নানা রকম ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন রাত নয়টায় পর্দা নামল মাসব্যাপী আয়োজিত বইমেলার। ছুটির দিনে মেলার শেষ প্রহরে ছিল যথেষ্ট ভিড়। শেষ দিনে বই বেচাকেনা ছিল মোটামুটি। এবারের মেলার প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উদ্বোধন করেছিলেন অমর একুশে বইমেলা ২০২৫–এর। বরাবরের মতো ভাষার মাসের পুরোটা সময় দেশের সৃজনশীল প্রকাশনাগুলোর অংশগ্রহণে আয়োজিত হলো এ মেলা। এবারের মেলায় বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অংশ নিয়েছিল ৭০৮টি প্রতিষ্ঠান। বরাদ্দ হয়েছিল ১ হাজার ৮৪ ইউনিটের স্টল। গত বছরের চেয়ে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হলেও আক্ষেপ নিয়েই শেষ হলো এবারের বইমেলা। অধিকাংশ প্রকাশক বলেন, প্রত্যাশার ধারেকাছে বিক্রি হয়নি বই। প্রতিদিনের এত মানুষের ভিড়ে পাঠক ছিল কম। আবার কেউ কেউ প্রত্যাশা করছেন এই ভিড় থেকেই তৈরি হবে নতুন পাঠক।
গতকাল মেলার শেষ বেলায় ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন খান জানান, এবার তাঁরা নতুন বই এনেছেন ২৭০টি। বিক্রি ভালো বলে জানান তিনি। ভালো বিক্রির কথা বললেন নওরোজ কিতাবস্তানের বিক্রয়কর্মী হামিদুল খানও। ৩৫টি নতুন বই নিয়ে বেঙ্গল বুকসেরও বিক্রি ভালোর কথা জানান গতকাল স্টলে উপস্থিত তৌহিদ ইমাম নামের এই প্রকাশনীর একজন কর্মকর্তা। তবে অন্য প্রকাশকদের মতামত একেবারেই বিপরীত। আগামী প্রকাশনীর এবার নতুন বই ৮০টি। আগামীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি বলেন, করোনাকালের চেয়েও খারাপভাবে হলো মেলা। এটি যে শুধু ঐতিহ্য তা নয়, প্রকাশনাশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার মেলা, সেই কথা খেয়াল রাখা প্রয়োজন আয়োজকদের। তিনি বলেন, আক্ষেপ নিয়েই শেষ হলো মেলা। তবে আশার কথা, এর মধ্যেও নূরুল ইসলামের গান্ধী-জিন্নাহর রাজনীতি: ভারত-ভাগ–এর মতো ওজনদার বইটি ভালো বিক্রি হয়েছে।
অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক ছিল, কিন্তু পাঠকের সংখ্যা কম। এর মধ্যে থেকে নতুন পাঠক তৈরির আশা করি।’ কথাসাহিত্যিক আফসানা বেগম বলেন, মূলধারার সাহিত্য থেকে বইমেলা দূরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে।
শেষ কয়েক দিন বিক্রি ভালো হলেও তা গতবারের মতো নয় বলে জানান প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন।
অমর একুশে বইমেলার শেষ দিনে ছিল বইপ্রেমীদের ভিড়। এরই মধ্যে একটি পরিবার শিশুদের নিয়ে বই দেখছে। গতকাল বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘লিচুর বাগানে’ যে কারণে ‘পিরিতের বেড়া’ দিতে হয়
‘তাণ্ডব’ সিনেমার গান ‘লিচুর বাগানে’ প্রকাশের পর রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। কফি শফ থেকে বাস, মেট্রোরেল আশপাশে কান পাতলে গানটা শোনা যাচ্ছে। কেউ না কেউ শুনছেন। সামাজিক মাধ্যমের স্টোরি ও রিলসেও গানটি ভেসে বেড়াচ্ছে। চরকি ও এসভিএফের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত গানটির আজ পর্যন্ত (১২ এপ্রিল ২০২৫) ভিউ হয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিয়ন ও ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন।
উচ্ছ্বসিত অনেক দর্শক গানটি নিয়ে মন্তব্যও করেছেন। তাহসিন নামের এক শ্রোতা লিখেছেন, ‘গানটির প্রতিটি সুর, দৃশ্য ও পরিবেশনায় বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব রূপ ফুটে উঠেছে। যাত্রাপালার ফিল্মের আবহে তৈরি এই গানটি যেন গ্রামীণ বাংলার প্রাণস্পন্দন তুলে ধরেছে। লোকেশন থেকে শুরু করে কস্টিউম, প্রতিটি ডিটেইলে আছে নিখুঁত যত্ন।’
গানটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটিও চলছে। বন্ধুকে মেনশন দিয়ে কেউ যেমন প্রশ্ন করছেন, ‘কী রে, বেড়া ডিঙাতে পারলি?’ আবার কেউ জিজ্ঞেস করছেন বল তো, ‘“লিচুর বাগানে” কেন “পিরিতের বেড়া” দিতে হয়?’
প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। শুরুতেই ‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, ‘কে এই ছত্তার পাগলা’ শীর্ষক প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। গবেষক সরোজ মোস্তফার মতে ‘কে দিল পিরিতের বেড়া লিচুরও বাগানে’ পঙ্ক্তির রচয়িতা ও সুরকার ছত্তার পাগলা। তবে সংগীতগবেষক গৌতম কে শুভর মত ভিন্ন। তাঁর মতে, ‘এটি মূলত প্রচলিত ঘেটু গান। “কে দিল পিরিতির বেড়া লিচুর বাগানে?” অংশটি মূল গানের অংশ। ছত্তার পাগলা নিজের মতো করে এর সঙ্গে কথা সংযোজন করেছেন। নেত্রকোনায় ছত্তার পাগলার লেখা রূপটিই বিখ্যাত হয়েছে।’ ২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন ছত্তার পাগলা। জীবদ্দশায় রচনা ও সুরারোপ করেছেন কয়েক শ গান। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে গানটি শুনে হাতে লিখে রেখেছিলেন আল মামুন চৌধুরী।
আল মামুন চৌধুরীর লেখা অনুযায়ী গানটির কথা:
কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে
লিচুরও বাগানে গো সই…লিচুরও বাগানে …(ঐ)
পাখি খাইছ না লিচু, বন্দে খাইবো
বন্দে লিচু খাইয়া, খুশি হইবো
আমার কাছে আইসা কইবো
কত শান্তি দিবো আমার মনেপ্রাণে (ঐ)
ছোট ছোট লিচুগুলি, বন্দে তুলে আম্বো তুলি
বন্দে দেয় গো আমার মুখে,
আমি দিতে চাই বন্ধুর মুখের পানে…(ঐ)
মিষ্টি লিচু খাইয়া বন্দে, বাঁশি বাজায় মন আনন্দে
আমার মনে লাগে সন্দে বন্ধু সম্ভব জাদু জানে (ঐ)
বাঁশি হাতে পলায় মালা, তারে চায় ছত্তার পাগলা,
করব লইয়া উলামেলা, (২) প্রাণবন্ধুর সনে…(ঐ)
সরল অর্থে ‘বেড়া’ হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা তথা বাধা তৈরির উপকরণ। আর ‘পিরিতের বেড়া’ মানে ভালোবাসায় বাধা। কিন্তু ভালোবাসার এই বাধা তথা প্রতিবন্ধকতা ‘লিচুর বাগানে’ কেন? কবিতা তথা গানে অর্থের তারতম্য অর্থের অনুগত না হয়ে বোধ কিংবা ভাবনার পরবশে প্রস্ফুটিত হয়। ব্যক্তিবিশেষে তা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ লাভ করে, ভিন্ন ভিন্ন মূল্য পায়।
আরও পড়ুন‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, কে এই ছত্তার পাগলা ০৬ জুন ২০২৫‘কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে’ একটি ‘ঘাটু গান’ বা ‘ঘেটু গান’। এই গান প্রসঙ্গে জানা যায়, এই গানের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নৃত্য। অল্প বয়সী একটি ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার নৃত্যের মধ্য দিয়ে ঘেটু গান পরিবেশিত হতো। সঙ্গে থাকত ঢোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। কয়েকটি ‘ঘেটু গানে’র দৃষ্টান্ত দেখা যাক।
(১)
‘তুই আমারে চিনলে নারে
আমি তো রসের কমলা।
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি
মধ্যে নলের বেড়া।’
(২)
ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু
পান খাইলায়না
এক বালিশে দুইটি মাথা
সুন্দর কইরা কওরে কথা।
গানগুলো থেকে উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না যে ‘ঘেটু গানে’ যেমন ভাষার সারল্য আছে, তেমনিভাবে রূপকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যাপিত জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা নানা উপকরণ। আর এ ক্ষেত্রে গান রচনার সময় রচয়িতা তাঁর আশপাশ থেকেই গান নির্মাণের উপকরণগুলো যে নিয়ে থাকবেন, সেই ধারণাও পাওয়া যায়। ‘লিচুর বাগানে’ গানের ক্ষেত্রেও বোধ করি এটা ঘটেছে। তাই এই গানে যেমন ‘লিচু বাগানে’র কথা আছে, একইভাবে আছে ‘পাখি’, ‘বাঁশি’ ও ‘লিচু’র কথাও। পাখিকে লিচু না খাওয়ার অনুরোধ করলেও পাখি যেন খেতে না পারে সে কারণেই যে বেড়া দেওয়া হয়েছে; সেই ব্যথাও গানটিতে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে ‘লিচুর বাগান’ শেষ পর্যন্ত ‘লিচুর বাগানে’ সীমাবদ্ধ থাকেনি। হয়ে উঠেছে ভালোবাসার প্রতীক।
কথায় আছে, ভালোবাসা জয় করে নিতে হয়। জিতে নেওয়ার মধ্যেই আছে অপার আনন্দ। ভালোবাসায় প্রতিবন্ধকতা থাকাটা মোটেও দোষের নয়। বরং বাধা না থাকাটাই যেন আশ্চর্যের। একইভাবে ভালোবাসা জিতে নেওয়ার পরও পেয়ে গেছি বলে হাল ছেড়ে দিলে চলে না। ‘লিচুর বাগান’কে এ ক্ষেত্রে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করলে, ‘লিচুর বাগানে’ ‘পিরিতের বেড়া’ তথা ভালোবাসার বেষ্টনী দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কেননা ‘ভালোবাসা’কে ভালোবাসা দিয়েই আগলে রাখতে হয়। প্রবল যত্নে আঁকড়ে রাখতে হয়। যেন কোনো কৌতূহলেই তা দুলে না ওঠে, হারিয়ে না যায়।
আরও পড়ুনসাবিলা তো ‘লিচুর বাগানে’ দিয়ে কী যে আগুন লাগিয়ে দিল...০৫ জুন ২০২৫