আট দিনে সারা দেশে ৪৪০১ জন গ্রেপ্তার
Published: 15th, February 2025 GMT
যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’ নতুন করে আরও ৪৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত আট দিনে সারা দেশে এই অভিযানে মোট ৪ হাজার ৪০১ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী। গত ২৪ ঘণ্টায় (গত শুক্রবার বিকেল থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত) এই অভিযানের সময় ৪৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা ছাড়াও বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১টি বিদেশি পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ২০টি গুলি ও কয়েকটি দেশি অস্ত্র।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্টের বাইরে বিভিন্ন মামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে এক সভায় ‘অপারেশন ডেভিল হান্টের’ সিদ্ধান্ত হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে আক্রমণের শিকার হন ১৫-১৬ জন শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীরা ওই রাতে ডাকাতির খবর পেয়ে তা প্রতিহত করতে সেখানে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের ওপর আক্রমণ করা হয়। এ ঘটনায় আহত একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
গাজীপুরসহ তিন স্থানে গ্রেপ্তার ৩৮
গাজীপুরে বিশেষ অভিযানে আরও নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে মহানগর থেকে দুজন এবং জেলা থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত শুক্রবার রাতে অভিযান চালিয়ে তাঁদের আটক করে পুলিশ।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার চৌধুরী মো.
কুড়িগ্রামে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ১৬ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চর রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আছমত আলী, রৌমারী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি সাইদুর রহমান, রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বসুনিয়াও আছেন।
সিলেটে বিশেষ অভিযানে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার বিভিন্ন সময়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি বিমানবন্দর থানার সুবিদবাজার বনকলাপাড়া এলাকার মো. জসিম উদ্দিন তালুকদার (৪৬) রয়েছেন।
জনপ্রতিনিধি ও আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার
কুষ্টিয়ায় অপারেশন ডেভিল হান্টে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া নুরুল ইসলাম (৫০) মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সহদপ্তর সম্পাদক।
ফরিদপুরের সালথায় যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে মো. সেলিম মাতুব্বর (৪৮) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। শুক্রবার দিবাগত রাতে মাঝারদিয়া বাজার এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার পুলিশ সামিনুর রহমান (৫৫) নামে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় উপজেলা সদর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সামিনুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের আগের কমিটির সদস্য ছিলেন।
চাঁদপুরের শাহরাস্তি পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসান মঞ্জুরুল ইসলামকে (৪৫) ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর ছ আওয় ম গতক ল উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’