অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে: তারেক রহমান
Published: 27th, February 2025 GMT
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষতাই হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতিমধ্যেই জনমনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আরও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি ঢাকায় দলের বর্ধিত সভায় যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন তারেক রহমান। আজ বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে শুরু হয় বিএনপির বর্ধিত সভা। সভায় ভার্চ্যুয়ালি যোগ দিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাঁর রেকর্ড করা বক্তব্য সভায় প্রচার করা হয়।
সভায় তারেক রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য জনমনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করলেও এ নিয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য-মন্তব্য স্বাধীনতাপ্রিয়, গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য হতাশার কারণ হয়ে উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত সমর্থন থাকলেও সরকার এখনো নিজেদের কর্মপরিকল্পনার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারছে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সারা দেশে খুন, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি বেড়েই চলেছে। বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এখনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকার যেখানে দেশের বাজার পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার পরিচয় দিতে পারছে না, সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে কেন দেশের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করতে চাইছে, এটি জনগণের কাছে বোধগম্য নয়।
তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্রকামী জনগণ মনে করে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হলে তা হবে পলাতক-স্বৈরাচারের দোসরদের সারা দেশে পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া। যা হবে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বিরোধী। গণহত্যাকারী, টাকা পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ, মাফিয়াচক্রকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না।
বিএনপি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল জনরায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে গণহত্যাকারী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সারা দেশে গণহত্যাকারীদের দোসর, মাফিয়াচক্রকে পুনর্বাসনের স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা থেকে সরে আসুন। অবিলম্বে অন্তর্বর্তী সরকারের আগামী দিনের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে কথা বলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, মাফিয়াপ্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর এখন পর্যন্ত ১৬-১৭টি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সব নতুন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে স্বাগত জানায়। তবে দলগুলোকে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণ কিংবা বর্জনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে জনগণ। সুতরাং, প্রতিটি দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সবার আগে নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র পর স থ ত সরক র র ব এনপ র ন র জন ন বল ন
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন
গত মাসের শুরুতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর যখন বিশ্বনেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানাতে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপপ্রধানমন্ত্রী ও ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের মালিক শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘অঢেল টাকার মালিক।’
চারপাশে হাসি আর করতালির রোল পড়ে গিয়েছিল। আবারও ট্রাম্প মুখ ফসকে এমন কথা বলে ফেললেন, কিন্তু তাতে কীই–বা যায় আসে?
সুদানের এল-ফাশের শহরটি সংযুক্ত আরব আমিরাত–সমর্থিত আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের রাজনীতিকেরা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, সেটি দেখে আপনি ট্রাম্প ও আল নাহিয়ানের হাত চেপে ধরার দৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন।
সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করুন, যখন ট্রাম্প সরকারের আরব ও আফ্রিকাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মাসাদ বোলস আরএসএফের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘নাগরিকদের রক্ষা করতে ও আরও দুর্ভোগ এড়াতে’। অথচ এই বাহিনীকেই যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন, যখন ব্রিটিশ মন্ত্রী ব্যারোনেস জেনি চ্যাপম্যান ‘উদ্বেগ প্রকাশ’ করছেন এবং বলছেন যে আরএসএফের উচিত ‘নাগরিকদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা’।
ট্রাম্প যখন আল নাহিয়ানের হাত চেপে ধরে তাঁর ‘সীমাহীন অর্থের’ প্রশংসা করছিলেন, তখনো সুদানের উত্তর দারফুর প্রদেশের রাজধানী এল-ফাশের ৫০০ দিনের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ ছিল। শহরটির বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। আরএসএফ কাদামাটির প্রাচীর তুলে পুরো শহরকে ঘিরে ফেলেছিল, যাতে সাধারণ মানুষ এক ভয়ংকর হত্যার ফাঁদে আটকা পড়েন।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে এই আধা সামরিক বাহিনী সুদানের সরকারি সেনাবাহিনীর (এসএএফ) সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। দারফুরজুড়ে তারা যা করেছে, এল-ফাশেরেও সেটি করতে তারা প্রস্তুত হচ্ছিল। মানে নিরীহ সুদানি নাগরিকদের গণহত্যা।
২০২৪ সালের মে মাস থেকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে আসছিল, এল-ফাশের আরেকটি স্রেব্রেনিৎসা (বসনিয়ার এই শহরে ১৯৯৫ সালে গণহত্যা হয়েছিল) হতে যাচ্ছে। তারা সতর্ক করে দিয়েছিল, সারা বিশ্বের সামনে আবারও ভয়াবহ গণহত্যা ঘটবে, অথচ কেউ কিছুই করবে না।
বাস্তবেও সেটিই ঘটেছে।
৫০০ দিনের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ এল-ফাশেরের বাসিন্দারা জীবন বাঁচাতে যখন প্রাণপণ পালানোর চেষ্টা করছেন, যখন সারি সারি লাশ পড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে, তখন রাজনীতিকেরা গণহত্যাকারী আরএসএফকে বলছে ‘নাগরিকদের রক্ষা করতে’! মনে রাখবেন, তারা এটি করতে পেরেছে কারণ, আরব আমিরাতের শাসকদের হাতে ‘অঢেল অর্থ’ আছে।আরএসএফ যোদ্ধারা তাঁদের তৈরি করা নরক থেকে পালাতে চাওয়া সাধারণ মানুষদের গুলি করে হত্যা করেছেন। তাঁরা ত্রাণকর্মীদের নির্যাতন করেছেন। গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের মতো করেই তাঁরা গণহত্যার ভিডিও করেছেন। তাঁদের হত্যার শিকার দুর্ভাগা মানুষের রক্তস্রোত এমনভাবে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে, যেটি স্যাটেলাইটের ছবি থেকেও দেখা যাচ্ছে।
যে সুদানি সেনাবাহিনীর এল-ফাশের রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল, তারা বহু মাস ধরে নিজেদের ঘাঁটির চারপাশে মাইন পুঁতে বসে আছে, যাতে তারা নিজেরা নিরাপদে থাকতে পারে।
আরএসএফের জন্ম হয়েছে এই শতাব্দীর প্রথম দশকে দারফুরের জঞ্জাওয়িদ নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে। এরা একসময় সুদানের সেনাবাহিনীর অংশ ছিল। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী অগণতান্ত্রিক ও বিপ্লববিরোধী শক্তি। তারা সুদানের অভিজাত সম্প্রদায়ের ধন-সম্পত্তি রক্ষা করার চেষ্টা করত।
কিন্তু এল-ফাশেরে এখন যেটি ঘটেছে, সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া সম্ভব হতো না। আরব আমিরাত সব সময় অস্বীকার করে এলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরএসএফের সংঘাতে তারা সব সময় অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে।
সুদানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি ঘাঁটি রয়েছে। দক্ষিণ দারফুরের নিয়ালা ও এল-ফাশের থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের আল-মালহায়। এ ছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য দেশ সোমালিয়ার বোসাসো, দক্ষিণ লিবিয়ার আল-কুফরা ও উগান্ডার কাজ্জানসি বিমানঘাঁটি থেকেও আরব আমিরাত তাদের অস্ত্র ও রসদ আরএসএফের কাছে পৌঁছে দেয়।
আরএসএফের প্রধান মোহামেদ হামদান দাগালো। তিনি হেমেদতি নামে বেশি পরিচিত। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতকে খনির সোনাগুলো দিয়ে দিয়েছেন। পশ্চিম সুদানসহ অন্য অঞ্চল থেকে ভাড়াটে সেনাদের তিনি তাঁর বাহিনীতে নিয়েছেন, যাঁরা আরব আমিরাতের জন্য কাজ করছেন। সুদানের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্পদে পূর্ণ একটি দেশে তিনি আরব আমিরাতের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন।
সুদানের লোহিত সাগরের উপকূল, উর্বর কৃষিজমি, যুবক যোদ্ধা—এসব কিছুই আরব আমিরাতকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আরব আমিরাত চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবকে ছাড়িয়ে প্রধান বহিরাগত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো ২০১৯ সালে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক ওমর আল-বাশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সুদানে রক্তাক্ত দমন–পীড়ন চালিয়ে সেটিকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
সুদানে সাম্প্রতিক যুদ্ধে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ গৃহহারা হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তা সত্ত্বেও পশ্চিমা রাজনীতিকেরা মাঝেমধ্যে হাত নেড়ে উদ্বেগ প্রকাশ ও কপাল ভাঁজ করে দুশ্চিন্তা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করছেন না।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর আরব আমিরাত আরএসএফের প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ফলে আরএসএফকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধে আবুধাবিকে কখনোই কার্যকর চাপ দেওয়া হয়নি। ফলে যুদ্ধ শেষ কিংবা অন্তত বিরতির প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে যে সামরিক সরঞ্জাম আরব আমিরাত কিনছে, তা সুদানে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্রিটিশ মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক বাতিল করেছিল। তার কারণ হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সুদান যুদ্ধে যুক্তরাজ্য আবুধাবির পক্ষে দাঁড়ায়নি। সে সময় যুক্তরাজ্যের একজন মন্ত্রীর উড়োজাহাজ আরব আমিরাত যাওয়ার পথে মাঝ আকাশে ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল।
৫০০ দিনের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ এল-ফাশেরের বাসিন্দারা জীবন বাঁচাতে যখন প্রাণপণ পালানোর চেষ্টা করছেন, যখন সারি সারি লাশ পড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে, তখন রাজনীতিকেরা গণহত্যাকারী আরএসএফকে বলছে ‘নাগরিকদের রক্ষা করতে’! মনে রাখবেন, তারা এটি করতে পেরেছে কারণ, আরব আমিরাতের শাসকদের হাতে ‘অঢেল অর্থ’ আছে।
অস্কার রিকেট, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত