কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসক ও নার্স থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর নিয়োগ আটকে আছে। এমনকি হাসপাতালে রোগীদের রোগনির্ণয়ে কেনা প্রয়োজনীয় ছোট-বড় ও ভারী যন্ত্রপাতিও হাসপাতাল বুঝে পায়নি। ফলে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে সেবার কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়ে আছে।

গত বছরের ১০ জুলাই ও চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এই হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপে চালুর দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধ করেন কলেজটির শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গরূপে চালু না হওয়ায় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, রোগীসহ সাধারণ মানুষের ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে। এ নিয়ে একপর্যায়ে হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ারুল কবীর শিক্ষার্থীদের কাছে লিখিত দিয়ে জানান, ২০ দিনের মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিশু ও মেডিসিন বিভাগ চালু করবেন।

১১ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের পরিচালক আনোয়ারুল কবীরের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই ২০ দিনের মধ্যে দুটি বিভাগে রোগী ভর্তি করে সেবা দেওয়া সম্ভব কি না, জবাবে তিনি বললেন, ‘গড নৌজ।’

মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে (কুষ্টিয়া শহরে ম্যাটস ক্যাম্পাস) কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় ২০২২ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। সেখানে ছয়তলা একাডেমিক ভবন, চারতলা করে দুটি হোস্টেল, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য তিন ও দুই তলাবিশিষ্ট ডরমিটরি, মসজিদ স্থানান্তর করা হয়। তবে মেডিকেল কলেজের হাসপাতাল চালু না হওয়ায় ক্যাম্পাস থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লিনিক্যাল ক্লাস করেন। শিক্ষার্থীরা দুটি ভাড়া বাসে যাতায়াত করেন। সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী আছেন।

গণপূর্ত কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৭৫ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর মৌজায় ২০ একর জমিতে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে ৫৩টি প্যাকেজে ৫২ জন ঠিকাদার কাজটি করতে থাকেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হয়নি। তখন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত নানা জটিলতায় কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৮ সালে প্রথম দফায় কাজের মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬১১ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়েও কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদারেরা। দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এবার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮২ কোটি টাকা, যা প্রথমে ধরা ব্যয় থেকে ৪০৭ কোটি টাকা বেশি। ওই মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় তৃতীয়বারের মতো ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ হয়।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৭ তলা ভবনে ৫০০ শয্যার পাশাপাশি ৮৮টি কেবিন, ২৩ শয্যার সিসিইউ, ২০ শয্যার আইসিইউ সেবা আছে। এ ছাড়া জরুরি সেবা দিতে আলাদা আরও ১৩০ শয্যার ব্যবস্থা আছে। এদিকে হাসপাতালের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুনে অন্তত ৯০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনা হয়, যা বর্তমানে হাসপাতালের ভবনের ভেতরে পড়ে আছে। এসব যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিন, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন এবং অস্ত্রোপচার কক্ষে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। অভিযোগ আছে, এই যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে। এ নিয়ে দুদক কেনাকাটার কাগজপত্র নিয়ে তদন্ত করছে।

২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর হাসপাতাল ভবনের একটি অংশে আংশিক বহির্বিভাগ চালু হয়। কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের নির্দেশে এটি চালু করা হয়। তবে বর্তমানে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, সেটা অবৈধভাবে কোনো অনুমোদন ছাড়াই করা হয়েছিল। এই বহির্বিভাগ সেবা এখনো চলমান। তবে হাসপাতালে রোগী ভর্তি, এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয় না।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রায় ৩ মাস আগে হাসপাতালে রোগী ভর্তিসহ যাবতীয় কাজে প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। হাসপাতালে ৬৩ জন চিকিৎসক, ২৪ জন নার্স ও ৩ জন ওয়ার্ড বয় আছেন। বেডও প্রস্তুত। কিন্তু জরুরি সেবা দেওয়ার জন্য কোনো জনবল নেই। এমনকি ৪১৪ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল (পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, লিফটম্যানসহ) নিয়োগ আজও হয়নি। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে ২০ বারের বেশি চিঠি দিয়েও কোনো সদুত্তর পায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের উপপরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ৫০ জন জনবল পেলেও আপাতত দুটি ওয়ার্ড চালু করা সম্ভব। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চাহিদার ৯৮ কোটি টাকার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা। হাসপাতালে ২৩টি বিভাগ। শিশু ওয়ার্ড চালাতেই ৮ থেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

যন্ত্রপাতি নিয়ে ঠেলাঠেলি

হাসপাতালে তড়িঘড়ি করে কেনা প্রায় ৯০ কোটি দামের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝে নেয়নি, যা হাসপাতালের কয়েকটি বিভাগে ও ভান্ডারকক্ষ পড়ে আছে। এ ব্যাপারে পরিচালক আনোয়ারুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা কিনেছেন এবং কেনাকাটা ও রিসিভ করা কাজে কমিটিতে দায়িত্ব ছিলেন তাঁরা কেউ এ ব্যাপারে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক বলেন, ভারী ও দামি যন্ত্রপাতির মধ্যে কয়েকটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। বেশির ভাগই প্যাকেটবন্দী হয়ে পড়ে আছে। এসব যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যন্ত্রপাতি নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছে। কেউ বুঝে নিচ্ছে না, আবার কেউ বুঝিয়ে দিচ্ছে না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ড ক ল কল জ র শ চ ক ৎসক প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া

দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে, হবে শোনাও যাচ্ছে। তবে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার। যেমন ডেপুটি গভর্নরদের যোগ্যতা, কাজের পরিধি, জবাবদিহি ইত্যাদি।

অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের মুখ্য কাজ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলের পদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া। সেটি ক্যাশ অফিসার, অফিসার ও সিনিয়র অফিসার—যে পদেরই ভাইভা হোক, সে ভাইভা বোর্ডে তাঁদের থাকা চাই–ই চাই। ডেপুটি গভর্নরের নিচের পদের কারও সভাপতিত্বে ভাইভাগুলো নিতে চাইলে তাঁরা বিরাগভাজন হন।

সকাল-বিকেল প্রতি বেলা ভাইভার জন্য একটা সম্মানী থাকে। সেটির সুবিধাভোগী তাঁরা হন। এ ছাড়া ভাইভায় নম্বর দেওয়া, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও কেউ কেউ প্রভাব খাটান বলে অভিযোগ শোনা যায়।

বিশ্বের আর একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখান, যাঁদের দ্বিতীয় প্রধান নির্বাহী বছরের বেশির ভাগ দিনের একটা বড় অংশ ভাইভা নিয়ে কাটান, তা–ও এন্ট্রি লেভেলের পদের। এ মুহূর্তে ২০২২ সালভিত্তিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারসহ আরও কিছু পদের ভাইভা চলছে। চলবে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে এবং বেলা ৩টা থেকে দুই বেলা করে। প্রতি বেলায় চলবে অন্তত ৩–৪ ঘণ্টা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় সারা বছর এমন কোনো না কোনো পদের ভাইভা চলতেই থাকে। কখনো একসঙ্গে দুই–তিনটা–ও চলে। প্রতিটি ভাইভা বোর্ড হয় ডেপুটি গভর্নরের সভাপতিত্বে। একাধিক ভাইভা চলমান থাকলে তাঁরা বন্ধের দিন, অফিস সময়ের আগে ও পরে এমনকি রাত পর্যন্তও ভাইভা নেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকে দৈনন্দিন রুটিন কাজের অংশ হিসেবে এমন অনেক কিছু বিভাগীয় প্রধান (পরিচালক) এমনকি নির্বাহী পরিচালকের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে, যা শুধু ডেপুটি গভর্নর অনুমোদন করতে পারেন। আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি তো আছেই, সামান্য একটা সভার নাশতা, প্রিন্টার কেনা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদোন্নতি, বদলি সবকিছুই তাঁদের অধীনে। কিন্তু তাঁরা ব্যস্ত থাকেন ভাইভা নিয়ে।

শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, এ সময়কালে দেশের অর্থনীতির জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেস, ফাইলও দিনের পর দিন তাঁদের টেবিলে পড়ে থাকে; কারণ, তাঁরা ভাইভায় ব্যস্ত। এ কারণে আজকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ, হাই প্রোফাইল বিষয়াদি সন্ধ্যার পর পাস হবে, এটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। সারা দিন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোতে অনেক কাজ আটকে থাকে। সন্ধ্যার পর শুরু হয় ছোটাছুটি।

নিয়োগের ক্ষেত্রে ভাইভা বোর্ডে ডেপুটি গভর্নরদের এই একচ্ছত্র প্রভাবের অবসান হোক।

তাসনিম ফারিহা ব্যাংকার; মিরপুর, ঢাকা

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঝগড়া থেকে দেয়ালে মাথা ঠোকা, সালমান-ঐশ্বরিয়ার সম্পর্কের বিষয়ে প্রকাশ্যে আনলেন প্রতিবেশী
  • জনবল নিয়োগ দিচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পদ ৪৩০
  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকা
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া
  • হাতে ভোট গণনাসহ ছাত্রদলের ৬ দাবি, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত
  • ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে আবেদন আজ বিকেলে, ক্লাস ১৩ নভেম্বর
  • যে হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ, বিদ্যুৎ–সংযোগ কিছুই নেই
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন