২০২৩ সালের জুলাই মাসে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি, চারটি নদীর জন্য একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। প্রকল্পের নাম ‘জিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, নৌপথের উন্নয়ন ও বন্যা ব্যবস্থাপনা নির্মাণ’। প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুলাই মাসে একনেকে উত্থাপন করার কথা ছিল। নতুন প্রকল্পে লাগাম টেনে ধরার জন্য সে বছর এই প্রকল্প একনেকে উত্থাপন করা হয়নি। এক বছর পর ২০২৩ সালে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকায় এ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার।

ঘাঘট নদ যেহেতু আমরা সব সময় দেখি, নদীটি নিয়ে কাজ করি, তাই প্রকল্প সম্পর্কে জানার আগ্রহ হয়। রংপুর জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে নদীবিষয়ক একটি সভায় আমি ডিসি তথা জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতির কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই।

রংপুরের তৎকালীন ডিসি জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তার কাছে কোনো তথ্যই নেই। আমি যেহেতু রংপুর বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটিরও সদস্য, তাই বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করি। দেখলাম, বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। বিভাগীয় কমিশনারও জানেন না।

যে নদীগুলোতে নৌযান চলাচলের বিষয় নেই, এমন নদীগুলোতে পরিচর্যা কিংবা ভাঙন রোধের কাজ প্রধানত পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) করে থাকে। পাউবো তিন-চার বছর আগে ঘাঘট নদের ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোতে কাজ করেছে। কেবল তা–ই নয়, যে অংশে খনন করা প্রয়োজন, এ রকম অনেক স্থানে খননও করেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘাঘট নদের নতুন প্রকল্প সম্পর্কে জ্ঞাত আছে ধরে নিয়ে রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে জিজ্ঞেস করে দেখলাম, তাঁরাও জানেন না। কেউ জানেন না, এমন প্রকল্পের অনুমোদন কীভাবে হলো, এটি বোধগম্য নয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুসন্ধান করছিলাম, এ প্রকল্প কেন গ্রহণ করা হলো তা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত এক কর্মকর্তা এ রকম ধারণাই দিয়েছিলেন, এ প্রকল্প মূলত কয়েকজন ব্যক্তির যোগসাজশের ফল। অর্থ তছরুফ যার প্রধান উদ্দেশ্য।

এককভাবে ঘাঘট নদের জন্য কত টাকা, তা একেক রকম শোনা যায়। কেউ দেড় হাজার কোটি টাকার কথা বলছেন, কেউ দুই হাজার কোটি টাকার কথা বলছেন। তবে প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বলে জানা গেছে। যেহেতু ২০২২ সালের বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছিল, তাই এর ব্যয় ২০২৫ সালে এসে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই অর্থের জোগানদাতা বাংলাদেশ সরকার। অনুমোদনের সময়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।

নৌপরবিহন মন্ত্রণালয় সেই নদীগুলোতে কাজ করে, যেগুলোতে নৌযান চলাচল সম্ভব। ঘাঘট নদ নৌপরিবহন উপযোগী নয়। এ নদের ওপর অনেক সেতু করা হয়েছে। সেতুগুলো নিচু হওয়ায় ঘাঘটে নৌকা চলাচল করার মতো বাস্তবতা নেই। ফলে এ নদে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাজ থাকার কোনো কারণ নেই।

ঘাঘট নদে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করার আগে নিশ্চয়ই একটি সমীক্ষা হয়েছে। রংপুরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এমন কোনো দপ্তর নেই, যে দপ্তর রংপুরে সমীক্ষার কাজ করতে পারে। এ কাজ করতে হলে বিদ্যমান কাঠামোতে অবশ্যই ডিসি অফিসের অন্তত জানা থাকার কথা। আবার পানি উন্নয়ন বোর্ড যেহেতু ঘাঘট নদে কাজ করেছে, তাহলে তাদের সঙ্গেও সমন্বয় করে প্রকল্প গ্রহণ করার কথা। বাস্তবে সেসবের কিছুই হয়নি। কীভাবে সমীক্ষা হলো, কীভাবে প্রকল্প অনুমোদন পেল, সবটাই রহস্যপূর্ণ। নদীবিষয়ক কাজে যে সমন্বয়ের কত অভাব, সেটিও বোঝা যাচ্ছে।

ব্যক্তি-গোষ্ঠীস্বার্থের প্রকল্প সাধারণত ক্ষমতাবানদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। ক্ষমতাধর ব্যক্তি চাইলে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য যতগুলো সভা হোক, সেগুলোতে প্রকল্পের প্রয়োজন আছে কি না তা না ভেবে পক্ষে মত দেওয়া হয়। বিগত সরকারের সময়ে এ রকম অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। কুড়িগ্রাম জেলার দুধকুমার নদীতে চার-পাঁচ বছর আগে খননের নামে কয়েক শ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেই খননে বিন্দুমাত্র উপকার হয়নি নদীপারের মানুষের। এমনকি নদীর জন্যও কোনো কল্যাণ হয়নি। বরং অপরিকল্পত যে খনন হয়েছে, এতে নদীপারের ভাঙন তীব্র হয়েছে।

প্রকল্প যাচাই করে যদি দেখা যায়, এই প্রকল্প অপ্রয়োজনীয়, তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যতটুকু জানতে পেরেছি, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ রকম অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে যেগুলো শেষ হয়নি কিংবা শুরু হয়নি এবং বাতিল করার মতো, সেগুলো পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বাতিল করেছে। জনস্বার্থে নয়, উচ্চপর্যায়ের গুটিকতক ব্যক্তির স্বার্থে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ বিবেচনায় যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই বাতিল করতে হবে। ঘাঘট নদ নিয়ে যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেই প্রকল্পে আরও তিনটি নদীর কথা বলা হয়েছে। এ নদীতে নেওয়া প্রকল্পগুলোরও কার্যত কোনো প্রয়োজন আছে কি না, তা–ও ভেবে দেখতে হবে।

নৌপরবিহন মন্ত্রণালয় সেই নদীগুলোতে কাজ করে, যেগুলোতে নৌযান চলাচল সম্ভব। ঘাঘট নদ নৌপরিবহন উপযোগী নয়। এ নদের ওপর অনেক সেতু করা হয়েছে। সেতুগুলো নিচু হওয়ায় ঘাঘটে নৌকা চলাচল করার মতো বাস্তবতা নেই। ফলে এ নদে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাজ থাকার কোনো কারণ নেই।

‘জিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, নৌপথের উন্নয়নও বন্যা ব্যবস্থাপনা নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি পুনর্মূল্যায়ন করা হোক। যেটুকু কাজ এ নদীগুলোতে করা প্রয়োজন, কেবল সেটুকু করা হোক। অপ্রয়োজন মনে হলে বাতিল করা হোক। সারা দেশে এ মুহূর্তে তিস্তা কিংবা ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙন রোধে কাজ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল তিস্তা নদীতে ভাঙনে-বন্যায় প্রতিবছর যে ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। উল্লিখিত প্রকল্পের টাকায় তিস্তা নদীর সুরক্ষা হতে পারে।

ঘাঘটসহ চারটি নদীতে নেওয়া প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি। অতীতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের খবর সবার জানা। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বিষয়টি আমলে নেবেন এবং যাচাই না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না। নদী সুরক্ষা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি রাষ্ট্রীয় পয়সার অপচয় বন্ধ করা।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রকল প র ই প রকল প ব ত ল কর নদ গ ল ত সরক র র ক জ কর র জন য কম ট র এ রকম র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ