৮৮১ শহীদের মধ্যে ৫৮১ জনের স্বজনেরাই মামলা করেননি
Published: 27th, February 2025 GMT
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ৮৮১ জনের মধ্যে মাত্র ৩০০ শহীদের স্বজনেরা মামলা করেছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। যে ৫৮১ জন মামলা করেননি, তাঁদের স্বজনেরা জানিয়েছেন, অজানা ভয় ও হুমকির কারণে তাঁরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে এমএসএফ। গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনার বিষয়ে ‘হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনস ইন জুলাই–আগস্ট ২০২৪ স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন জানায়, গত বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন। দাবি আদায়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশসহ শান্তিপূর্ণ নানা কর্মসূচি পালন করেন। আন্দোলনকারীদের দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ–সংগঠনের সদস্যদের নির্মম ও বর্বরোচিত আচরণ ছড়িয়ে পড়ে। রংপুরে আবু সাঈদ এবং ঢাকায় মুগ্ধ নিহত হওয়ার ঘটনায় দ্রুতই সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়। আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতা ও পুলিশি হামলায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিহত, আহত, নির্যাতন, হুমকি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট, সনাতন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, নিখোঁজ, মন্দির ও মাজারে আক্রমণের শিকার হন ১১ হাজার ৩৪৮ জন। সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে নিহত হয়েছেন ৮৮১ জন, আহত ৭ হাজার ৮৭৩, হুমকির শিকার ৯৩৩ জন, নির্যাতনের শিকার ৭৩১ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৫৪ জন। যদিও কয়েকজন পরে ফিরে আসেন।
গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৮৮১ জন নিহতের মধ্যে দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৫৬৮ জন, বিভিন্ন পেশাজীবী (পোশাকশ্রমিক, দিনমজুর, বিভিন্ন যানবাহনের চালক, দোকান ও রেস্তোরাঁর কর্মী ও যানবাহনের মেকানিকস) পেশার ১৬৪ জন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (রাস্তার বিক্রেতা) ৮৫ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ২৩ জন, কৃষক ৯ জন, শিক্ষক ৬ জন, ডাক্তার ৫ জন, সাংবাদিক ও ফ্রিল্যান্সার ১০ জন, ব্যাংকার ৪ জন, আইনজীবী ৩ জন, প্রবাসী ২ জন, সরকারি চাকরিজীবী ১ জন ও ফটোগ্রাফার আছেন ১ জন।
নিহত ৫৬৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০৬ জন মাদ্রাসার, ১৩৬ জন প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের, ২৬৫ জন কলেজের ও ৬১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে অথবা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বলে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে বনশ্রীতে শহীদ নাজমুলের মা নাজমা আক্তার, আজিমপুর এলাকার শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লার বাবা খাইরুল হাসান এবং চানখাঁরপুলে গুলিবিদ্ধ আহত রকিবুল হাসান সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তাঁরা সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করার কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে সব ঘটনার বিচার দাবি করেন।
৫ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সহিংসতার ঘটনাগুলোও তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন। গবেষণা প্রতিবেদনে এই সময়কার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, এই সময়ে ৮৭৬টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে অগ্নিসংযোগ ৩৩৩টি, ভাঙচুর ও লুটপাট ৩০০টি, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি আক্রমণ ২২৩টি এবং মন্দির ও মাজারে আক্রমণের ঘটনা রয়েছে ২০টি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সালমা আলী বলেন, গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা রাষ্ট্র ও আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে। জুলাই-আগস্টের ঘটনায় নারীদের ভূমিকা কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। যথাযথভাবে ভুক্তভোগীদের জন্য ‘সাপোর্ট সার্ভিসের’ ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশকে পুনর্বিন্যাস করে নারীবান্ধব করতে হবে।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন গবেষণা প্রকল্পের সমন্বয়ক নূরুননবী শান্ত। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রধান নির্বাহী আইনজীবী মো.
মো. সাইদুর রহমান বলেন, আগের যেকোনো গণ–অভ্যুত্থান থেকে এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। শহীদ ৮৮১ জনের মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের স্বজনেরা মামলা করেছেন। স্বজনেরা জানিয়েছেন, আগের অসংগতি এবং সমস্যাগুলো এখনো বিরাজমান রয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স বজন র র ঘটন আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
পরবর্তী সরকারের পক্ষে এত সহজে সংস্কার আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না: আসিফ নজরুল
বাংলাদেশে পরবর্তী সরকারের পক্ষে এত সহজে সংস্কার আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। নিজের এই ধারণার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘কারণ, এত কষ্ট, এত ত্যাগ কখনোই বাংলাদেশের মানুষ কোনো সংস্কারের জন্য বা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য করে নাই।’
আজ বুধবার বিকেলে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন আইন উপদেষ্টা। সহকারী অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশের প্রাথমিক খসড়ার ওপর মতবিনিময় সভার আয়োজন করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
‘আমরা অনেক ধরনের সুযোগ পেয়েছি, কোনো সুযোগেরই আমরা সদ্ব্যবহার করতে পারি নাই’ মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘এইবার আমার মনে হয় এত ত্যাগ, এত রক্তক্ষয়ের পর এবার যে আমাদের রাষ্ট্র মেরামতের সুযোগ এসেছে, আমাদের যে একটু সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যে সুযোগ এসেছে, এবার যদি আমরা সেই সুযোগটা মিস করি...আমার মনে হয় আগামী কয়েক দশকে আমরা এই সুযোগ পাব না। কাজেই এই সুযোগ আমাদের কোনোভাবেই মিস করা চলবে না।’
মতবিনিময় সভায় সহকারী অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশের প্রাথমিক খসড়ার ওপর আলোচনায় অংশ নেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। এ সময় খসড়াটির নানা সংকট ও করণীয় বিষয়ে তুলে ধরা হয়। তার জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা আরও কনসাল্টেশন (পরামর্শ) করব। আরও মতামত দেব। আমি খুবই খুশি হয়েছি আমাদের এই আইনটাকে একদম তুলাধোনা করে দেওয়া হয়েছে। এটা ভালো হয়েছে। আমাদের জন্য একটা ইনসেন্টিভ তৈরি হয়েছে। আমরা আরও ভালো করার চেষ্টা করব।’
খসড়াটি চূড়ান্ত করতে আরও পরামর্শ নেওয়া হবে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘একটা খুব ভালো সাজেশন আসছে পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে কনসাল্টেশন। এটা পলিটিক্যাল পার্টির জন্য খুবই রেলেভান্ট (প্রাসঙ্গিক), অবশ্যই করব। আপনাদের সবার সহযোগিতায় ইনশা আল্লাহ আমরা একটা ভালো আইন করতে পারব এবং আমাদের প্রত্যাশা আছে এই সরকারের আমলে অন্তত কিছু নিয়োগ যদি আমরা অ্যাটর্নি সার্ভিসে দিয়ে দিতে পারি—সে চেষ্টা করব।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘সব সময় শুনতাম যে নিম্ন আদালতে বা উচ্চ আদালতে যে দুর্নীতি হয় বা অনিয়ম হয় এখানে অনেক পক্ষ থাকে। শুধু যে আপনার সাপোর্ট স্টাফরা বা জাজরা করে, সেটা না। এক শ্রেণির আইনজীবীরা, সরকারি আইনজীবীদেরও ভূমিকা থাকে। আমি কিছু রিসার্চ করেও শুনেছি যে অল্প, অত্যন্ত অল্প টাকা পান উনারা। বিশেষ করে যাঁরা পাবলিক প্রসিকিউটর অফিসে আসেন, তারপরও এটা হওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ থাকে সবার। কারণ, এমন অভিযোগ শুনেছি, এগেইন বলছি অভিযোগ অন্যভাবে নিয়েন না। সরকারি উকিল হয়ে উনারা দেখা যায়, প্রতিপক্ষের পক্ষে কাজ করে টাকা নেন এরকম কিছু উদাহরণ আছে। সবাই না। অনেকে তো আছেন, অনেক ভালো প্র্যাকটিস করেছেন বা করছেন।’
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল প্রসিকিউটোরিল অ্যাসিস্ট্যান্ট এহসানুল হক সমাজী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল, আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন, আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, বিজিবির পাবলিক প্রসিকিউটর মো. বোরহান উদ্দিন, জেলা ও দায়রা জজ আদালত ঢাকার পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ইকবাল হোসেন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহের প্রমুখ।