রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে আরও পিছিয়ে যাচ্ছে উৎপাদন
Published: 7th, March 2025 GMT
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের সঞ্চালন লাইন আগামী এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার আশা করছে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি। লাইনটি চালু করার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে অন্তত দুই মাস সময় লাগতে পারে রূপপুরে। জুলাইয়ে শুরু হতে পারে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন। এরপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হতে পারে আগামী বছর।
সংশ্লিষ্টব্যক্তিরা বলছেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সময় দফায় দফায় পেছাচ্ছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। এটি পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া হয়। এখন আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এটি পিছিয়ে ২০২৫ সালে নেওয়া হয়েছিল। তবে এটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে ২০২৭ সালে।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গত সেপ্টেম্বরে চুল্লিপাত্রের ভেতর ‘ডামি’ জ্বালানি প্রবেশ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পুরোটাই এখন নির্ভর করছে সঞ্চালন লাইনের ওপর। সঞ্চালন লাইন তৈরি হওয়ার দুই মাস পর পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশ করানো হবে। জ্বালানি প্রবেশে এক মাস সময় লাগে। এরপর কিছু কিছু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। একই সঙ্গে চলবে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এতে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে রূপপুরের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে আগামী বছর। তবে এটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিক্রি শুরু হলেই কেবল বিনিয়োগের বিপরীতে আয় আসা শুরু হতো। সেটিও দুই বছর পিছিয়ে গেছে। এতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।অধ্যাপক মো.শফিকুল ইসলাম, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পাবনার রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় ঠিকাদার হিসেবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ছিল প্রকল্পের মেয়াদ। গত বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৭ করা হয়েছে। তবে চুক্তি অনুসারে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও খরচ বাড়াতে পারবে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সূত্র বলছে, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে কাজ ব্যাহত হয়েছে। আর্থিক লেনদেনে জটিলতা, যন্ত্রপাতি দেশে আনা, বিশেষজ্ঞদের আসায় জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রা ডলারসংকটে বিল পরিশোধে দেরি, সব মিলে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এতে কাজ পিছিয়ে গেছে। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাজও। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহেদুল হাছান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হলে দুই মাস সময় লাগবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কিছু পরীক্ষা করতে। এরপর এক মাস ধরে পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশ করানো হবে। ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে। তবে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের সময় এখন নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় আছে।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সূত্র বলছে, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে কাজ ব্যাহত হয়েছে। আর্থিক লেনদেনে জটিলতা, যন্ত্রপাতি দেশে আনা, বিশেষজ্ঞদের আসায় জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রা ডলারসংকটে বিল পরিশোধে দেরি, সব মিলে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে।শেষ হয়নি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনদেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সংস্থা পাওয়া গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি রূপপুর বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজ করছে। মোট ৬টি গ্রিড লাইন নির্মাণ করছে তারা। রূপপুর-বাঘাবাড়ি ৬৫ কিলোমিটার, রূপপুর-বগুড়া ১০২ কিলোমিটার ও আমিনবাজার-কালিয়াকৈর ৫১ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া রূপপুর-গোপালগঞ্জ ১৪৪ কিলোমিটার, রূপপুর-ঢাকা ১৪৭ কিলোমিটার ও রূপপুর-ধামরাই ১৪৫ কিলোমিটার লাইনের স্থলভাগের কাজও শেষ। তবে এই লাইন তিনটি পদ্মা ও যমুনা নদী অতিক্রম করছে। এর মধ্যে পদ্মা নদী অতিক্রম করার দুই কিলোমিটার লাইন মার্চের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পাওয়ার গ্রিড। এর আগে তারা গত ডিসেম্বরের মধ্যে এটি শেষ করার কথা বলেছিল। এটি শেষ হলে রূপপুরের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।
পাওয়ার গ্রিড পিএলসি বলছে, দুই নদী অতিক্রমের মোট তিনটি লাইনের প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা আগামী জুনে। রূপপুরের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যমুনা নদী অতিক্রমে ৭ কিলোমিটার করে দুটি লাইন করা হচ্ছে। এখন পূর্ণ উদ্যমে কাজ চললেও বৃহৎ নদী অতিক্রম করতে প্রায়ই নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে যমুনা নদী অতিক্রম করার দুটি সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হতে পারে বলে দাবি করেছে পাওয়ার গ্রিড পিএলসি।
বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হলে দুই মাস সময় লাগবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কিছু পরীক্ষা করতে। এরপর এক মাস ধরে পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশ করানো হবে। ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে।রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো. জাহেদুল হাছানদুই বছর বাড়তি সময় লাগছেদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুরে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ উদ্বোধন করা হয়। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ২০২১ সালের অক্টোবরে রূপপুরে ইউনিট-১-এর ভৌত কাঠামোর ভেতরে চুল্লিপাত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলা যায়। চুল্লিপাত্র হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এই যন্ত্রের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম লোড করা হয়। আর ২০২৩ সালের অক্টোবরে বসানো হয় দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লিপাত্র।
২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের হাতে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান তুলে দেয় রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক স্থাপনার স্বীকৃতি পায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। পারমাণবিক ক্লাবের ৩৩তম সদস্য হিসেবে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। প্রথম ইউনিটের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি এখন রূপপুরে মজুত আছে। চুক্তি অনুসারে প্রকল্প খরচের মধ্যেই প্রথম তিন বছর রাশিয়া থেকে আসবে এ জ্বালানি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪ ঘণ্টা সমান হারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
২০২১ সালের অক্টোবরে রূপপুরে ইউনিট-১-এর ভৌত কাঠামোর ভেতরে চুল্লিপাত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে বলা যায়। চুল্লিপাত্র হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এই যন্ত্রের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম লোড করা হয়। আর ২০২৩ সালের অক্টোবরে বসানো হয় দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লিপাত্র।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চুল্লিতে জ্বালানি স্থাপনের পর অন্তত ছয় মাস ধরে পরীক্ষামূলকভাবে ধাপে ধাপে কম পাওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এই প্রতিটি ধাপে পরীক্ষামূলক উৎপাদন সফল হলেই কেবল পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাবে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পুরোদমে উৎপাদনে আসতে আগামী বছর লেগে যেতে পারে।
অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, দুই বছর পেছানোয় প্রকল্পের খরচ না বাড়লেও প্রায় ১ হাজার ৮০০ জনবলের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য অনেক খরচ তো বাড়ছেই। বিদ্যুৎ বিক্রি শুরু হলেই কেবল বিনিয়োগের বিপরীতে আয় আসা শুরু হতো। সেটিও দুই বছর পিছিয়ে গেছে। এতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
চুল্লিতে জ্বালানি স্থাপনের পর অন্তত ছয় মাস ধরে পরীক্ষামূলকভাবে ধাপে ধাপে কম পাওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এই প্রতিটি ধাপে পরীক্ষামূলক উৎপাদন সফল হলেই কেবল পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলামউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম ইউন ট থ ক প রকল প র ম য় দ ব দ য ৎ সরবর হ দ ব ত য় ইউন ট ম স সময় ল গ ২০২৩ স ল র র প রকল প ড স ম বর শ ষ কর র র প রথম দ ই বছর ইউন ট র শ ষ হয় প এলস বছর প
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।