ভোজ্যতেল নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছেই
Published: 2nd, March 2025 GMT
রমজানে লেবু, বেগুনসহ কয়েকটি পণ্যের দরে অস্বস্তি। সঙ্গে ভোজ্যতেল নিয়ে শুরু হওয়া ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলতে থাকায় বিপাকে ভোক্তারা। তাদের অভিযোগ, সরকারের দুর্বল তদারকির কারণে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, অন্য সময়ের তুলনায় এবার রমজানে বেশির ভাগ পণ্যের দাম নাগালে রয়েছে।
গতকাল রোববার প্রথম রোজায় রাজধানীর হাতিরপুল, কারওয়ান বাজার, তেজকুনিপাড়াসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে মুদি ও ইফতার সামগ্রীর দোকানে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। কেনাকাটা করতে আসা মানুষ কিছু পণ্যের সংকট ও দাম নিয়ে বিরক্ত বলে জানান।
বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়ায়নি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। গত দুই-তিন মাস পণ্যটি নিয়ে লুকোচুরি করছেন খুচরা, পাইকারি থেকে পরিশোধন কোম্পানিগুলো। বাজারে বোতলজাত তেল নিয়ে চলছে ইঁদুর বিড়াল খেলা। বেশির ভাগ দোকানে নেই পাঁচ লিটার বোতলের সয়াবিন তেল। অনেকে লুকিয়ে রেখে ৮৫২ টাকার বোতল ছাড়ছেন ৮৭০-৮৮০ টাকায়। এক, দুই লিটারের বোতলও খুব কম। সংকটে চড়েছে খোলা সয়াবিন তেলের দাম। ১৫৭ টাকার খোলা সয়াবিন কিনতে হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায়। ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে দায় সারলেও, বাড়ছে না সরবরাহ।
গতকাল হাতিরপুল বাজারে তেল কিনতে গলদঘর্ম বেসরকারি চাকরিজীবী শাহ আলম জানান, পাঁচ দোকান ঘুরেও বোতলের তেল পাননি। বাধ্য হয়ে বেশি দামে খোলা সয়াবিন তেল কিনেছেন। সরকারই বদলেছে, বাজার অসাধু চক্রেই জিম্মি রয়েছে। তদারকি না বাড়ালে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবেন। মানুষ অতিষ্ঠ হবে, মনে করেন তিনি।
এক মাস ধরে মানভেদে ছোলা ১০৫-১২০ ও চিনির কেজি ১১৮-১২০ টাকা। গত রোজায় চিনির কেজি ঠেকেছিল ১৪০-১৫০ টাকায়। রাজধানীর পান্থপথের রয়েল বেঙ্গল ইফতারি বাজারের বিক্রয়কর্মী আবু তাহের বললেন, রোজায় আমরা শাহি ৪৫০ ও বোম্বে জিলাপি ৩০০ টাকা বিক্রি করছি। গত রোজায় ছিল ৫০০ ও ৪০০ টাকা।
বাজারে বেড়েছে তরমুজের সরবরাহ। প্রথম রোজায় বেচাকেনাও ভালো। কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬৫ টাকায়। পাকা পেঁপের দর বাড়তি, কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৯০ টাকায়।
বাজারে প্রচুর বেগুন রয়েছে। মানভেদে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়। এক সপ্তাহ ব্যবধানে বেগুন কেজিতে ২০-৩০ টাকা বাড়লেও গত রোজার তুলনায় কম। গেলবার ১০০ থেকে ১২০ টাকায় চড়েছিল বেগুন। এবার আলু কেনা যাচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়, যা গতবার ছিল ৩০ টাকার ওপরে।
অবশ্য কম দামের প্রভাব পড়েনি ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ বানিয়ে ফেলা চপ ও বেগুনিতে। কারওয়ান বাজারের ইফতারি ব্যবসায়ী খালেক মিয়া জানান, কয়েক বছর ধরেই আলুর চপ ও বেগুনির পিস ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করছেন তারা। দাম কম না রেখে তারা গতবারের তুলনায় আকার বড় করছেন বলে জানান।
বেগুনের মতো বাজারে ভরপুর শসা দেখা গেছে। তবে কোনো কোনো এলাকায় অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে শসার দাম। কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি হাইব্রিড শসা ৪০ থেকে ৫০ এবং দেশি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাস দুয়েক আগে ছোট আকারের লেবুর ডজন ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এখন হালিই বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকার আশপাশে। আর মাঝারি আকারের জন্য গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এ মানের লেবু কেনা গেছে ৪০-৫০ টাকা হালি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজায় শরবতের চাহিদা বেশি। সরবরাহ কম থাকায় লেবুর দাম বেড়েছে। তেজকুনিপাড়ার ব্যবসায়ী মহিন সরকার বলেন, এখন লেবুর মৌসুম নয়। রমজানে প্রায় সবাই লেবু কেনেন। এরই প্রভাব পড়েছে বাজারে।
গত রোজায় পেঁয়াজের কেজি ১১০ থেকে ১৩০ টাকায় উঠেছিল। এবার কেনা যাচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। অন্যান্য পণ্যের দরও অনেকটা স্বাভাবিক। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান গতকাল কারওয়ান বাজার ও নিউমার্কেট পরিদর্শন করেন। তদারকি শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রমজানে কিছু পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবেই বাড়বে। এগুলোর মৌসুম নয়। আবার ভোক্তাদের কেউ কেউ প্রয়োজনের বেশি কেনাকাটা করেন, যার প্রভাব বাজারে পড়ে। এর পরও এবার বেশির ভাগ পণ্যের দাম নাগালে রয়েছে।
ভোজ্যতেলের সংকট নিয়ে তিনি বলেন, ‘২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত তেল সরবরাহের আশ্বাস দিলেও কথা রাখেনি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি হচ্ছে।’ৎ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক রওয় ন ব জ র ভ জ যত ল ব যবস য় সরবর হ গত র জ রমজ ন ইফত র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।