ভারতে ১৪০ কোটি মানুষের মাত্র ১০ শতাংশের ইচ্ছামতো খরচ করার সামর্থ্য আছে: প্রতিবেদনে তথ্য
Published: 28th, February 2025 GMT
ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। কিন্তু মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের কাছে নিজের ইচ্ছামতো খরচ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে বলে ‘ব্লুম ভেঞ্চারস’ নামের একটি অর্থ সহায়তাকারী সংস্থা জানিয়েছে। অর্থাৎ বাড়তি পণ্য বা পরিষেবা কেনার ক্ষমতা ওই ১৩ বা ১৪ কোটি মানুষের কাছে রয়েছে, বাকি প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের সেই ক্ষমতা নেই।
ব্লুম ভেঞ্চারস একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থা, যারা নতুন ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। তারা তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ভারত সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছে।
ব্লুম ভেঞ্চারস বলেছে, ওই শীর্ষ ১০ শতাংশই তাদের ক্রয়ক্ষমতার মাধ্যমে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বাজার ও বিক্রিকে সচল রাখছে। কিন্তু এই ১০ শতাংশ ক্রমশ বাড়ছে না, অর্থাৎ আরও বেশি মানুষের সম্পদ বাড়ছে না। বরং এই ১০ শতাংশেরই শুধু অর্থ ও সম্পদ ক্রমশ বাড়ছে, অর্থাৎ ধনী আরও ধনী হচ্ছে।
তবে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতে আরও ৩০ কোটি মানুষের একটা শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, যাদের কনজিউমার বা উপভোক্তা বলা যেতে পারে। এরা সবেমাত্র খরচ করতে শুরু করেছে। তবে হয়তো এর অন্যতম কারণ এটা নয় যে তাঁদের আয়রোজগার বেড়েছে। কিন্তু খরচ করার নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে, যা হলো ইউপিআই বা ‘ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস’, অর্থাৎ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ আদানপ্রদান করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থা তাদের বিক্রয় কৌশলে পরিবর্তন আনছে। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো ক্রমশ আরও বেশি দামি পণ্য বাজারে আনছে। কারণ, তারা বুঝতে পারছে, ভারতের ধনী আরও সম্পদশালী হচ্ছে। অর্থাৎ যাঁর একটি গাড়ি আছে, তিনি আরও গাড়ি কিনতে চাইছেন বা বিদেশি গাড়ি কিনতে চাইছেন।
ব্লুম ভেঞ্চারসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ কারণে অত্যধিক দামি বাসস্থান বা প্রবল দামি ফোনের বিক্রয় ও ব্যবহার ভারতে বাড়ছে।
অন্যদিকে কম দামের পণ্যের বিক্রয় সেই হারে বাড়ছে না। অর্থাৎ যিনি সস্তার ফোন বা পণ্য কেনেন, তিনি দ্বিতীয় ফোন বা জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাইরে বাড়তি আর কিছুই কিনতে পারছেন না।
প্রতিবেদনে উদ্ধৃত তথ্য অনুসারে, শীর্ষ ১০ শতাংশ ভারতীয় এখন জাতীয় আয়ের ৫৭ দশমিক ৭ শতাংশের অধিকারী, যা ১৯৯০ সালের ৩৪ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ বিশ্বে ভারতই প্রথম, যেখানে ১০ শতাংশের সম্পদ ৩৫ বছরে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
জনসংখ্যার নিচের দিকের মানুষের সম্পদ ২২ দশমিক ২ থেকে কমে ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, অর্থাৎ মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের সম্পদ এ সময়ে কমে গিয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, ভারতের জিডিপি কনজিউমারদের খরচ করার ক্ষমতার ওপরে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ফলে আয়ের সুষম বণ্টনব্যবস্থার উন্নতি না হলে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমানভাবে শুধু উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর জন্য পণ্য বানাবে এবং পরিষেবা দেবে। ফলে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক থেকে আরও প্রান্তিক হয়ে পড়বে।
অতীতে একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ভারতের ভবিষ্যতের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করলেও এই প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় আর্থিক সংস্থা দেশে ধনী ও দরিদ্রের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিপদ নিয়ে সচেতন করল।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’