পবিত্র রমজান মুসলমানের জীবনে একটি অনন্য সময়। এ সময় মুসলিমরা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। তারা দীর্ঘ এক মাস আল্লাহপ্রেমের সাধনা ও সকল প্রকার পাপ থেকে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। রমজান মাসে নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর ইবাদত ও সাধনা সম্পন্ন করার চষ্টো করে। তারপরও মানবীয় দুর্বলতা, পারিপার্শ্বিক কারণ ও জীবনের নানা ব্যস্ততার কারণে রোজাদারের নানা ধরনে ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়। সদকাতুল ফিতরের মাধ্যমে সে ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতিবিধান হয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.
আলোচ্য হাদিস থেকে সদকাতুল ফিতরের আরেকটি উদ্দেশ্য জানা গেল, তা হলো সমাজের অসহায় ও দরিদ্র্য মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা। মূলত ঈদুল ফিতর মুসলিম জাতির ধর্মীয় উৎসব। মুসলমানরা পরস্পরের ভাই। একজন ভাই তার অপর ভাইকে রেখে আনন্দ-উৎসব করতে পারে না। এজন্য ইসলাম সদকাতুল ফিতরের বিধান দিয়েছেন যেন দরিদ্র্য মানুষও ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে। আর ঈদের আনন্দে তাদের শরিক করতেই ঈদের নামাজের আগেই তা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ফকিহ আলেমরা বলেন, সদকাতুল ফিতর রমজানের শেষ দিকে আদায় করা উচিত। কেননা এতে গরিব মানুষদের ঈদের প্রয়োজন পূরণের সহায়তা হবে। (আল-বাহরুর রায়েক : ২/২৫৫)
আরো পড়ুন:
রমজানে কী পেলাম, কী হারালাম
মহিমান্বিত কদরের রাতে ইবাদত ও প্রার্থনা
সদকাতুল ফিতরের বিধান
সাদকাতুল ফিতর এমন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ওয়াজিব যার হাতে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু ব্যতীত অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে। জাকাত ফরজ হয় না এমন ব্যক্তির ওপর সদকাতুল ফিতর ফরজ হতে পারে। কেননা জাকাত ও সদকাতুল ফিতরের নিসাবের মধ্যে পার্থক্য আছে। জাকাত শুধু সোনা-রুপা টাকা-পয়সা এবং ব্যবসা পণ্যের ওপরই ফরজ হয়। আর সদকাতুল ফিতর প্রয়োজন অতিরিক্ত সব ধরনের সম্পদের ওপর ওয়াজিব হয়।
যে যার পক্ষ থেকে আদায় করবে
ব্যক্তি সদকাতুল ফিতর নিজের পক্ষ থেকে এবং তার অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের পক্ষ থেকে আদায় করবে। স্বামীর জন্য স্ত্রীর এবং প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের পক্ষ বাবার সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হলে নিজেরাই আদায় করবে। তবে স্বামী ও পিতা আদায় করে দিলে আদায় হবে যাবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক সা জব বা এক সা খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটি ওয়াজিব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫১২; ফাতহুল কাদির : ২/২৮১)
এমনকি পবিত্র রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশক। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/১৯২)
প্রবাসী ব্যক্তি যদি নিজে সদকাতুল ফিতর আদায় করেন। তবে তিনি যে দেশে অবস্থান করছেন সে দেশের নির্ধারিত খাদ্যমূল্য অনুসারে আদায় করবেন। তিনি যদি স্ত্রী ও সন্তানের সদকাতুল ফিতর আদায় করেন, তবে তিনি নিজের অবস্থানস্থলের খাদ্যের মূল্য অনুযায়ী আদায় করবেন। তবে কেউ যদি তার পক্ষ থেকে দেশে সদকাতুল ফিতর আদায় করেন, তবে নিজ দেশের নির্ধারিত খাদ্যের মূল্য অনুসারে সদকাতুল ফিতর আদায় করবেন। (রদ্দুল মুহতার : ২/৩৫৫)
যাদের দেব
জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত যে কোনো গরিব মুসলমানকে সাদকাতুল ফিতর দেওয়া যায়। তবে অন্য সকল দানের মতো আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম। শর্ত হলো তারা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হবেন। ভাই-বোন, চাচা-ভাতিজা, মামা, খালা, ফুফুদের মতো নিকটাত্মীয়দেরও সদকাতুল ফিতর দেওয়া যায়। তবে নিজ পিতামাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ, তেমনি নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি এবং তাদের অধীনদেরও সদকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে না।
সদকাতুল ফিতরের হিসাব নির্ধারণ
হাদিসে সদকাতুল ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে দুটি পরিমাপ ও চারটি খাদ্যপণ্যের নাম এসেছে। পরিমাপ হলো ‘এক সা’ ও ‘আধা সা’। ‘সা’ প্রাচীন আরবের প্রচলিত একটি পরিমাপ। যা আধুনিক পরিমাপ অনুসারে তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। আর চারটি খাদ্যদ্রব্য হলো, জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য দ্বারা সদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (সহিহ বুখারি)
প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, চার ধরনের খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায়ের উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন নিজের সামর্থানুসারে যে কোনো পণ্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সদকাতুল ফিতর প্রদানকারী দরিদ্র্য মানুষের প্রয়োজনকে সামনে রেখে মূল্য নির্ধারণ করবে।
চলতি বছর (১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলাদেশ সরকারের সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ কমিটির পক্ষ থেকে জানা হয়েছে, বাংলাদেশে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ জনপ্রতি সর্বনম্নি ১১০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮০৫ টাকা। গম বা আটা দ্বারা ফিতরা আদায় করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর বাজার মূল্য ১১০ টাকা দান করতে হবে; ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম যবের বাজারমূল্য বিবেচনায় ৫৩০ টাকা, খেজুরের বাজার মূল্যে ২ হাজার ৩১০ টাকা, কিশমিশের বাজার মূল্যে ১ হাজার ৯৮০ টাকা ও পনিরের বাজার মূল্য বিবেচনায় ২ হাজার ৮০৫ টাকা ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আল্লাহ সবার রোজাকে ত্রুটিমুক্ত করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা।
শাহেদ//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন ম সলম ন পর ম প পর ম ণ গ রহণ রমজ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গোপালগঞ্জে আমনের ক্ষতির শঙ্কা, ধান কাটার পরামর্শ কৃষি বিভাগের
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের সিলনা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। এ বছর ৫৪ শতাংশ জমিতে আবাদ করেছিলেন আমন ধান। পেকে যাওয়া ধান কেটে ঘরে তোলার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। পরিকল্পনা ছিল, পরিবারের যোগান মিটিয়ে, কিছু ধান বিক্রি করে পুরো বছর চালাবেন ১০ জনের সংসার। তবে, তার সেই স্বপ্ন নষ্ট করে দিল দমকা হাওয়া ও প্রবল বৃষ্টি। ধান হেলে পড়ে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তা এখন নষ্ট হতে বসেছে।
এই কৃষক বলেন, “সাংসারে স্ত্রী, ছেলে, নাতীসহ ১০ জন আছে। এ বছর ৫৪ শতাংশ জমিতে আমন ধানের আবাদ করেছি। জমির ধানও পেকেছিল। ভেবেছি, কয়েকদিন পর ধান কেটে ঘরে তুলব। এই ধান আর ঘরে তুলতে পারলাম না। ঝড়ো হওয়া আর বৃষ্টিতে হেলে পড়ে পানিতে তলিয়ে ধান এখন নষ্ট হতে বসেছে। সারা বছর কীভাবে চলব তা চিন্তাই করতে পারছি না।” শুধু সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাসই নয়, এমন অবস্থা কয়েকটি গ্রামের শতাধিক কৃষকের।
আরো পড়ুন:
খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টি, ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা
দিনাজপুরে টানা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, জনজীবন বিপর্যস্ত
কৃষি বিভাগ বলেছে, ধান দ্রুত কেটে নিলে ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর গোপালগঞ্জ জেলায় ১২ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমিতে আমান ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রীড জাতের ২ হাজার ২৪৫ হেক্টর, উফশী জাতের ৮ হাজার ২০৩ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ২ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন কৃষকরা।
রবিবার (২ নভেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শনিবার সন্ধ্যায় জেলা জুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। তীব্র বাতাস বয়ে যাওয়ায় হেলে পড়ে পাকা আমন ধান। জমিতে জমে থাকা পানিতে কেটে রাখা ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা গেছে। পাশাপাশি শ্রমিক সংকট থাকায় হেলে পড়া ধান কাটতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। দ্রুত পাকা ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে তা মাঠেই নষ্ট হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
কৃষক মহানন্দ দে বলেন, “বৃষ্টি আগে ধান কাটা শেষ করতে পারলে বিঘা প্রতি ৪০ মণ পেতাম। ধান হেলে পড়ায় ও তলিয়ে যাওয়ায় ২০ মণ পাব কিনা সন্দেহ রয়েছে। ধান কাটতে আগে ৭-৮ জন শ্রমিক লাগলেও এখন লাগবে অন্তত ১৫ জন। ফলে আমরা ধান হারানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।”
জমি থেকে ধান কাটায় ব্যস্ত চাষিরা
সিঙ্গারকুল গ্রামের কৃষক বিশ্বম চন্দ্র সরকার বলেন, “পাকা ধান বৃষ্টির কারণে নষ্ট হতে বসেছে। এ ধান না যাবে খাওয়া, না যাবে বিক্রি করা। এমনকি খড় পচে যাচ্ছে যা গরুকেও খাওয়ানো যাবে না। দেনা করে ফসল ফলিয়েছি। এখন ধার কীভাবে মেটাব, আর সারা বছর কীভাবে চলব সেই চিন্তায় দিন কাটছে।”
কৃষক মফিজুর ইসলাম বলেন, “এমন একটা দুর্যোগ গেলেও কৃষি কর্মকর্তারা আমাদের খোঁজ নেননি। শুধু আজ নয়, কোনো সময়ই আমাদের খোঁজ রাখেন না তারা। আমরা কোনো পরামর্শও পাই না তাদের কাছ থেকে। এখন যদি সরকার আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেয়, তাহলে আমাদের মরণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”
গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. মামুনুর রহমান বলেন, “গত শনিবারের বৃষ্টিতে জেলায় ধানসহ কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। ক্ষতি কমাতে দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে প্রণোদনা দিতে ঊর্ধ্বতণ কর্মকর্তাদের জানানো হবে।
ঢাকা/বাদল/মাসুদ