একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক জনযুদ্ধ। আপামর সিপাহি, কৃষক, মজুর তথা সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালে এ অঞ্চলে একটি প্রাগ্রসর শিক্ষাঙ্গন হিসেবে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা এর ব্যতিক্রম ছিলেন না; বরং শিক্ষায়তন হিসেবে এই কলেজের বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত প্রাক্তন ছাত্ররা এক মহিরুহ ভূমিকা পালন করেন। জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরল বীরত্বের পরিচয় দিয়ে সাহসিকতা বা গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড পাওয়াদের মধ্যে এগিয়ে ছিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। এই কলেজের আটজন মহান শহীদের সঙ্গে ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন পদক লাভ করেন; যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় যা সর্বোচ্চ। নিম্নোক্ত আটজন শহীদের জীবনই বলে দেয় তাদের ত্যাগের গল্প।
শহীদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বীরউত্তম: ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধীনে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র তৎকালীন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দেশব্যাপী গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর অব্যবহিত পর ২৯ মার্চ তাঁর রেজিমেন্টে কর্মরত সব বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ৩০ মার্চ সেই নির্দেশ অমান্য করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের হামলা পরিকল্পনা বুঝতে পেরে তৎকালীন লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ারের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদ্রোহ করেন এবং অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র ছিনিয়ে এনে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা হামলা করেন। আট ঘণ্টাব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা অনেকে হতাহত হলেও তাদের অস্ত্রে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ প্রথম সামরিক অফিসারকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ লে.
শহীদ বদিউল আলম, বীরবিক্রম: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র বদিউল আলম (বদি) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর ২৭ তারিখ সান্ধ্য আইন শিথিল করার প্রথম সুযোগে আরও তিন বন্ধুসহ তৎকালীন মুক্তাঞ্চল কিশোরগঞ্জ গিয়ে মেজর কে.এম. সফিউল্লাহর (পরবর্তীকালে এস ফোর্সের প্রধান ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান) দলে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ নেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে ঢাকায় ফিরে এসে গেরিলা দল গঠন করেন। ঢাকায় প্রথম গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যদের সমন্বয়ে বদি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক অপারেশনে অংশ নেন। ২৯ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আকস্মিকভাবে বদি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। বন্দিদশায় চরম নির্যাতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ নির্মিত হয়েছে ক্র্যাক প্লাটুনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিকে নিয়েই।
শহীদ ক্যাপ্টেন এ কে এম নূরুল আবসার: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র নূরুল আবসার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ও সেখানকার ট্যাঙ্কবহর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন গণহত্যার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে শতাধিক ট্যাঙ্ক আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক আবসার নিরস্ত্র কোটি বাঙালি জনতার প্রাণ রক্ষার তাগিদে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও যে ট্যাঙ্কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে তিনি ছিলেন, তার মধ্যে ২০টি ট্যাঙ্ক তিনি সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে গিয়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর কিছুকালের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং ২৮ মে ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ মেজর এম এ খালেক: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এম এ খালেক ১৯৭১ সালের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। ২৩ মার্চ থেকে সেনানিবাসে সব প্রবেশ ও বহির্গমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ মার্চ রাতে ১৫ সেনা পরিবার মেজর খালেকের বাসায় উপস্থিত হয় সেনানিবাস থেকে পালানোর পথনির্দেশনা ও পরামর্শ নিতে। মেজর খালেক ইতোমধ্যে ২৭ মার্চ সেনানিবাসের বন্দি অবস্থা থেকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারদের নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিলেন। পরিকল্পনা বিফল হয়। পাকিস্তানি সেনারা বাসা ঘেরাও করে তুলে নিয়ে যায় মেজর খালেককে। ২৮ মার্চ বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ ক্যাপ্টেন মো. শামসুল হুদা: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র ক্যাপ্টেন হুদা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদাতিক কোরের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। তবে ছুটি শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ না দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক আহমেদ সরকার: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ১০ম ব্যাচের ছাত্র সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক আহমেদ সরকার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে রংপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে ও নির্দেশনায় সাড়া দিয়ে ২৬ মার্চই তিনি দলত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। ৩০ মার্চ বেলা ৩টার দিকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে তিনি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া বহরে আক্রমণ করেন, এতে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম হলেও এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন। রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংস অত্যাচারের পর পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ মোহাম্মদ মুফতি কাসেদ: ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় থেকেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র স্বাধিকারসচেতন মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ (০৮/২৪৫) থাকতেন সব আন্দোলন আর মিছিলের সম্মুখ সারিতে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মুফতি নিশ্চিত হন যে এটিই যুদ্ধের চূড়ান্ত বার্তা। সেই অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৪ জুন মুফতি একাই রাজাকারদের একটি ছোট দলের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শত্রুদের কবল থেকে এক বাঙালি বন্দিকে উদ্ধার করে আনতে সক্ষম হন। উদ্ধার পর্ব শেষে শত্রুর গুলিতে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ মোশাররফ হোসেন: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র মোশাররফ হোসেন ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী পেপার মিলে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রতিরোধের এক পর্যায়ে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সফল সংগঠক দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং পরে গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
মামুন রশীদ: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ১৯৭১ স ল র ম ম হ ম মদ র প রথম প রথম স অবস থ তৎক ল
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—
১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।
৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।
৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।
৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।
৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।
৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।
১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।
১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।
১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়