রাজধানীর হাতিরঝিলের আদলে নাটোরের সিংড়ায় আত্রাই নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সেতু। এর একপাশে রয়েছে বাজার। এখানকার ব্যবসায়ীরা সেতু থেকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান ও বাড়ি যাওয়ার জন্য নিজেদের ইচ্ছেমতো সিঁড়ি তৈরি করে নিয়েছেন। অনুমতি না নিয়ে কেটেছেন সেতুর দুই পাশের রেলিং। এতে নকশা পরিবর্তন হয়েছে। যানবাহন ও পথচারী চলাচলে তৈরি হয়েছে ঝুঁকি। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, এতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবার সুবিধা হয়েছে।
অন্তত ছয়জন পথচারী এবং পাঁচ গাড়িচালকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, সেতুটি নির্মাণের পর অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষের চলাচলে সুবিধা হয়েছে। সিংড়ার সঙ্গে গুরুদাসপুর উপজেলার মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে সহজ। হাতিরঝিলের আদলে তৈরি সেতুর রেলিং ব্যবসায়ীরা রাতারাতি নিজেদের সুবিধামতো অবৈধভাবে কেটে সৌন্দর্য নষ্ট করেছেন। অবৈধ সিঁড়ি দুটি উচ্ছেদ করে সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার দাবি তাদের।
সেতুর রেলিং কেটে বেআইনি কাজ করা হয়েছে বলে মনে করেন পথচারী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন সেতুটি নষ্ট করা হয়েছে। এটি বন্ধ না হলে আরও অনেকে তাদের বাড়ির সামনে সুবিধামতো সিঁড়ি নির্মাণ করবেন। এতে পথচারীর চলাচলে সমস্যা হবে।
সিংড়ায় আত্রাই নদীর ওপর এলজিইডির অর্থায়নে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলার বিলদহর বাজার থেকে কৃষ্ণনগর গ্রামের সংযোগ সেতুর পশ্চিমে রেলিং কেটেছেন বিলদহর গ্রামের ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান। তাঁর বাসার দোতলায় যাওয়ার জন্য সিঁড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। পূর্ব পাশে রেলিং কেটে নিজেদের মার্কেটে পণ্য বহনের জন্য নিচে নামার সিঁড়ি করেছেন অন্য ব্যবসায়ীরা। এতে সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নকশা পরিবর্তন হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এলজিইডি।
নিজেদের বাসা রেস্টুরেন্ট অথবা ক্লিনিক হিসেবে ভাড়া দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ফজলুর রহমানের ছেলে নয়ন ইসলাম। তিনি বলেন, বাসাটি সেতুর কাছাকাছি হওয়ায় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সিঁড়িটি করা হয়েছে। দোতলার সঙ্গে নির্মিত সিঁড়ি ঠিকাদার করে দিয়েছেন। নিচতলায় যাওয়ায় সিঁড়ির প্রয়োজন নেই, আলাদা রাস্তা আছে। এতে সেতুর কোনো ক্ষতি হয়নি বলে দাবি তাঁর।
এলজিইডি থেকে জানা গেছে, হাতিরঝিলের আদলে আত্রাই নদীর ওপর বিলদহর বাজার থেকে কৃষ্ণনগর গ্রাম পর্যন্ত সংযোগ সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। এলজিইডির অর্থায়নে ২০৮ মিটার সেতু নির্মাণে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ২০১৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। এটি চলাচলের উপযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নিজেদের সুবিধার্থে রাতারাতি রেলিং কেটে বাসায় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের সিঁড়ি তৈরি করেছেন। এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বাধা দিয়েও আটকানো যায়নি।
পূর্ব পাশে রেলিং কেটে সিঁড়ি তৈরি করা ব্যবসায়ীদের একজন মিজবাহ এন্টারপ্রাইজের মালিক ইয়াজিদ আলী। তিনি বলেন, সেতুতে সহজে ওঠার সুবিধার্থে মানুষের স্বার্থে ব্যবসায়ীরা এ উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে খেয়াঘাটের মানুষ সহজে সেতুতে উঠতে পারেন। অন্যথায় ঘুরে গিয়ে উঠতে হতো। আরেক ব্যবসায়ী ডি আর গৌরী জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী পরিমল সরকারের ভাষ্য, ঠিকাদারকে বলেই এটি করা হয়েছে। নিজেদের সুবিধার্থে ১০-১২ জন ব্যবসায়ী কাজটি করেছেন। এতে সেতুর ক্ষতি হয়নি। একই ধরনের কথা বলেন কালাম ইঞ্জিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘সিঁড়ি করায় আমাদের খুব উপকার হয়েছে।’
সেতু নির্মাণের ঠিকাদার আমিরুল ইসলাম জাহানের বক্তব্য জানতে তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। কাজটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী বিপ্লব হোসেন বলেন, এলাকার লোকজন কোনো কথা না শুনে জোর করে রেলিং কেটে সিঁড়ি তৈরি করেছেন। অবৈধভাবে এ কাজ করায় সেতুটির মূল নকশা পরিবর্তন হয়ে গেছে।
এ কাজের জন্য কেউ কোনো অনুমতি নেননি বলে জানান উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ রফিক। তিনি বলেন, এলাকার কিছু ব্যবসায়ী নিজেরাই রেলিং কেটে সিঁড়ি তৈরি করেছেন। নতুন রেলিং তৈরি করতে গেলে বাধা দেন। সেতুর মূল কাঠামো ঠিক আছে। যত্রতত্র সিঁড়ি তৈরি করায় সেতুর সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র ম ণ কর ব যবস য় র স ন দর য র ব যবস কর ছ ন র জন য পথচ র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ