যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক বিভিন্ন দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপ করে আসছেন। চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্র কানাডা এবং যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের ঐতিহাসিক মিত্র দেশগুলোকেও ছাড়েননি। এ জন্য পাল্টাও খেয়ে চলেছেন। এ রকম পরিস্থিতিতে তিনি আবার নতুন একগুচ্ছ শুল্ক প্রস্তাবের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। আগামীকাল বুধবার এই ঘোষণা দেবেন, যা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।

কিন্তু বুধবার ট্রাম্প কি ঘোষণা করতে পারেন তা নিয়ে যেন জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। কারণ, তিনি এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন যে ছোট–বড় নির্বিশেষ কোনো দেশকেই ছাড়বেন না। সেটি বুঝা যায়, ট্রাম্পের বক্তব্যে। তিনি এই বুধবারকে ‘লিবারেশন ডে’ বা ‘স্বাধীনতা দিবস’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট আজ মঙ্গলবার জানিয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কার্যালয় হোয়াইট হাউসের কর্মীরা নতুন করে শুল্ক আরোপের একটি প্রস্তাব তৈরি করেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয়, এ রকম পণ্যের বেশির ভাগের ওপরই প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হবে।

নতুন শুল্ক আরোপের প্রস্তাব তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন তিনজন ব্যক্তিকে উদ্ধৃত ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টারা সতর্ক করে দিয়েছেন যে শুল্ক আরোপের বিষয়ে বেশ কয়েকটি বিকল্প রয়েছে; যার অর্থ ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর না–ও হতে পারে। সংবাদ মাধ্যমটির মতে, এমন একটি বিকল্প পরিকল্পনার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হতে পারে।

আগামীকাল ২ এপ্রিল বুধবার বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি বৃহত্তর পরিকল্পনা ঘোষণা করতে চলেছেন। এই ঘোষণা অবশ্য আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে ওয়াল স্ট্রিট তথা যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কারণ, শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিক্রি ও মুনাফায় সরাসরি প্রভাব পড়বে, এমন আশঙ্কায় তাদের শেয়ারের দর কমছে। বিনিয়োগকারীরা ভয় ও আতঙ্কে এসব কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিয়ে সেফ হ্যাভেন বা বিনিয়োগের জন্য ‘নিরাপদ স্বর্গ’ খ্যাত সোনায় বিনিয়োগ করছেন। ফলে সোনার দাম বেড়ে ইতিমধ্যে প্রতি আউন্স ৩ হাজার ১৪৮ মার্কিন ডলারে উঠেছে। এটি সোনার সর্বকালের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। এই প্রবণতা বিশ্বে আবার মন্দার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে শুল্ক আরোপ নিয়ে যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, আগামীকাল সেগুলোকে নতুন পরিকল্পনায় আরও বিস্তৃত স্থায়ী করার কথা বলতে পারেন। তা অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু দেশ বা শিল্পকে লক্ষ্য করে হবে না। ট্রাম্প ও তাঁর উপদেষ্টারা বলে আসছেন যে তাঁদের লক্ষ্য হলো, অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে আরও ন্যায়সংগত তথা সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা; যাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ে।

কতিপয় অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে দিয়েছেন, নতুন শুল্ক আরোপের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে। আবার বিভিন্ন দেশও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নিতে পারে।

ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যযুদ্ধ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিনিয়োগকারী, ভোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের আস্থাকে আঘাত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৪ দশমিক ৬ শতাংশ পড়ে গেছে। নাসড্যাক সমন্বিত সূচক তো রীতিমতো ১০ দশমকি ৪ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া ভোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের ওপর পরিচালিত এক জরিপেও বলা হয়েছে, চলতি ২০২৫ সালের শুরু থেকে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ক্রমে বাড়ছে।

হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্রের সঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সূত্র: সিএনবিসি, ডয়চে ভেলে, এএফপি ও বিবিসি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র প রস ত ব

এছাড়াও পড়ুন:

নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে

অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।

শ্রমবাজারে দুর্বলতা

পাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।

পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।

মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।

ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।

রাজনৈতিক টানাপোড়েন

এ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।

পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’

বাজারের প্রতিক্রিয়া

সুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নীতিসুদ কী

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।

কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাব

বিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।

নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।

সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ