বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা পাওয়া ব্যক্তিকে তাঁর পকেট থেকে ৭৩ শতাংশ ব্যয় করতে হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় যা সর্বোচ্চ। ফলে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে অনেকের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। এর মূল কারণ হলো রোগীর অবস্থা একটু জটিল হলেই তাঁকে ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যবধানটা অনেক বেশি। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলেই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, চিকিৎসাসেবাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও কিংবা চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য আধুনিক সরঞ্জাম কেনা হলেও চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলসংকটে সেগুলো ঠিকমতো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একদিকে দামি চিকিৎসা সরঞ্জাম এমনি এমনি পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে রোগীরা কম খরচে উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই অপরিকল্পিত চিত্রের একেবারে জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, আধুনিক এই সরকারি হাসপাতালে চিকিত্সক ও দক্ষ জনবলের অভাবে এখনো কয়েকটি বিভাগে যন্ত্রপাতি সচল করা সম্ভব হয়নি। অথচ হাসপাতালটির বহির্বিভাগে গড়ে ২ হাজার ৫০০ জন ও অন্তর্বিভাগে ৫৫০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন।
৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে ৪টি উন্নত আইসিইউ শয্যা, ভেঙে যাওয়া হাত-পায়ে কৃত্রিমভাবে অস্ত্রোপচার করে রড সংযোজনের জন্য রয়েছে আধুনিক সিআরএম যন্ত্র, চোখের চিকিৎসার জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাসিকস যন্ত্র। অথচ এগুলো চালানোর মতো লোকবল নেই। হাসপাতালটিতে সাত কোটি টাকা দামের সিটি স্ক্যান যন্ত্র সচল রাখা হয়েছে অন্য বিভাগ থেকে জনবল ধার করে এনে।
কোভিড মহামারি ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময় আমরা দেখেছি সংকটাপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচাতে আইসিইউ বেড কতটা দরকারি। একটা আইসিইউ বেডের জন্য মানুষের হাহাকার, আর্তির কথা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই বিস্মৃত হননি। প্রশ্ন হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার পরও কেন ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলো পুরোদমে চালু করা যাবে না?
এম মনসুর আলী হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পাশাপাশি ৫০ শতাংশ চিকিৎসক ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এ বিপুল জনবল ঘাটতি নিয়ে একটা হাসপাতাল ঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। হাসপাতালটিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিন। সবকিছু থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যয় বাড়ল ১৪৪ কোটি টাকা
‘খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ’ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০১১ সালে। ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। এর পর আটবার প্রকল্পের সময় বেড়েছে, দুই দফা সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। এ অবস্থায় প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়ে হতাশা দেখা দেয়।
আশার কথা, নতুন জেলা কারাগারের কাজ শেষ হয়েছে। গত ২৫ মে গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে নতুন কারাগারটি বুঝে নেওয়ার কথা ছিল কারা কর্তৃপক্ষের। কিছু কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় হস্তান্তর হয়নি। চলতি জুন মাসে যে কোনো সময় নতুন কারাগার হস্তান্তরের কথা রয়েছে। জনবল পদায়ন হলেই নতুন কারাগারে বন্দি স্থানান্তর শুরু হবে।
১৯১২ সালে নগরীর ভৈরব নদীতীরে নির্মাণ করা হয় খুলনার প্রথম কারাগার। সেখানে বন্দি ধারণক্ষমতা ৬৭৮ জনের। রয়েছেন ১ হাজার ৪শর বেশি বন্দি। ১১৩ বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনে ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয় তাদের। এসব বিবেচনায় নিয়েই নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
খুলনার সিটি (রূপসা সেতু) বাইপাস সড়কের জয় বাংলা মোড়ের অদূরে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর নতুন কারাগার নির্মাণ হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নতুন কারাগারে ৪ হাজার বন্দি থাকতে পারবেন। প্রকল্পের আওতায় আপাতত ২ হাজার বন্দি রাখার অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। পরে প্রয়োজন পড়লে পৃথক প্রকল্প নিয়ে অন্য অবকাঠামো নির্মাণ হবে।
নতুন কারাগার হবে সংশোধনাগার
কারাগার ঘুরে দেখা গেছে, ভেতরে সাজানো-গোছানো অভিজাত আবাসিক এলাকার মতো পরিবেশ। রং দেওয়া নতুন ভবন, পথের ধারে
ফুল, দামি পার্কিং টাইলস দেওয়া ফুটপাত ধরে হাঁটলে এটি কারাগারই মনে হয় না। নতুন এ কারাগার নির্মাণ হচ্ছে সংশোধনাগার হিসেবে। এখানে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের পৃথক স্থানে রাখা হবে। কিশোর ও কিশোরী বন্দিদের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যারাক। নারীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল, মোটিভেশন সেন্টার ও ওয়ার্কশেড আছে। একইভাবে বন্দিদের জন্য ৫০ শয্যার হাসপাতাল থাকবে।
আরও থাকবে কারারক্ষীদের সন্তানদের জন্য স্কুল, বিশাল লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম, আধুনিক স্যালুন ও লন্ড্রি। কারাগারে শিশুসন্তানসহ নারী বন্দিদের জন্য থাকবে পৃথক ওয়ার্ড ও ডে-কেয়ার সেন্টার। এ ওয়ার্ডটিতে সাধারণ নারী বন্দি থাকতে পারবেন না। সেখানে শিশুদের জন্য লেখাপড়া, খেলাধুলা, বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা থাকবে। কারাগারে পুরুষ ও নারী বন্দিদের হস্তশিল্পের কাজের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্কশেড, বিনোদন কেন্দ্র ও নামাজের ঘর রয়েছে। মোট ৫২টি স্থাপনা রয়েছে এ কারাগারে।
গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম জানান, বন্দিদের প্রতিটি ব্যারাকের চারপাশে পৃথক সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। এক শ্রেণির বন্দিদের অন্য শ্রেণির বন্দিদের সঙ্গে মেশার
সুযোগ নেই। কারাগারের ভেতরে শুধু সীমানাপ্রাচীরই রয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। ভেতরে ড্রেন, ফুটপাত, নিজস্ব পয়োবর্জ্য শোধন কেন্দ্র, ওয়াকওয়ে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, দুটি পুকুর ও সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সবকিছুর কাজ শেষ।
সময় বেড়েছে আটবার, ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ
২০১১ সালের অনুমোদিত খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৪৪ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ৬ জুন প্রকল্পটি প্রথম দফা সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫১ কোটি টাকা। নতুন লক্ষ্য নেওয়া হয় ২০১৯ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার। এর পর পাঁচ দফায় পাঁচ বছর সময় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কাজ আর শেষ হয়নি। ২০২৩ সালের মে মাসে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৮ কোটি টাকায়।
হস্তান্তর ও চালু কবে
খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নতুন কারাগারের সব কাজ শেষ। কয়েকটি স্থাপনায় রঙের শেষ প্রলেপসহ টুকটাক কাজ বাকি রয়েছে। আগে করলে এসব নষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণে হস্তান্তর তারিখ নির্ধারণ হলেই এসব কাজ করা হবে।
খুলনার জেল সুপার নাসির উদ্দিন প্রধান বলেন, কিছু কাজ বাকি ছিল, সেগুলো শেষ করতে বলা হয়েছে। সব ঠিক থাকলে চলতি জুন মাসেই আমরা কারাগার বুঝে নেব। তিনি আরও বলেন, কারাগার পরিচালনার জন্য ৬০০ জনবলের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে পুরোনো কারাগারে প্রায় ২০০ জনবল রয়েছে। স্থাপনা বুঝে নেওয়ার পর কারাগার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।