চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আলোচিত সেই ১০ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রক্টরের উস্কানি প্রকাশ্যে এসেছে। বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ কানন ও অধ্যাপক ড. কোরবান আলীর এ ধরনের কিছু কথোপকথন ভাইরাল হয়েছে। এসব স্ক্রিনশটে ওই ১০ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করতে ‘প্রশাসনকে চাপ’ প্রয়োগ করার জন্য একটি পক্ষকে উস্কে দিচ্ছেন এমন কথোপকথন দেখা গেছে। 

গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনা হলের নামফলক ও হলের সামনে কংক্রিট নির্মিত নৌকা ভাঙতে গেলে ভাঙচুরকারীদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হয় ওই হলের শিক্ষার্থীদের। ছাত্রীদের অভিযোগ, তারা নৌকা ভাঙার বিপক্ষে নন; বরং প্রশাসন যেন এটি ভাঙে, সে দাবি করেছিলেন। এ জন্য তারা আগেই প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তবে প্রশাসন সেটি ভাঙেনি। উল্টো মধ্যরাতে একদল শিক্ষার্থী সেটি ভাঙতে গিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। গালাগাল করেছে। বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছে। এসব ঘটনায় হলের আবাসিক শিক্ষক ও প্রক্টরিয়াল বডিকে ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি। 

এ ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন রাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রতিবাদ জানাতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড.

মোহাম্মদ কোরবান আলির সঙ্গেও শিক্ষার্থীদের বাকবিতন্ডা হয় এই ঘটনায়। এক পর্যায়ে সহকারী প্রক্টরের গায়ে হাত তোলেন এক শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এই ঘটনায় ১০ জনকে বহিষ্কারের তথ্য প্রকাশের পর সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

তবে এই বহিষ্কারাদেশের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হস্তক্ষেপ, শিক্ষার্থীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়া ও তদন্তের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার মতো বিভিন্ন অভিযোগ তুলে আন্দোলন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছেন তারা। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের জন্য প্রধান প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।

এসব ঘটনার মধ্যেই গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ কানন ও অধ্যাপক ড. কোরবান আলীর কিছু মেসেজের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। বিভিন্ন পক্ষ ও নুরুল হামিদ কাননের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব স্ক্রিনশট ‘এডিটেড’ নয়। স্ক্রিনশটগুলো ঘটনার পর ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর রাত, ৭ ফেব্রুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারির। 

যেখানে দেখা যায়, অধ্যাপক ড. কোরবান আলী ঘটনাস্থলে উপস্থিত শেখ হাসিনা হলের কতিপয় শিক্ষার্থীদের তালিকা পাঠিয়েছেন। আরেক সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন একজন শিক্ষার্থীর জীবন বৃত্তান্তও পাঠিয়েছেন। আরও দুটি বার্তায় লেখা আছে, ‘তোমরা আগামীকাল কঠিন কর্মসূচি দাও। অন্তত যেন প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে হল থেকে বের করে দেয়।’ ও ‘এদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিতে প্রশাসনকে চাপ দাও। প্রক্টর অফিস ঘেরাও করো।’

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রক্টর নুরুল হামিদ কাননকে ফোন করলে তিনি উক্ত মেসেজগুলো পাঠানোর প্রেক্ষাপট প্রতিবেদককে ব্যাখ্যা করেন। তবে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করতে রাজি হননি। 

এদিকে চবিতে এই বহিষ্কারের ঘটনায় সারা দেশে বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার মুখে ওই ১০ শিক্ষার্থীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী বহিস্কার হওয়া শিক্ষার্থীর সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এখনও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বহিষ্কৃতরা। 

জানতে চাইলে বহিষ্কারের শিকার শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া মিথিলা সমকালকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট সভায় আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের কথা বলা হলেও আমাদেরকে এখনও কোনো ফোনকল বা যোগাযোগ করা হয়নি। এ বিষয়টি যেন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা তো এখনও কোনো বহিষ্কারাদেশের চিঠিও পাইনি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কথোপকথনের বিষয়ে জান্নাতুল মাওয়া মিথিলা বলেন, ‘এটি দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। এখানে একজন শিক্ষক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন। এছাড়াও তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রক্টরিয়াল বডির হস্তক্ষেপও খেয়াল করেছি। আমাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের এ ধরনের উস্কানিমূলক কথা বার্তা ও আমাদেরকে প্রতিপক্ষ করে ফেলছেন দেখে বেশ খারাপ লেগেছে।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র সহক র ঘটন য

এছাড়াও পড়ুন:

চিনি-লবণের অনুপম পাঠ

চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।

শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।

সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।

অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।

বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।

ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।

পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।

মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • র‍্যাংকিংয়ে মিরাজ-জাকেরদের অগ্রগতি
  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • বিদ্যালয়ের ১৮টি গাছ বিক্রি করলেন প্রধান শিক্ষক 
  • ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’ বক্তব্যটি শেখ হাসিনার: তাজুল ইসলাম
  • কর্ণাটকে ক্রিকেট খেলার সময় বচসা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা
  • দেশে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে চালুর দাবি 
  • রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডোর’ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন প্রেস সচিব
  • কানাডায় আবারও লিবারেল পার্টির সরকার গঠনের আভাস
  • সারজিস আলমের চ্যালেঞ্জের জবাব দিলেন রাশেদ খান
  • সারজিস আলম ও রাশেদ খানের পাল্টাপাল্টি ফেসবুক পোস্ট