নওগাঁয় সমিতির লোভে পড়ে দিশাহারা ৫ হাজার গ্রাহক, ৬০০ কোটি আত্মসাৎ
Published: 14th, February 2025 GMT
নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে বসবাস করেন নিঃসন্তান জাহানারা বেগম (৬০)। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া পাঁচ শতক জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা পেয়েছিলেন। বেশি লাভের আশায় সেই টাকা একটি সমিতিতে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর টাকার লভ্যাংশ দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন। জাহানারার সেই টাকা নিয়ে পালিয়েছে সমিতি।
জাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ মাসত থ্যাকে আর লাভের টাকা দ্যাছে না। মূল টাকাও দ্যাছে না। এখন তো অফিসই বন্ধ। অফিসের সবাই প্যালে গেছে। একটু ভালো থাকার আশায় সহায়সম্বল সব সমিতিত র্যাখে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ম্যানষের বাড়িত কাজ করে এখন কোনো রকম খ্যায়ে-পরে ব্যাঁচে আছি।’
জাহানারা বেগম লাভের আশায় নিজের শেষ সম্বল দুই লাখ টাকা ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সমিতিতে রেখেছিলেন। জাহানারার মতো নওগাঁ সদর ও আশপাশের এলাকার পাঁচ হাজারের বেশি গ্রাহকের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন।
প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থার চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানতের বিপরীতে গত দেড় দশকে এই টাকা তুলে নেয়। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা; আসল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন চালু করেছিলেন নাজিম উদ্দিন ওরফে তনু নামের এক ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটি চালুর আগে তিনি ঢাকায় এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছিলেন। নওগাঁ শহরের খাস-নওগাঁ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় করা হয়। এ ছাড়া শহরের সরিষাহাটির মোড়, বালুডাঙ্গা বাসস্টান্ডসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা এবং পাশের জয়পুরহাট, রাজশাহী ও বগুড়ায় প্রতিষ্ঠানটির মোট ৭৫টি কার্যালয় ছিল। গত ১২ নভেম্বর থেকে সব কার্যালয় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন ছাড়াই এত দিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন কোনো সমিতি বা বেসরকারি সংস্থা নয়। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সংস্থাটি কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছিল না। এরপরও বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের নামে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেন।
নওগাঁ শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার জাহিদুল ইসলাম ২০২০ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। তখন তিনি ১৫ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা তিনি বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে মাসিক আমানত প্রকল্পে জমা রাখেন। প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা করে লভ্যাংশ পাচ্ছিলেন। কিন্তু জুলাই মাস থেকে লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ হয়।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আগে এলাকার অনেকেই বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে টাকা জমা রেখেছিলেন। তাঁদের কাছে জানতে পারি, সেখানে টাকা রাখলে লাখে ২ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়। এটা শুনে সরল বিশ্বাসে পেনশনের ১০ লাখ টাকা আমানত রাখি। শুরুতে লাভের টাকা নিয়মিত দিচ্ছিল। পরে গড়িমসি শুরু করে। এক মাস দিলে আরেক মাস দেয় না—এ রকম অবস্থা। জুলাই থেকে একেবারে বন্ধ করে দেয়। এখন টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তায় আছি।’
জাহিদুলের মতো টাকা উদ্ধার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন নওগাঁ পৌরসভার আরজি নওগাঁ এলাকার সাইফুল ইসলাম। বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা চার বছর ধরে জমা করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটিতে। সাইফুল বলেন, ‘সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা জমা রাখছিলাম। চার বছরে ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করিছিলাম। চার বছরের লভ্যাংশে টাকা বেড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা হয়। এখন জমানো টাকা ফেরত ল্যাওয়ার জন্য থানা, ডিসি অফিস ও এসপি অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কোনো কাম হছে না।’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জুলাই থেকে গ্রাহকদের লভ্যাংশ ও মূলধনের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে পালাতে পারেন, এমন আশঙ্কায় কয়েকজন গ্রাহক সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষ ও গ্রাহকদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ারম্যান ৩০ নভেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর আগেই ১২ নভেম্বর নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন ও চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ পালিয়ে যান। এরপর থেকে অন্য কর্মকর্তারাও আত্মগোপনে। নির্বাহী পরিচালকের পালানোর খবর পেয়ে গ্রাহকেরা থানা ও আদালতে একাধিক মামলা করেন। এসব মামলায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদসহ এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নওগাঁর পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল, তাঁদের জমানো টাকার বিপরীতে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এমনকি মূলধনের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে গ্রাহক ও মালিকপক্ষের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মূল ক্রীড়নক নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন ধাপে ধাপে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতারণা করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি পালিয়ে যান। তাঁকে ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল বলেন, গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের আইনিভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রাহকেরা কীভাবে তাঁদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাবেন, সে বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা পেলে সেটি বাস্তবায়ন করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হকদ র ল ইসল ম গ র হক এল ক র র বছর
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।