পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা বেহাল
Published: 2nd, March 2025 GMT
মা, শিশু ও প্রসূতিসেবায় সাফল্য দেখিয়ে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২০১২ ও ১৩ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে এবং ২০১৪ সালে জাতীয় পুরস্কার ও সনদ পায়। সেই প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা এখন বেহাল। চিকিৎসকসহ জনবল সংকটের কারণে উপজেলায় সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া একমাত্র প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসা নিতে এসে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
উপজেলায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প ও ইপিজেডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শত শত বিদেশি নাগরিক কর্মরত। প্রায়ই তাদের অনেকে চিকিৎসাসেবা নিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। কিন্তু চিকিৎসক সংকটের কারণে তাদেরও সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে তাদের কিছু করার নেই।
জরুরি চিকিৎসা নিতে এসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন রোগী ফাতেমা খাতুন। তিনি জানান, দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। বাধ্য হয়ে অন্যত্র চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এক রোগীর স্বজন রাইদুল ইসলামের ভাষ্য, রোগীর প্রয়োজনে নার্সদের ডেকে পাওয়া যায় না। তাদের আচরণও ভালো নয়। রোগীদের দেওয়া খাবার নিম্নমানের।
জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিসিন, গাইনি, কার্ডিওলজি, নাক-কান-গলার কনসালট্যান্টসহ ১১ পদের বিপরীতে দু’জন কনসালট্যান্ট আছেন। চিকিৎসা কর্মকর্তার ১৫ পদের স্থলে আছেন মাত্র আটজন। ২৮ পদের মধ্যে বর্তমানে ১২ জন চিকিৎসক রয়েছেন। নার্স ২৬ জন থাকার কথা থাকলেও আছেন ২২ জন। তাদের বিরুদ্ধেও রোগীর স্বাস্থ্যসেবা দিতে ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীও নেই। এতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না। বহির্বিভাগে দিনে অন্তত ৫০০ রোগী সেবা নেন। ভর্তি থাকছেন ৬০ থেকে ৭০ জন। তাদের সেবা দিচ্ছেন মাত্র ১২ জন চিকিৎসক। চাপ সামলাতে নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারীদেরও হিমশিম খেতে হয়।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ নাজনীন আফরোজ এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, জনবল সংকটে আমরাও সমস্যায় আছি। রূপপুর প্রকল্প, ইপিজেডসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার কারণে প্রচুর রোগীর চাপ থাকে। তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসকের প্রতিদিন নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাগজে ৫০ শয্যার হলেও ২৭ শয্যার জনবল দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম। রোগী এলেই পাঠানো হয় (রেফার) পাবনা, রাজশাহী বা ঢাকায়। এসব সংকটের পাশাপাশি পুকুরের টেন্ডার, মসজিদের কমিটি, অ্যাম্বুলেন্সের গ্যারেজসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্সচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স দরকার হলে আমাদের ডাক পড়ে। কিন্তু আমাদের হাসপাতাল চত্বরে প্রবেশে নিষেধ করা হয়েছে। এখন ডাকলেও আমাদের রোগী পর্যন্ত যেতে দেরি হয়। এতে ভোগান্তি বেড়েছে। আর মসজিদের মুসল্লি শহীদুল ইসলামের ভাষ্য, মসজিদের কমিটি কর্তৃপক্ষ তাদের পছন্দমতো ব্যক্তি নিয়ে করেছেন।
বরাদ্দের খাবারসহ কেনাকাটা ও সেবার মান নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে রোগী ও স্বজনদের। অভিযোগ উঠেছে, পুকুরের টেন্ডার ও মসজিদে মুসল্লিদের মতামত উপেক্ষা করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের নানান সংকটে জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত ঈশ্বরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ভাষ্য, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সব জানেন। আর আরএমও দায় চাপান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ওপর।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আলী এহসান বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বাইরের অ্যাম্বুলেন্সের গ্যারেজ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন তারা। মসজিদের কমিটিতে অভ্যন্তরে বসবাসকারীদের ছাড়া বাইরের কাউকে রাখা হয়নি।’ অন্যান্য বিষয়ে আরএমওর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
আরএমও মো.
রোগীর চাপ যে হারে বাড়ছে, তাতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০০ শয্যার না করা গেলে সমস্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবীর কুমার দাশ। তিনি বলেন, বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক, কনসালট্যান্ট, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর যেসব পদ শূন্য রয়েছে, সেগুলো পূরণ করা দরকার। এতে সেবার মান বাড়বে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স স ব স থ য কর মকর ত র স ব স থ য কমপ ল ক স মসজ দ র চ ক ৎসক উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
আধুনিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত খাত হলো আউটসোর্সিং। এ খাতের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ এই শ্রমিকদের অধিকাংশই শোভন কাজের মৌলিক মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত। চাকরির স্থায়িত্ব নেই; সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই; নেই সংগঠনের অধিকার– এমন বাস্তবতায় শ্রমিকরা এক অনিশ্চিত ও অনুৎপাদনশীল পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন।
এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক-অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প-সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কাজের স্বীকৃতি, অধিকার, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আউটসোর্সিং খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তৎপরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে সরকারের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ১২৫০টি ঠিকাদারি সংস্থা জনবল সরবরাহ করছে। এর বাইরেও অগণিত অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা, মজুরি, ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার।
অধিকাংশ আউটসোর্সিং শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পান না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নির্ধারিত মজুরি না দিয়ে বেতন থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রাখে; উৎসব ভাতা দেয় না; ওভারটাইমের ভাতা দেয় না। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আউটসোর্সিং নীতিমালায় উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়, তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি এখনও দুর্বল।
নীতিমালায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত কোনো অর্থনৈতিক সুরক্ষা না থাকায় তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলেই চাকরিচ্যুতির শঙ্কা থাকে। বেসরকারি খাতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। নতুন নীতিমালায় ৪৫ দিনের প্রসূতিকালীন ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান শ্রম আইনের ১১২ দিনের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথ রুদ্ধ। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। করলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন। ফলে শ্রমিকস্বার্থে কোনো সামাজিক সংলাপ বা দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।
বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, নিরাপত্তা খাতে কর্মরত হাজার হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। করোনা মহামারিতে তারা সম্মুখ সারিতে থেকেও কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। শ্রম বিধিমালার ১৬(৩) অনুযায়ী মালিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল।
সে জন্য শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এ খাতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা আসবে। আউটসোর্সিং খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোভন কাজ, মৌলিক অধিকার এবং কর্মস্থলে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমি মনে করি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, করপোরেশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে আইনের ধারা ও বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার। ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। যারা ৫-১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে কর্মরত থেকে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মূল মালিককে দায়বদ্ধ করা দরকার।
শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কাজ করতে রাজি না হলে তাদের চাকরিচ্যুত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এ বিষয়ে শ্রম পরিদর্শন দপ্তর কঠোর নজরদারি করবে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে। যেসব দপ্তর ও সেবা খাতে ইতোমধ্যে আউটসোর্সিং করা হয়েছে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা একটাই– শোভন কাজের বাস্তবায়ন। এ খাতের বৈষম্য কমাতে হলে সরকারের নীতিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে সমাজকেও সচেতন হতে হবে, যাতে মানুষ সস্তা সেবার পেছনে শ্রমের শোষণকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
মো. মাছুম বিল্লাহ: আইন কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর