নওগাঁয় সমিতির লোভে পড়ে দিশাহারা ৫ হাজার গ্রাহক, ৬০০ কোটি আত্মসাৎ
Published: 14th, February 2025 GMT
নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে বসবাস করেন নিঃসন্তান জাহানারা বেগম (৬০)। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া পাঁচ শতক জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা পেয়েছিলেন। বেশি লাভের আশায় সেই টাকা একটি সমিতিতে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর টাকার লভ্যাংশ দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন। জাহানারার সেই টাকা নিয়ে পালিয়েছে সমিতি।
জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ মাসত থ্যাকে আর লাভের টাকা দ্যাছে না। মূল টাকাও দ্যাছে না। এখন তো অফিসই বন্ধ। অফিসের সবাই প্যালে গেছে। একটু ভালো থাকার আশায় সহায়সম্বল সব সমিতিত র্যাখে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ম্যানষের বাড়িত কাজ করে এখন কোনো রকম খ্যায়ে-পরে ব্যাঁচে আছি।’
জাহানারা বেগম লাভের আশায় নিজের শেষ সম্বল দুই লাখ টাকা ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সমিতিতে রেখেছিলেন। জাহানারার মতো নওগাঁ সদর ও আশপাশের এলাকার পাঁচ হাজারের বেশি গ্রাহকের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন।
প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থার চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানতের বিপরীতে গত দেড় দশকে এই টাকা তুলে নেয়। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা; আসল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন চালু করেছিলেন নাজিম উদ্দিন ওরফে তনু নামের এক ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটি চালুর আগে তিনি ঢাকায় এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছিলেন। নওগাঁ শহরের খাস-নওগাঁ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় করা হয়। এ ছাড়া শহরের সরিষাহাটির মোড়, বালুডাঙ্গা বাসস্টান্ডসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা এবং পাশের জয়পুরহাট, রাজশাহী ও বগুড়ায় প্রতিষ্ঠানটির মোট ৭৫টি কার্যালয় ছিল। গত ১২ নভেম্বর থেকে সব কার্যালয় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন ছাড়াই এত দিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন কোনো সমিতি বা বেসরকারি সংস্থা নয়। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সংস্থাটি কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছিল না। এরপরও বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের নামে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেন।
নওগাঁ শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার জাহিদুল ইসলাম ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। তখন তিনি ১৫ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা তিনি বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে মাসিক আমানত প্রকল্পে জমা রাখেন। প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ পাচ্ছিলেন। কিন্তু জুলাই মাস থেকে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ হয়।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আগে এলাকার অনেকেই বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে টাকা জমা রেখেছিলেন। তাঁদের কাছে জানতে পারি, সেখানে টাকা রাখলে লাখে ২ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়। এটা শুনে সরল বিশ্বাসে পেনশনের ১০ লাখ টাকা আমানত রাখি। শুরুতে লাভের টাকা নিয়মিত দিচ্ছিল। পরে গড়িমসি শুরু করে। এক মাস দিলে আরেক মাস দেয় না—এ রকম অবস্থা। জুলাই থেকে একেবারে বন্ধ করে দেয়। এখন টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তায় আছি।’
জাহিদুলের মতো টাকা উদ্ধার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন নওগাঁ পৌরসভার আরজি নওগাঁ এলাকার সাইফুল ইসলাম। বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা চার বছর ধরে জমা করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে। সাইফুল বলেন, ‘সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা জমা রাখছিলাম। চার বছরে ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করিছিলাম। চার বছরের লভ্যাংশে টাকা বেড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা হয়। এখন জমানো টাকা ফেরত ল্যাওয়ার জন্য থানা, ডিসি অফিস ও এসপি অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কোনো কাম হছে না।’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জুলাই থেকে গ্রাহকদের লভ্যাংশ ও মূলধনের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে পালাতে পারেন, এমন আশঙ্কায় কয়েকজন গ্রাহক সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষ ও গ্রাহকদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ারম্যান ৩০ নভেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর আগেই ১২ নভেম্বর নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন ও চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ পালিয়ে যান। এরপর থেকে অন্য কর্মকর্তারাও আত্মগোপনে। নির্বাহী পরিচালকের পালানোর খবর পেয়ে গ্রাহকেরা থানা ও আদালতে একাধিক মামলা করেন। এসব মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদসহ এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নওগাঁর পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, তাঁদের জমানো টাকার বিপরীতে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এমনকি মূলধনের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে গ্রাহক ও মালিকপক্ষের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মূল ক্রীড়নক নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন ধাপে ধাপে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতারণা করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি পালিয়ে যান। তাঁকে ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল বলেন, গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের আইনিভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রাহকেরা কীভাবে তাঁদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাবেন, সে বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা পেলে সেটি বাস্তবায়ন করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হকদ র ল ইসল ম গ র হক এল ক র র বছর
এছাড়াও পড়ুন:
সায়েমের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে পাকিস্তানের জয়ে শুরু
জয়ের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান। বাংলাদেশের বিপক্ষে ঢাকায় শেষ টি-টোয়েন্টি জয়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতেও জয় পেয়েছে তারা।
অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে পাকিস্তানের জয়ের নায়ক সায়েম আইয়ুব। তার ৩৮ বলে ৫৭ রানের ইনিংসে ভর করে পাকিস্তান লাডারহিলে ৬ উইকেটে ১৭৮ রান করে। জবাব দিতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ উইকেটে ১৬৪ রানের বেশি করতে পারেননি। দারুণ ব্যাটিংয়ের পর বোলিংয়ে সায়েম ২০ রানে ২ উইকেট নেন। ১৪ রানের জয়ে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে পাকিস্তান।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে পাকিস্তান শুরুতে শাহিবজাদা ফারহানের উইকেট হারায়। ১২ বলে ১৪ রান করে আউট হন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। তিনে নেমে ফখর সায়েমকে সঙ্গ দেন। দুজন ৮১ রানের জুটি গড়েন। এ সময়ে ফখর ২ চার ও ১ ছক্কায় ২৪ বলে ২৮ রান করেন। বাকি রান আসে সায়েমের ব্যাটে। এ সময়ে তিনি তুলে নেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি। হোল্ডারের বলে এলবিডব্লিউ হলে থেমে যায় তার ইনিংস।
এরপর হাসান নওয়াজের ১৮ বলে ২৪, সালমান আগার ১০ বলে ১১, ফাহিম আশরাফের ৯ বলে ১৫ রানে পাকিস্তান লড়াকু পুঁজি পায়। শেষ দিকে ১ বল খেলার সুযোগ পান হারিস। ছক্কায় উড়িয়ে পাকিস্তানের শেষটা ভালো করেন তিনি।
বোলিংয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সেরা ছিলেন শামার জোসেফ। ৩০ রানে নেন ৩ উইকেট।
লক্ষ্য তাড়ায় উদ্বোধনী জুটিতে ৭২ রান পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর হঠ্যাৎ ছন্দপতন। ৫ রান পেতেই ৩ উইকেট হারায় স্বাগতিকরা। ওই ধাক্কার পর তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। জনসন চার্লস ও জুয়েল অ্যান্ড্রু ৩৫ রানের দুটি ইনিংস খেলেন। শেই হোপ (২), গুদাকেশ মোটি (০), শেফরন রাদারফোর্ড (১১) ও রস্টন চেজ (৫) দ্রুত আউট হন। শেষ দিকে পরাজয়ের ব্যবধান কমান হোল্ডার ও জোসেফ। হোল্ডার ১২ বলে ৪ ছক্কায় ৩০ রান করেন। ১২ বলে ১ চার ও ২ ছক্কায় ২১ রান করেন জোসেফ ।
পাকিস্তানের বোলারদের মধ্যে সেরা ছিলেন হাসান নওয়াজ। ২৩ রানে ৩ উইকেট নেন বাঁহাতি স্পিনার। সায়েমের ২ উইকেট বাদে ১টি করে উইকেট পেয়েছেন শাহীন শাহ আফ্রিদি ও সুফিয়ান মুকিম।
আগামীকাল একই মাঠে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকা/ইয়াসিন