে ঠেলে দিতে চাইবে– এমন আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়। এমন মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করা আর গরিব মানুষকে আরও গরিব করার চেষ্টা যে রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং বলা যায়, এরা একই সূত্রে গ্রথিত।
মাদ্রাসায় যারা পড়ছে, পরবর্তী জীবনে জীবন সংগ্রাম তাদের জন্য কঠিন হবে। কেননা, তাদের শিক্ষার কোনো অর্থনৈতিক মূল্য তারা দেখতে পাবে না। ধর্মীয় কাজে আর ক’জনের কর্মসংস্থান হবে? শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে বৈষম্য, একে অস্বাভাবিক বলবার কোনো উপায় নেই। বরং বলতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ সমাজে বৈষম্য রয়েছে এবং রাষ্ট্র সেই বৈষম্যকে মহোৎসাহে বিকশিত করছে ও কায়মনোবাক্যে পাহারা দিচ্ছে। সেই বৈষম্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থাতে।
উচ্চতর শিক্ষায় বাংলা ভাষা চালু করা হবে বলে আশা করা হয়েছিল। সেই আশা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর কারণ ওই একই। যে-রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা নয়, সেই রাষ্ট্র উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রচলনের জন্য চেষ্টা করবে কেন?
বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি লোকের বাস। সারাবিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা বিপুল। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা কোনো অসম্ভব কাজ ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় উদ্দীপনা ও বিনিয়োগের; জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বই লেখার; বাইরের বিশ্বে যা লেখা হচ্ছে সেগুলো অনুবাদ করার। কাজটা প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে শুরুই হয়নি; যে জন্য এখন বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
সবচেয়ে বড় কথা অর্থনীতি। মধ্যবিত্তের একাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে; নিম্ন-মধ্যবিত্ত আরও নিচে নেমেছে; প্রান্তিক কৃষক পরিণত হয়েছে ভূমিহীনে; ভূমিহীন হয়ে পড়েছে ভিটাহীন। সবকিছুই ঘটেছে উন্নতির অন্তরালে। বস্তুত উন্নতির প্রচণ্ড চাপের কারণেই। এই যে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ, এদের জীবনে কোনো ভাষা নেই, নীরব ক্রন্দন ও আর্তনাদ ছাড়া। রাষ্ট্রভাষা থেকে এরা অনেক দূরে; রাষ্ট্রের ভাষা থেকে তো অবশ্যই। রাষ্ট্রের ভাষা এদের সন্ত্রস্ত রাখে এবং রাষ্ট্রভাষার চর্চা যে করবে, তেমন সুযোগ এরা পায় না।
রাষ্ট্রের আদর্শ পুঁজিবাদী, কিন্তু এই রাষ্ট্র আবার সামন্তবাদকেও উৎসাহিত করে, নিজের স্বার্থে। ধর্মকে নিয়ে আসে রাজনীতিতে। এর একটা কারণ, রাষ্ট্রের যারা শাসক তারা স্থূল অর্থে বস্তুতান্ত্রিক অবশ্যই, যা পায় তাই খায়। কিন্তু দার্শনিক অর্থে ইহজাগতিক নয়, পরকালের কথা ভাবে এবং ইহকালে যেসব সুখ-সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো পরকালেও পাবে, পেতেই থাকবে– এই আশাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অন্যদিকে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আবার ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান ও সান্ত্বনা সরবরাহ করা হয়। আজকের বাংলাদেশে বুর্জোয়া দলের কোনোটিই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করে না। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল; বিএনপি তাকে সরিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। হেফাজতের দাবি পূরণে শেখ হাসিনা ‘কওমি জননী’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন।
কী করতে হবে, আমরা জানি। রাষ্ট্রকে জনগণের সম্পত্তি ও অবলম্বনে পরিণত করতে হবে। অর্থাৎ তাকে গণতান্ত্রিক করার দরকার হবে, প্রকৃত অর্থে। সেটা যখন সম্ভব হবে তখন রাষ্ট্রের ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষার মধ্যকার ব্যবধান দূর হবে; বাংলা হবে রাষ্ট্রের ভাষা, সর্বস্তরে তা চালু থাকবে। এই ভাষাই সৃষ্টিশীল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ব যবস থ ত হয় ছ র জন য অবশ য আমল ত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এই সনদ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জারি করা হোক এবং প্রয়োজনে গণভোটের আয়োজন করা হোক। তবে এই গণভোট অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে, নির্বাচনের পরে নয়।’
আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তৃতীয় ধাপে তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রফিকুল ইসলাম খান। এ সময় উপস্থিত ছিলে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আবারও রাস্তায় নেমে আসবে বলে মন্তব্য করেন রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর সে সময়কার দলগুলোর ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় থাকা দলগুলো সেটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) যথাসময়ে বাস্তবায়ন করেনি। পরে আন্দোলনের মাধ্যমেই তা সংবিধানে যুক্ত হয়।
জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের মাধ্যমে। আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এ রায় দেওয়ানো হয়েছিল। তাই বিচার বিভাগকে আবার বিতর্কের মুখে না ফেলে সংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জামায়াত।
জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে চারটি বিকল্প নিয়ে কাজ করেছে, যার মধ্যে কমিশন সংবিধানিক আদেশের প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে। এই আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের ২২টি আর্টিকেল বাস্তবায়িত হতে পারে। এটি আইনিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি।
এক প্রশ্নের জবাবে হামিদুর রহমান বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করার এখতিয়ার সংসদের নেই, এবং এ ধরনের পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন হয়।
জামায়াতে ইসলামী জনগণের অভিপ্রায়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে জামায়াতের এ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন।
জুলাই সনদের যে আদর্শ ও চেতনা, তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত এবং যারা এই আদর্শের পথে হাঁটবে না, জনগণ তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন হামিদুর রহমান আযাদ। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ এটি প্রমাণ করে যে এ দেশের তরুণসমাজ ও জনগণ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায় এবং জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের পক্ষেই রয়েছে।