রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচাবাজারের সামনের সড়ক। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সেখানে যায় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) একটি পণ্যবোঝাই ট্রাক। আগে থেকেই সেখানে চার শতাধিক লোক লাইনে দাঁড়ানো। সবাই এসেছেন ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে। অথচ ওই ট্রাকে ছিল মাত্র ২০০ জনের পণ্য।

ক্রেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় মুহূর্তেই সেখানে শুরু হয় হট্টগোল। এ অবস্থায় পণ্য বিক্রি শুরু হলে লাইনে দাঁড়ানো বিক্ষুব্ধ কিছু লোক ট্রাকচালক ও এক সহকারীকে মারধর করেন। পরে সেখানে থেকে চলে যায় ট্রাকটি।

টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাক ঘিরে এমন হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত সোমবার থেকে পুনরায় পণ্য বিক্রি শুরুর পর চার দিনে অন্তত আটটি স্থানে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া পণ্য কিনতে আসা মানুষ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়েছেন মারামারি–ধাক্কাধাক্কিতে।

টিসিবির একাধিক ডিলার (সরবরাহকারী) ও কর্মকর্তা জানান, গতকাল রাজধানীর ৫০টি স্থানে পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবি। এর মধ্যে মিরপুর ৬, কালশী, যাত্রাবাড়ী ও রামপুরায় মারধরের শিকার হয়েছেন ট্রাকের কর্মীরা। এর মধ্যে কালশীতে এক ট্রাকচালককে মেরে রক্তাক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে।

টিসিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিটি ট্রাকে বরাদ্দ করা পণ্যের চেয়ে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে বিশৃঙ্খলা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক স্থানে ডিলার ও তাঁর সহকারীরা মারধরের শিকার হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন।

মারামারি–ধাক্কাধাক্কি নিয়মিত ঘটনা

টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল (সয়াবিন বা কুঁড়ার তেল), দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা ও ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারেন। প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০ টাকা, চিনি ৭০ টাকা, ছোলা ৬০ টাকা ও ৫০০ গ্রাম খেজুর ৭৮ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিদ্যমান বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় ৪০০ টাকা কমে এসব পণ্য কিনতে পারেন ক্রেতারা। তাই টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইন পড়ে।

গত তিন দিনে ঢাকার আটটি স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। সরেজমিনে দেখা যায়, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা টিসিবির ট্রাকের খোঁজে প্রতিদিন ভোর থেকে বিভিন্ন স্থানে জড়ো হন। আবার অনেকে ভাগ হয়ে ট্রাক খোঁজেন; কেউ ট্রাকের দেখা পেলে অন্যদের ফোন করে জানান।

টিসিবির ট্রাক আসার আগপর্যন্ত মোটামুটি সুশৃঙ্খলভাবেই লাইনে দাঁড়ান ভোক্তারা। ট্রাক এলেই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা ও ধাক্কাধাক্কি। ধাক্কাধাক্কির কারণে গত কয়েক দিনে কয়েকটি স্থানে বেশ কয়েকজন ক্রেতা আহতও হয়েছেন। আবার পণ্য নিতে এসে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত তিন দিনে এ রকম পাঁচটি ঘটনার কথা জানা গেছে।

আওতা বেড়েছে, বরাদ্দ কমেছে

এদিকে সারা দেশে টিসিবির এক কোটি পরিবার কার্ডের মধ্যে ৪৩ লাখ কার্ড সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে। এর পরিবর্তে ধাপে ধাপে স্মার্ট পরিবার কার্ড বিতরণ করছে সংস্থাটি। পরিবার কার্ডের সংখ্যা কমানোয় ট্রাকে পণ্য বিক্রির আওতা বাড়ানোর চিন্তা করছে টিসিবি।

সংস্থাটি বর্তমানে ঢাকা শহরের ৫০টি ও চট্টগ্রামের ২০টি স্থানে পণ্য বিক্রি করছে। এখন আটটি বিভাগীয় শহর ও কয়েকটি জনবহুল জেলা সদরে এই কার্যক্রম বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছে টিসিবি। সরকারের অনুমোদন পেলে আগামী সপ্তাহ থেকে এ কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে সংস্থাটির শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা জানান।

পণ্য বিক্রির আওতা বাড়ালেও ট্রাকপ্রতি পণ্যের বরাদ্দ কমিয়েছে টিসিবি। এত দিন টিসিবির একটি ট্রাকে ২৫০ জনের পণ্য বিক্রি করা হতো। তবে তিন দিন ধরে প্রতিটি ট্রাকে ২০০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আগে ঢাকায় ৫০ ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে পারতেন সাড়ে ১২ হাজার মানুষ। এখন সেটি কমে ১০ হাজারে নেমেছে। অর্থাৎ শুধু ঢাকাতেই আড়াই হাজার মানুষের বরাদ্দ কমিয়েছে টিসিবি। একইভাবে চট্টগ্রামেও বরাদ্দ কমেছে এক হাজার মানুষের।

বরাদ্দ কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের আরও কয়েকটি বিভাগীয় শহরে টিসিবির এই কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে ট্রাকপ্রতি বরাদ্দ কিছুটা কমানো হয়েছে।

ক্রেতারা বলছেন, এমনিতেই টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে না পেরে প্রতিদিন অনেক মানুষ খালি হাতে ফিরছেন। বরাদ্দ কমে যাওয়ায় এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। গত বুধবার বিকেল সোয়া তিনটায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে টিসিবির ট্রাকের পণ্য বিক্রি শেষ হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত অন্তত ৫৫ জন মানুষ পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরে যান। তাঁদের একজন লাইলি বেগম। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে না পেরে একপর্যায়ে বয়স্ক এই নারী কান্না শুরু করেন। এ সময় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সকাল সাতটায় খালি পেটে লাইনে দাঁড়িয়েছি। তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও পণ্য পাইনি। উল্টো ধাক্কাধাক্কিতে পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়েছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট স ব র এক বর দ দ ক ম রধর

এছাড়াও পড়ুন:

গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন নামঞ্জুর

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।

গতকাল বৃহস্পতিবার সাত শিশুর জামিন আবেদনের শুনানি হয়। গোপালগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) সৈয়দ আরাফাত হোসেন তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে সোম ও মঙ্গলবার পাঁচ শিশুর জামিন আবেদন করা হয়। তাদের জামিন নামঞ্জুর করা হয়। ওই পাঁচজনের জামিন আবেদন করা হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

কারাগার সূত্র জানায়, গত ১৬ জুলাই সংঘর্ষের পর ১৭ ও ১৮ জুলাই জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৮ শিশুকে আটক করে পুলিশ। ১৮ জুলাই তাদের আদালতে হাজির করে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২১ জুলাই তাদের যশোরের পুলেরহাট শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

আদালতের নথি অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বয়স, ঠিকানা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই। তবে গতকাল পর্যন্ত ১২ শিশুর নাম ও পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। অভিভাবকদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই আটক করা হয়েছে।

আরও পড়ুনগ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ২৭ জুলাই ২০২৫

একজন শিশুর বাবা বলেন, ‘সংসারে অভাব–অনটন, নিজেরাই সংসার চালাইতে পারি না। আমার কষ্ট দেখে ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়। সে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রমজান শেখ নামের একটা রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। কাজের সময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’

আরেক শিশুর ভ্যানচালক বাবা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, কোথাও কোনো কাইজের মধ্যে নেই। তিনডা ছেলে, বড়টা একটা মাদ্রাসার শিক্ষক। ছোট দুইডা এখনো পড়ে। যারে ধরছে, সে সবার ছোট। ওই দিন সকালে আমার মাদ্রাসায় গেছে, পরীক্ষা ছিল। পরে দুপুরের আগে আমি নিজে যাইয়ে নিয়ে আসছি। সেদিন বাড়িতেই ছিল। পরের দিনও সারা দিন বাড়ি ছিল, সেদিন তো কারফিউ ছিল। আসরের নামাজের পর আমার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে গেছে চটপটি খাইতে। পাশে মাদ্রাসার সামনেই চটপটির দোকান বসে। সেই হান দে ওরে ধইরে নিছে।’

ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ধরার ঘণ্টাখানেক পর থানা থেইকা ফোন দিছে, কয় ছেলে ধরা হইছে। আমরা থানায় গিয়া অনেক কইছি, ও তো কোথাও যায় না, কোনো গ্যাঞ্জামের ছেলে না। মাদ্রাসায় পড়ে। কিন্তু কেউ কিছুই শুনল না। ছেলেরে ছাড়ায় আনতে অনেক জায়গায় দৌড়াইছি।’ তিনি জানান, এ ঘটনার পর থেকে তাঁদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

এ ছাড়া জামিনের আশ্বাস দিয়ে কয়েকজন লোক তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক।

আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় আরও একটি মামলা, আসামি ৪৭৭ জন৩১ জুলাই ২০২৫

গ্রেপ্তার এক শিশুর আইনজীবী ফিরোজা বেগম বলেন, ১৬ জুলাই সহিংসতার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় এই শিশুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় দ্রুত তদন্ত করে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলি তৌফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুরা অল্প সময় আগে গ্রেপ্তার হয়েছে, এখনো তদন্ত চলছে। তাই হয়তো বিচারক জামিন নামঞ্জুর করেছেন। এ মামলায় এখনো কারও জামিন হয়নি।

আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে সংঘাতের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন ১৮ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ