সাম্প্রতিক সময়ে বাস ডাকাতির বিষয়টি আবারও আলোচনা তৈরি করেছে। কিছুদিনের পত্রিকা ঘাঁটলেই বাস ডাকাতির বিষয়টি ভালোমতো টের পাওয়া যায়। এবং পুলিশ এসব ঠেকাতে তাদের ব্যর্থতা দেখিয়েই যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে যে ঘটনা ঘটল, তা আসলে চরম ন্যক্কারজনক। আর পুলিশ তদন্ত শেষ না করেই ধর্ষণ নাকি শ্লীলতাহানি, তা নিয়ে মত দিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আরও লজ্জাজনক। সত্য গোপন করলে কোনো সমস্যার সমাধান আসলেই হবে না।

আমাদের দেশে সড়কে দুইভাবে ডাকাতি হয়। একটি হচ্ছে রাস্তায় গাছ ফেলে বাস থামিয়ে একসঙ্গে অনেক বাস বা গাড়িতে ডাকাতি করা হয়। আর একটা হচ্ছে যাত্রীবেশে বাসে উঠে ডাকাতি করা। আমি একবার খুলনা থেকে ঢাকা আসার পথে যাত্রীবেশে ডাকাতিতে পড়েছিলাম। এত বছর হয়ে গেছে ডাকাতেরা এই দুইটা প্যাটার্নের ডাকাতি করা থেকে বের হতে পারেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ছোট্ট এই দেশে এত বছরেও যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বন্ধে কার্যকরী কোনো সমাধানে যেতে পারেনি পুলিশ।

প্রথমে বাস ডাকাতিতে কী কী হয়, তা বলে নিই। সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে, সেই সময় যাত্রীবেশে ডাকাতেরা উঠে সবার আগে চালককে সরিয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। অনেকেই বলে কেন ৫০ জনের মতো যাত্রী ডাকাতদের সঙ্গে পারে না। কারণ, বাসে নড়াচড়ার জায়গা থাকে না। নড়াচড়া করলে ওরা ছুরিকাঘাত করে। ফলে যাত্রীদের আসলে কিছু করার থাকে না। এ অবস্থায় একজন সাধারণত পিস্তল তাক করে থাকে আর বাকিরা যাত্রীদের জিনিসপত্র হাতানো শুরু করে। যাত্রীরা কোনো কিছু সিটের নিচে ফেললে তা মিস করবেই না। আর কেউ বাধা দিলে ছুরি মারবে। এদের আসলে খুন করার ইচ্ছা থাকে না।

এরা সাধারণত সেই বাস লক্ষ্য করে যেখানে অন্তত একজনের কাছে বড় অঙ্কের টাকা থাকে। এর মানে হলো তাদের নিজস্ব ইনফরমার থাকে, তাদের তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় কোন বাস ডাকাতি করা হবে। আর বাকি টাকা, গয়না, ফোন হচ্ছে অতিরিক্ত লাভ। লাগেজের প্রতি এদের খুব আগ্রহ থাকে না, ল্যাপটপ ছাড়া। বাসের বক্সে রাখা লাগেজ বা ব্যাগপত্রের দিকে তাদের নজর থাকে না বললেই চলে।

কিন্তু এদিকে রাস্তায় গাছ ফেলে দেওয়া ডাকাতেরা সবকিছু নেওয়ার জন্যই প্রস্তুত থাকে। নিজস্ব পিকআপ দিয়ে তারা চলতে পারে। তারা অবশ্যই জানে যে এই রাস্তায় পুলিশি টহল থাকবে না। কিছুদিন আগে নওগাঁয় এ রকম ডাকাতি হলো। সাধারণত ডাকাতি শেষ করেই ডাকাতেরা নেমে যায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা ধরে বাসে থেকে যায়, যেখানে ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটে। এ থেকে বোঝা যায়, তাদের কাছে তথ্য থাকে রাস্তায় পুলিশি টহল নেই।

তার মানে বোঝা যাচ্ছে ডাকাতির সঙ্গে পুলিশের এক প্রকার যোগসাজশ থাকে। আসলে পত্রিকায় যে ঘটনা আসে, ডাকাতির সংখ্যা তার থেকে বেশি থাকে। এমনকি আমি যে ডাকাতিতে পড়েছিলাম, তার খবরও পত্রিকায় আসেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, এই দেশে পুলিশের কোনো এক অসাধু অংশ জানেই কারা এই ডাকাতের দলের সঙ্গে জড়িত।

এরপর তাদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকে বাসের কর্মচারীদের। বাসের ভেতরের খবর আগে থেকেই তারা জানে। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তা থেকে যাত্রী তোলার নাম করে তারা ডাকাতদের তুলে নেয়। ডাকাতদের কাছে যাত্রীদের তথ্য থাকে। অনেক ক্ষেত্রে মালিকেরা নিজেদের সুনামের স্বার্থে মামলা করে না। এমনকি তারা যাত্রীদেরও অনেক সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দিতে চায় না।

এখন কী করা উচিত? বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এবং আমাদের মতো ছোট দেশে বাস ডাকাতি ঠেকানো কঠিন কিছু না। চালকের আসনের পাশে একটি জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস থাকবে এবং সেটা নিরাপত্তারক্ষীদের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। কিন্তু তা করতে গেলে বাসমালিক এবং পুলিশ দুই পক্ষেরই ইচ্ছা থাকতে হবে। কিন্তু প্রযুক্তি স্থাপনে দুই পক্ষই আসলে খুব বেশি ইচ্ছুক না। ফলাফল হচ্ছে, ডাকাতি আসলে কমছে না।

আমাদের অপরাধের বেশির ভাগই একই ধরনের, একই রকমের। যদি প্রযুক্তি স্থাপন করা না যায়, তাহলে অন্তত ম্যানুয়ালি রক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রাতের বাসগুলোয় আগে চেক পয়েন্টে নিয়মিত চেক এবং ভিডিও ক্যামেরাতে যাত্রীদের চেহারা রেকর্ড করা হতো। এখন সেই চল উঠে গেছে বলেই চলে। যেসব বাসে ভিডিও রেকর্ড করা হতো, সেই মাসগুলোতে ডাকাতির কথা কখনো শুনিনি। এই জিনিস বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাস ছাড়ার সময় মালিকদের নিজ উদ্যোগে ভিডিও রেকর্ড করা উচিত। তারপর অন্তত দুইটা চেক পয়েন্টে রেকর্ড পুলিশের চেকিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। একটা শুরুতে এবং আর একটা রাস্তায় মাঝখানে বিরতি দেওয়ার পর। রাতে দেশে এখন পুলিশের চেকপোস্ট দেখাই যাচ্ছে না। এটা অবিলম্বে সক্রিয় করতে হবে।

রাস্তা থেকে যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনোভাবেই বাস ছেড়ে দেওয়ার পর আর যাত্রী তোলা যাবে না। চালকের পেছনে প্রতিবন্ধক সব বাসে বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাতে ডাকাতেরা শুরুতেই বাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে। বাসমালিকেরা নিরাপত্তারক্ষী দিতে পারেন, পুলিশও সাদাপোশাকে বাসে থাকতে পারে। যা অপরাধী ধরতে সাহায্য করবে।

দেশে পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে টহল বাড়াতে হবে। পুলিশ এখন গাড়ির অভাবে লেগুনায় টহল দিচ্ছে। যা আসলে কোনো কাজেই আসছে না। হাইওয়ে থানা বাড়াতে হবে। পুলিশকেই আসল কাজ করতে হবে। এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

কিন্তু একটা বিষয় আমরা সবাই মিস করে যাই। সেটা হচ্ছে সব অপরাধী ধরা না পড়লেও অল্প কিছু তো ধরা পড়ে। তাদের কি বিচার হচ্ছে? তারা সবাই জামিনে বের হয়ে তো আগের কাজই করছে। গুগল করে বাস ডাকাতের শাস্তির দু–তিনটা উদাহরণ ছাড়া চোখে পড়ল না। এটা কি বিচার বিভাগের দুর্বলতা নাকি আমাদের তদন্তের দুর্বলতা, তা আসলেই দেখা উচিত। পুলিশ যদি বিচার বিভাগ থেকে সাহায্য না পায়, এই দেশে অপরাধ কখনোই কমবে না।

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট
ই–মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র র কর ড অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে প্রতি কেজি আলুর হিমাগারভাড়া কমল ৭৫ পয়সা

রাজশাহীতে হিমাগারে আলু সংরক্ষণে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ সোমবার আলুচাষি, ব্যবসায়ী ও হিমাগারমালিকদের উপস্থিতিতে এ সিদ্ধান্ত হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হিমাগারে প্রতি কেজি আলু রাখার জন্য ভাড়া দিতে হবে ৫ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে শ্রমিকের খরচ ৫০ পয়সা। সেই হিসাবে প্রতি কেজি আলুর হিমাগারভাড়া কমেছে ৭৫ পয়সা।

এর আগে গত মার্চে সরকার প্রতি কেজি আলু রাখার ভাড়া ৬ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর পর থেকে এ নিয়ে রাজশাহীর আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা বাড়তি ভাড়ায় আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে কয়েক দফা তাঁরা রাজপথে আন্দোলনও করেছেন। অন্যদিকে হিমাগারমালিকদের দাবি ছিল, প্রতি কেজি আলুর ভাড়া ৮ টাকা করা হোক।

রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন এবং রাজশাহী জেলা আলুচাষি ও আলু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজশাহীতে হিমাগার থেকে বাড়তি ভাড়া না দিলে আলু ছাড়া হবে না। এর প্রতিবাদে ঈদের পর নতুন করে আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করে আসছেন। তাঁদের দাবি, আলু রাখার খরচ আগের বছরের মতো চার টাকা করতে হবে। এ নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তাঁরা। হিমাগার মালিকপক্ষ এ নিয়ে আলোচনায় বসার তাগিদ দিয়ে আসছিল।

এরই মধ্যে আলুচাষিনেতারা ১৪ জুন সেনাবাহিনীর কাছে এ নিয়ে একটি অভিযোগ দেন। পরে বিষয়টি আমলে নিয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আজ দুপুরে সভা ডাকা হয়। সভায় সব পক্ষের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে এ বছর সরকার নির্ধারিত প্রতি কেজি আলুর হিমাগারভাড়া ৬ টাকা ৭৫ পয়সার বদলে ৫ টাকা ৫০ পয়সা ও শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা রাখা হবে। আর পেইড বুকিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা দিতে হবে আলু রাখা চাষি ও ব্যবসায়ীদের। পরে বিকেলে ক্যান্টনমেন্টে হওয়া এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিকভাবে পাস করার জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সভা হয়।

সভায় আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, হিমাগার মালিক সমিতি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি, পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীকাল মঙ্গলবার রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পক্ষ থেকে নতুন ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি সব হিমাগারে প্রচার করা হবে।

এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এবার আলুর দাম কম। আবার এ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘাতের আশঙ্কা ছিল। এ নিয়ে একটি অভিযোগ পান তাঁরা। পরে দুই পক্ষকে নিয়ে সভা হয়। সভায় সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত বিকেলে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে আরেকটি সভার মাধ্যমে পাস হয়েছে।

রাজশাহীর আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মিঠু আহমেদ বলেন, শুরু থেকেই তাঁরা বাড়তি ভাড়ার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। কয়েক দিন ধরে তাঁরা হিমাগার থেকে আলু নিতে পারছিলেন না। হিমাগারগুলোয় বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছিল। এ নিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও অবহিত করেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত একটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে।

রহমান সিডস স্টোরেজের ব্যবস্থাপক আবদুল হালিম বলেন, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি কেজি আলু রাখতে খরচ পড়বে ৫ টাকা ৫০ পয়সা আর শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা। এ ছাড়া যাঁরা আগে থেকেই টাকা দিয়ে অগ্রিম বুকিং দিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আলুর কেজিপ্রতি শ্রমিক খরচ ৫০ পয়সা দিতে হবে।

রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, নতুন সিদ্ধান্ত সব হিমাগারমালিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হবে।

আরও পড়ুনরাজশাহীতে হিমাগারে ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ-সমাবেশ১৫ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ