ছয় কমিশনের প্রতিবেদন এবং ঐকমত্যের প্রশ্ন
Published: 21st, February 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক করেছে। বস্তুত ছয়টির মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একে কেন্দ্র করে এবং এর সঙ্গে সংগতি রেখেই বাকি সব রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, সরকারের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
শুরুতেই উল্লেখ করা দরকার, এ রিপোর্টের মূল বিষয়গুলোর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকার প্রস্তাবিত খসড়া জুলাই ঘোষণার সাদৃশ্য রয়েছে। জুলাই ঘোষণার ভুল, অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতা সংক্রান্ত পয়েন্টগুলো আমরা ইতোমধ্যে লিখিত আকারে তুলে ধরেছি।
এটা বিস্ময়কর যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্ম এবং ছাত্র আন্দোলনই এই গণঅভ্যুত্থানের উৎস। অথচ দেশের কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ের উল্লেখ এ প্রতিবেদনে নেই।
এ প্রতিবেদন দাবি করছে, ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা এ.
কমিশনের সুপারিশগুলোর সারসংক্ষেপের ৭ নম্বর পয়েন্টে ‘মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ’-এর কথা বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৫)। অথচ তার দুই পৃষ্ঠা পরে (পৃষ্ঠা ৭) ঠিক উল্টো কাজটি করা হয়েছে। সেখানে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত আলোচনার ২ নম্বরে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানকে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার ৫ নম্বর পয়েন্টে সম্পদের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানের মতোই এখানেও অত্যাবশকীয় মৌলিক অধিকারগুলোকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়নি এবং আইন দ্বারা বলবৎ করা হয়নি।
প্রতিবেদনের তৃতীয় অধ্যায়ে সুপারিশের যৌক্তিকতা সম্পর্কিত অংশে রাষ্ট্রের মূলনীতি সংক্রান্ত বিধানের অন্তর্ভুক্তির আলোচনায় কমিশন প্রস্তাব করেছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিতে। যে ধারণাগুলো কমিশন বাদ দিল এবং যেগুলো অন্তর্ভুক্ত করল, তার যুক্তিগুলো পরিষ্কার নয়।
বাহাত্তরের সংবিধানে যেভাবে জাতীয়তাবাদের ধারণা দেওয়া হয়েছে, তা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ ও আলোচনার দাবি রাখে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনাটা পড়লেই বোঝা যায়, তা খুবই একপেশে। কমিশন মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সুপারিশ করছে। এ কথা এখন সর্বজনবিদিত, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের নামে বাইরের বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এবং দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় শ্রমজীবী মানুষকে নির্মমভাবে শোষণ করে নিঃস্ব করে দেয়। এ কথা ভুলে যাওয়া যাবে না যে, পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এই মুক্তবাজার অর্থনীতিকেই কার্যকর করেছিলেন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে জুলাই হত্যাকাণ্ডের কথা বলা আছে। কিন্তু গণআন্দোলনের ওপর নৃশংস দমনপীড়ন বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই দেখা গেছে। কমিশন রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে শুরু হওয়া এ সমস্যা সম্পর্কে কোনো পর্যবেক্ষণ রাখেনি। প্রশ্ন হলো, যে বাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে, ন্যায় ও সত্যকে তুলে ধরবে এবং অন্যায় প্রতিরোধ করবে, তাদের এই অধঃপতন হলো কেন? এর কারণ কি শুধু পতিত স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার? আমরা মনে করি, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো যত বৃদ্ধি পাবে, সরকার সেগুলোকে সমাধান করার সক্রিয় চেষ্টা যতদিন না করবে, বারবার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। একের পর এক ক্ষমতাসীন সরকার পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী দিয়ে সেই বিক্ষোভ দমন করবে। এভাবে ব্যবহৃত হতে হতে পুলিশ বাহিনীর চূড়ান্ত অধঃপতন ঘটে, যা আমরা জুলাই অভ্যুত্থানে দেখেছি। মনে রাখা দরকার, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের শাসনের মধ্যেই বিভিন্ন ন্যায়সংগত আন্দোলনের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে। গুলি করে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের হত্যাও করেছে। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি হলো, ন্যায়সংগত গণআন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ বন্ধের সুপারিশ কমিশনের প্রস্তাবে থাকা উচিত।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য, বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে বহু কথা থাকলেও এই প্রতিবেদন অনুসন্ধান করতে পারেনি– কেন এ রকম হলো। বাস্তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় জোর করে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা স্বাভাবিক। সমগ্র বিষয়টির কার্যকারণ অনুসন্ধান না করে একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ করার সদিচ্ছা কমিশনের থাকতেই পারে; কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না।
প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে হলে শুধু বড় দলগুলো নয়, ছোট এবং নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক শর্ত করা অনুচিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার সম্পন্ন এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। প্রতিটি সংস্কার প্রস্তাবই আলোচিত হওয়া উচিত। কিন্তু সংস্কার প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে প্রতফিলিত দৃষ্টিভঙ্গিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজের রূপরেখা।
মাসুদ রানা: সমন্বয়ক, বাসদ (মার্ক্সবাদী)
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র র ঐকমত য ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ঐকমত্য কমিশন হাজির করেছে অনৈক্যের দলিল: বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন
ঐকমত্য কমিশনের কাজ ঐকমত্য তৈরি করা হলেও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে অনৈক্যের দলিল হাজির করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন।
জহির উদ্দিন বলেছেন, ‘যতটুকু ঐক্য নিশ্চিত করা যায়, ততটুকুই ঐকমত্য কমিশনের কাজ। বাকিটা ঐক্যের চেষ্টার জন্য রেখে দিতে হবে।…কিন্তু তা না করে যখন এ রকমভাবে হাজির করা হচ্ছে সিদ্ধান্তের নামে, তখন মূলত বিরোধে লিপ্ত হওয়ার জন্য একটা পরোক্ষ আহ্বান এবং একটা বিরোধের এজেন্ডাকে কিন্তু হাজির করা হয়।’
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘পলিটিকস ল্যাব: পাবলিক ডায়ালগ’ শীর্ষক সংলাপে এ কথা বলেন জহির উদ্দিন। সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তরের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। বিএনপি অভিযোগ তুলেছে, তাদের আপত্তির বিষয়গুলো রাখা হয়নি সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ায়। আলোচনায় আসেনি, এমন কিছুও যুক্ত করা হয়েছে।
সংলাপে জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনই জাতির সামনে জানাল যে ঐক্য নাই। ঐকমত্যের কাজই হবে যতটুকু ঐক্য আছে, সেটাকে উত্তোলন করা, যতটুকু নাই ততটুকুকে জানিয়ে রাখা এর চাইতে বেশি কোনো কাজ নাই। কমিশন শব্দটার মধ্যেই তো রয়েছে যে তারা অথরিটি নয়।’
জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা থেকে যদি প্রকৃত অর্থে সংস্কারই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মেনে চলার ওপর জোর দেন তিনি।