অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক করেছে। বস্তুত ছয়টির মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একে কেন্দ্র করে এবং এর সঙ্গে সংগতি রেখেই বাকি সব রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, সরকারের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। 

শুরুতেই উল্লেখ করা দরকার, এ রিপোর্টের মূল বিষয়গুলোর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অন্তর্বর্তী সরকার প্রস্তাবিত খসড়া জুলাই ঘোষণার সাদৃশ্য রয়েছে। জুলাই ঘোষণার ভুল, অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতা সংক্রান্ত পয়েন্টগুলো আমরা ইতোমধ্যে লিখিত আকারে তুলে ধরেছি। 
এটা বিস্ময়কর যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্ম এবং ছাত্র আন্দোলনই এই গণঅভ্যুত্থানের উৎস। অথচ দেশের কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ের উল্লেখ এ প্রতিবেদনে নেই।

এ প্রতিবেদন দাবি করছে, ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা এ.

কে. ফজলুল হক ‘লাহোর প্রস্তাব’ উত্থাপন করেছিলেন। এই উপমহাদেশের বিরাট ভূখণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে শুধু লাহোর প্রস্তাবকে উপস্থাপন করা আমাদের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে পাকিস্তান পর্বের বর্ণনা আছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান যে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল– এই প্রতিষ্ঠিত বক্তব্য এ প্রতিবেদনে অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রতিবেদন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও তার শহীদদের, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের তাৎপর্য, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনকে উল্লেখ করেনি বললেই চলে। অথচ এ আন্দোলনগুলো বাংলাদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়াও ছেষট্টির ছয় দফার আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উপনিবেশবিরোধী চরিত্র, যা স্বাধীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছিল এবং যার ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল– এই ঐতিহাসিক ক্রমটি এইভাবে বিবৃত করা হয়নি।
কমিশনের সুপারিশগুলোর সারসংক্ষেপের ৭ নম্বর পয়েন্টে ‘মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ’-এর কথা বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৫)। অথচ তার দুই পৃষ্ঠা পরে (পৃষ্ঠা ৭) ঠিক উল্টো কাজটি করা হয়েছে। সেখানে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত আলোচনার ২ নম্বরে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানকে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার ৫ নম্বর পয়েন্টে সম্পদের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানের মতোই এখানেও অত্যাবশকীয় মৌলিক অধিকারগুলোকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়নি এবং আইন দ্বারা বলবৎ করা হয়নি।

প্রতিবেদনের তৃতীয় অধ্যায়ে সুপারিশের যৌক্তিকতা সম্পর্কিত অংশে রাষ্ট্রের মূলনীতি সংক্রান্ত বিধানের অন্তর্ভুক্তির আলোচনায় কমিশন প্রস্তাব করেছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বাদ দিতে। যে ধারণাগুলো কমিশন বাদ দিল এবং যেগুলো অন্তর্ভুক্ত করল, তার যুক্তিগুলো পরিষ্কার নয়।
বাহাত্তরের সংবিধানে যেভাবে জাতীয়তাবাদের ধারণা দেওয়া হয়েছে, তা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ ও আলোচনার দাবি রাখে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনাটা পড়লেই বোঝা যায়, তা খুবই একপেশে। কমিশন মুক্তবাজার অর্থনীতিকে সুপারিশ করছে। এ কথা এখন সর্বজনবিদিত, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের নামে বাইরের বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এবং দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় শ্রমজীবী মানুষকে নির্মমভাবে শোষণ করে নিঃস্ব করে দেয়। এ কথা ভুলে যাওয়া যাবে না যে, পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এই মুক্তবাজার অর্থনীতিকেই কার্যকর করেছিলেন।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে জুলাই হত্যাকাণ্ডের কথা বলা আছে। কিন্তু গণআন্দোলনের ওপর নৃশংস দমনপীড়ন বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই দেখা গেছে। কমিশন রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে শুরু হওয়া এ সমস্যা সম্পর্কে কোনো পর্যবেক্ষণ রাখেনি। প্রশ্ন হলো, যে বাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে, ন্যায় ও সত্যকে তুলে ধরবে এবং অন্যায় প্রতিরোধ করবে, তাদের এই অধঃপতন হলো কেন? এর কারণ কি শুধু পতিত স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার? আমরা মনে করি, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো যত বৃদ্ধি পাবে, সরকার সেগুলোকে সমাধান করার সক্রিয় চেষ্টা যতদিন না করবে, বারবার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। একের পর এক ক্ষমতাসীন সরকার পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী দিয়ে সেই বিক্ষোভ দমন করবে। এভাবে ব্যবহৃত হতে হতে পুলিশ বাহিনীর চূড়ান্ত অধঃপতন ঘটে, যা আমরা জুলাই অভ্যুত্থানে দেখেছি। মনে রাখা দরকার, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের শাসনের মধ্যেই বিভিন্ন ন্যায়সংগত আন্দোলনের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে। গুলি করে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের হত্যাও করেছে। আমাদের সুস্পষ্ট দাবি হলো, ন্যায়সংগত গণআন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ বন্ধের সুপারিশ কমিশনের প্রস্তাবে থাকা উচিত। 
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য, বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে বহু কথা থাকলেও এই প্রতিবেদন অনুসন্ধান করতে পারেনি– কেন এ রকম হলো। বাস্তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় জোর করে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা স্বাভাবিক। সমগ্র বিষয়টির কার্যকারণ অনুসন্ধান না করে একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ করার সদিচ্ছা কমিশনের থাকতেই পারে; কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। 

প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে হলে শুধু বড় দলগুলো নয়, ছোট এবং নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক শর্ত করা অনুচিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার সম্পন্ন এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। প্রতিটি সংস্কার প্রস্তাবই আলোচিত হওয়া উচিত। কিন্তু সংস্কার প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে প্রতফিলিত দৃষ্টিভঙ্গিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজের রূপরেখা। 

মাসুদ রানা: সমন্বয়ক, বাসদ (মার্ক্সবাদী)

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র ঐকমত য ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব

কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তবে কারা, সেটা স্পষ্ট করেননি তিনি।

আজ শনিবার বিকেলে রংপুর নগরের সেন্ট্রাল রোডে জাপা কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শামীম হায়দার পাটোয়ারী এ মন্তব্য করেন।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু দল ইতিমধ্যে ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে বা স্বাক্ষর করে একধরনের ফাঁদে পড়ে গেছে। কিছু রাজনৈতিক দল বলছে, ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে। এখানে প্রতারক ও প্রতারণা শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো এ রকম সংস্কার চাইনি।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ঐকমত্য তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে জাপা মহাসচিব বলেন, কমিশন ৫৬টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি দলকে বাদ দিয়েছে। যে দলগুলো সেখানে গেছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে মতবিরোধ আছে। এক ভাগকে ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, আরেক ভাগ ঐক্য প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছে। অন্য আরেক ভাগ ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে পরে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেছে।

বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির বলে দাবি করেছেন শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। কারণ, নির্বাচিত সরকার সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট করেছে ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। এই মুহূর্তে দেশে যে প্রশাসনিক কাঠামো আছে, তার ব্যাপারে তথ্য উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, তাঁরা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কথামতো প্রশাসন সাজিয়েছে, তার সঙ্গে এনসিপি আছে। এই তিন দলের বাইরে অন্য কোনো দল যদি ভোটে আসে, এই প্রশাসনিক কাঠামো সেই দলকে সুষ্ঠু ভোট হতে দেবে না।

গণভোটের দাবি নজিরবিহীন উল্লেখ করে শামামী হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সংবিধানে এই মুহূর্তে গণভোট কোনো প্রভিশনে নেই। বর্তমানে গণভোটের যে দাবি উঠেছে, সংসদে পাস হওয়ার আগে এই দাবি বাস্তবায়ন হলে ঐকমত্য কমিশনকে সংসদের মর্যাদা দেওয়া হবে। ঐকমত্য কমিশন সার্বভৌম নয়, নির্বাচিত নয় ও সংসদ নয়। সংসদকে এড়িয়ে গিয়ে কোনো আইন পাস করা হলে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।

এ সময় জাপার কো–চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান, প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ইয়াসির, রংপুর জেলার আহ্বায়ক আজমল হোসেন, সদস্যসচিব হাজী আবদুর রাজ্জাক, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাসানুজ্জামানসহ জাপা ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সরকারের ভেতরে একটা অংশ নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে: এনসিপি
  • প্রথম আলোরও একটা ঐকমত্য সনদ আছে, আর তা আছে আমাদের হৃদয়ে
  • রাজনৈতিক দলগুলোকে ৭ দিনের সময় দিলে সরকার
  • গণভোট নিয়ে মতভেদে উপদেষ্টা পরিষদের উদ্বেগ
  • দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেবে
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কেন এমন দুর্বোধ্য পথ
  • এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘ঐকমত্য সুপারিশ’ দেওয়ার আহ্বান
  • সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে
  • তড়িঘড়ি না করে সংবিধান সংস্কারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
  • কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব