‘ভয়ানক ও শ্বাসরুদ্ধকর’—জ্বলন্ত উড়োজাহাজ থেকে পালানোর বর্ণনা দিলেন যাত্রীরা
Published: 15th, March 2025 GMT
‘এটি ছিল সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ার মতো, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ও ভয়ানক ঘটনা।’ আগুন ধরে যাওয়ার পর আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ থেকে পালিয়ে বেঁচে ফেরা যাত্রীদের একজন এভাবেই জানাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান পরিবহন সংস্থাটির ওই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কলোরাডোয় জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়।
উড়োজাহাজটি থেকে বেঁচে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন ১৭২ আরোহীর সবাই। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৬ জন ক্রু সদস্যও। সামান্য আহত হওয়ায় ১২ যাত্রীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।উড়োজাহাজটিতে ১৭২ জন যাত্রী ছিলেন। তাঁদের ডালাস যাওয়ার কথা ছিল। পথিমধ্যে এটির ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। জরুরি অবতরণের পর উড়োজাহাজটিতে আগুন লাগে। তখন আতঙ্কিত যাত্রীদের অনেকে এটির ডানার ওপর গিয়ে দাঁড়ান। কলোরাডোর রাজধানী ডেনভারের বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা উড়োজাহাজটি থেকে তখন এ যাত্রীদের ঘিরে ঘন ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানান, এ ঘটনায় উড়োজাহাজটি থেকে বেঁচে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন আরোহীদের সবাই। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৬ জন ক্রু সদস্যও। সামান্য আহত হওয়ায় ১২ যাত্রীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এই যাত্রীদের একজন মাইকেল উডস। উড়োজাহাজটির উড্ডয়নকালে কীভাবে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল, সেই কথা জানাচ্ছিলেন তিনি। বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজকে উডস বলেন, আকাশে ওড়ার আগপর্যন্ত উড়োজাহাজের ইঞ্জিনগুলোর একটি থেকে বিকট শব্দ বেরিয়ে আসার বিষয়টি তিনি টের পাননি।
(আতঙ্কে) আমি যেন কাঁপছিলাম, স্থির থাকতে পারছিলাম না। -ইংরিড হিবিট, উড়োজাহাজ থেকে পালিয়ে আসা যাত্রীইউএস ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) নিশ্চিত করেছে, ক্রু সদস্যরা ইঞ্জিন থেকে প্রতিধ্বনির শব্দ বেরিয়ে আসার তথ্য জানানোর পর স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটের দিকে উড়োজাহাজটি ডেনভারের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে উড়োজাহাজটিকে জরুরি অবতরণ করানোর পর যাত্রীরা শিগগিরই বুঝতে পারেন, তাঁরা তখনো মোটেও নিরাপদ নন।
উডস নামের ওই নারী যাত্রী বলেন, ‘সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কেবিন ধোঁয়ায় ভরে যায়।’ কলোরাডোয় একটা বাণিজ্য মেলায় অংশ নিয়ে উড়োজাহাজটিতে করে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি।
উডস উড়োজাহাজের সম্মুখভাগের আসনের যাত্রী ছিলেন। এটি জরুরি অবতরণ করার পর কেবিন থেকে হাতে গোনা যে কয়েকজন হেঁটে নিচে নামতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের একজন।
ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন উড়োজাহাজ থেকে অন্য যাত্রীদের সহজে পালিয়ে আসাটা সহজ ছিল না। তাঁরা অনেকে এটির ডানায় আশ্রয় নেন। তাঁদের ডানায় আশ্রয় নেওয়ার কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
হিবিট জানান, উদ্বেগ-আতঙ্কে তাঁর জ্বর এসে গিয়েছিল। কেবিনের পৃথক জায়গায় তিনি ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা বসেছিলেন। আগুন লাগার পর তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পারছিলেন না। শুধু মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন।কেবিন ধোঁয়ায় ঢেকে গেলে প্রাণ বাঁচাতে অন্যদের মতো ১০০৬ ফ্লাইটের ডানায় আশ্রয় নেন ইংরিড হিবিটও। স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে উড়োজাহাজে উঠেছিলেন তিনি। উদ্ধার হওয়ার পর মাটিতে নেমে তিনি স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে আবার একত্র হন।
সিবিএসকে এই নারী বলেন, ‘(আপনি দেখে থাকবেন) জানালা দিয়ে আগুনের শিখা বের হচ্ছে ও সেগুলো একরকম গলে পড়ছে।’ উড়োজাহাজটি থেকে বেরিয়ে আসা একটা কঠিন কাজ ছিল বলে জানান তিনি।
হিবিটের কথায়, ‘(আতঙ্কে) আমি যেন কাঁপছিলাম, স্থির থাকতে পারছিলাম না।’
হিবিট জানান, উদ্বেগ-আতঙ্কে তাঁর জ্বর এসে গিয়েছিল। কেবিনের পৃথক জায়গায় তিনি ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা বসেছিলেন। আগুন লাগার পর তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পারছিলেন না। শুধু মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন।
আরও পড়ুনওয়াশিংটনে উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ৩০ মরদেহ উদ্ধার৩০ জানুয়ারি ২০২৫‘আশা করছিলাম, সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে জানতাম না, সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে’, বলেন হিবিট। তিনি আরও বলেন, ‘মাত্র ১০ মিনিটের অগ্নিপরীক্ষা, তবু তা ছিল অনেক দীর্ঘ ১০টি মিনিট।’ দুর্ঘটনা থেকে সব যাত্রী অক্ষত থাকায় এক অসাধারণ অনুভূতির কথা জানান তিনি।
হিবিট ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা অবশেষে গতকাল শুক্রবার সকালে নিজেদের গন্তব্যস্থল ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজের আরও কিছু যাত্রী।
শ্বাসরুদ্ধকর এ ঘটনার সাক্ষী হয়ে নিরাপদে গন্তব্যে ফিরতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন হিবিট। তবে ঘটনাটি তাঁদের পারিবারিক ছুটি কাটানোর শুরুটা ম্লান করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
এই নারী বলেন, ‘উড়োজাহাজ আকাশে ওড়া অবস্থায় যদি আগুন লাগত, তবে আমি মনে করি না, এ গল্প বলার আমাদের আর সুযোগ হতো। কারণ, কে জানে, তখন কী ঘটত। আমি কৃতজ্ঞ যে সবাই বেঁচে গেছেন।’
আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রে ঘটা ভয়াবহ ১০ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা৩১ জানুয়ারি ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।