বৈশাখকে ঘিরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। সর্বজনীন এই উৎসবকে রাঙাতে নতুন বিনিয়োগ এসেছে চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক মার্কেটে। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতিকে ধারণ করে পোশাক বিক্রি করছেন দোকানিরা। অন্যদিকে বৈশাখকে উৎসবে পরিণত করতে নবরূপে সাজছে ডিসি হিল ও সিআরবির শিরীষতলা। সেখানে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ডিসি হিলে গতবার ৪২টি সংগঠন অংশ নিলেও এবার নিচ্ছে ৫৩টি সংগঠন। সিআরবির সিরীষতলায়ও এবার বেড়েছে অংশগ্রহণকারী সংগঠনের সংখ্যা। গতবার ৩৯টি সংগঠন অংশ নিলেও এবার সেখানে দেখা যাবে ৫৬টি সংগঠনকে।
প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাদশা মিয়া সড়কে থাকা চবির চারুকলা ইনস্টিটিউটও। তারা বের করবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। চারুকলার আঙিনাজুড়ে তাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শিক্ষার্থীদের নানা রঙের উপকরণ। এই আঙিনা মুখর করে রেখেছেন এখন শিক্ষার্থীরা। কাঠের ফ্রেমে কেউ বসাচ্ছেন মুখোশ। কেউবা বাঘের অবয়ব ফুটিয়ে তুলছেন রংতুলিতে। পহেলা বৈশাখের সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হবে শোভাযাত্রা। আর চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে এবার বের হবে আনন্দ শোভাযাত্রা। প্রতিবছর এটি মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে বের হলেও এবার পরিবর্তন করা হয়েছে এই নাম।
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ আয়াজ মাহমুদ বলেন, সকাল ৮টায় শিল্পকলা একাডেমি থেকে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। এখানে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসিসহ সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। আগে এ শোভাযাত্রার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা হলেও সরকারের সিদ্ধান্তে এবার আনন্দ শোভাযাত্রা নামকরণ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিআরবি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সংস্কৃতিকর্মী ফারুক তাহের বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি ঐতিহ্য। এটার নাম পরিবর্তন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইউনেস্কো স্বীকৃত একটি ঐতিহ্যের নাম পরিবর্তন না করাই কাঙ্ক্ষিত ছিল। তার পর মঙ্গল শোভাযাত্রা হোক আর আনন্দ শোভাযাত্রা হোক–মানুষ এতে স্বতঃফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবেন– এটি ভালো দিক। চট্টগ্রামে আমরা দুই দিনের বর্ষবরণ ও বিদায়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করছি। সিআরবিতে গত বছরের তুলনায় এবার সাংস্কৃতিক সংগঠনের আগ্রহ বেড়েছে। গত বছর ৩৯টি সংগঠনের পরিবেশনা থাকলেও এবার তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬টি সংগঠন পরিবেশনা উপস্থাপন করবে।
ডিসি হিলে নববর্ষ উদযাপন পরিষদের অন্যতম সংগঠক প্রণব চৌধুরী বলেন, ডিসি হিলে আয়োজন এই প্রথমবারের মতো সংক্ষিপ্তভাবে হতে যাচ্ছে। এটি আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের মনে পীড়া দিচ্ছে। তবুও সাধারণ মানুষকে সুন্দর আয়োজন উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা গতবার ৪২টি থাকলেও এবারে তা বেড়ে ৫৩টি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বৈশাখ ঘিরে সরগরম মার্কেট
ঈদের পর এসে গেছে বৈশাখ। তাই ঈদের ছুটি শেষ হতে না হতে ফের সরগরম হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের মার্কেটগুলো। বৈশাখকে সামনে রেখে আকর্ষণীয় পোশাকের সমাহার ঘটিয়েছেন বিভিন্ন বিপণি কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা। নগরীর নিউমার্কেট, মিমি সুপারমার্কেট, বালি আর্কেড, চক সুপারমার্কেট, স্বজন সুপারমার্কেট, সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেট, লাকি প্লাজা, আখতারুজ্জামান সেন্টার, ইউনুস্কো সেন্টার, আফমি প্লাজা, সেন্ট্রাল প্লাজা, বে-শপিং সেন্টার, ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সে সহস্রাধিক দোকান এনেছে অত্যাধুনিক পোশাক। বাংলাদেশের বুটিকের পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারতীয় ও আফগানিস্তানের পোশাক তোলা হয়েছে দোকানে। পাঞ্জাবিতে বিভিন্ন ধরনের নকশা, লেস ও সিক্যুয়েন্সের কাজ করেছেন ডিজাইনাররা।
চট্টগ্রাম ডিজাইনার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও রওশন বুটিক হাউসের মালিক রওশন আরা চৌধুরী বলেন, বছরজুড়ে আমাদের লক্ষ্য থাকে পহেলা বৈশাখ আর ঈদ। এ দুটি কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় পরিকল্পনাটাও সেভাবে সাজান ডিজাইনাররা। বাড়াই তারা বিনিয়োগও। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফ্যাশন হাউস শৈল্পিকের প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম ইলিয়াস বলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে বৈশাখের পোশাকে ডিজাইন করেছি আমরা। আমাদের ৫৪টি শোরুম রয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ঈদ ও বৈশাখকে ঘিরে এগুলোতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ করেছি আমরা।’
সতর্ক আছে প্রশাসন
বাংলা বর্ষবরণ উদযাপনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি নেই বলে জানিয়েছে সিএমপি। সম্প্রতি নগরের দামপাড়া সিএমপি সদরদপ্তরে নিরাপত্তা সমন্বয় সভায় এ তথ্য জানানো হয়। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেওয়ার কথা জানানো হয়। এতে পুলিশের নিয়মিত সদস্যের পাশাপাশি বিশেষায়িত প্রশিক্ষিত ইউনিট সোয়াট, বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ডগ স্কোয়াড, ডিবিসহ বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন। অনুষ্ঠান ঘিরে সতর্কতা ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা তুলে ধরেন সিএমপির উপকমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো.
নগরের সিআরবি শিরীষতলায় বর্ষ বিদায় ও বরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে নববর্ষ উদযাপন পরিষদ। এবারও তারা দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। পরিষদের উৎসব কমিটির আহবায়ক হাসান মারুফ রুমি সমকালকে বলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে সমন্বয় বৈঠকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। আমরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে বর্ষ বিদায় ও বরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করছি।’
নিরাপত্তা সমন্বয় সভায় সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. আসফিকুজ্জামান আকতার, উপপুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) হোসাইন মোহাম্মদ কবির ভূঁইয়া ও উপপুলিশ কমিশনার (ডিবি-পশ্চিম) মো. মাহবুব আলম খান এবং সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ, নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ডিজিএফআই, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে মঙ্গল শব্দ বাদ দিয়ে আনন্দ শব্দ ব্যবহারের দাবি করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হেফাজত নেতারা এ দাবি জানান। এতে মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর ধর্মাচার বলে উল্লেখ করেন হেফাজত আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান। এর পর মঙ্গল শব্দ বাদ দিয়ে এবার আনন্দ শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্টরা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আনন দ শ ভ য ত র শ ল পকল এক ড ম ড জ ইন ইউন ট স গঠন স আরব স এমপ
এছাড়াও পড়ুন:
৫৮ দিনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শেষে আবারও সরগরম বাগেরহাটের মৎস্য আড়ত
ভোরের আলো ফোটার আগেই বাগেরহাটের কেবি বাজারে হইচই। সাগরে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় মাছ ধরে ফিরেছেন জেলেরা। আজ শুক্রবার ভোরে দুটি ট্রলার একসঙ্গে মাছ নিয়ে ঘাটে ভিড়তেই সরব হয়ে ওঠে এলাকার প্রধান সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণকেন্দ্রটি।
নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রথম দিনেই বাজারে ভিড় করেন শত শত মৎস্য ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও আড়তদার। শুরু হয় ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক। মাছের সরবরাহ কম হলেও চাহিদা ছিল অনেক বেশি।
কেবি মৎস্য অবতরণকেন্দ্রটি শহরের দড়াটানা নদীর তীরের বাসাবাটি এলাকায়। জেলেরা সাগর থেকে ধরা মাছ নিয়ে সরাসরি ঘাটে আসেন। এখান থেকেই বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে নিয়ে যান।
ভোরে বাজারে দেখা যায়, ঘাটে ভিড়েছে দুটি ট্রলার। সেখান থেকে শ্রমিকেরা ঝুড়িতে করে মাছ তুলছেন। ইলিশ, রুপচাঁদা, ভেটকি, লইট্টা, ছুরি, জাবা, ঢেলা, চ্যালাসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ উঠেছে বাজারে। তবে বাজারে যে পরিমাণ মাছ এসেছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে দাম ছিল চড়া।
সাগর থেকে মাছ ধরে ফেরা জেলে রুহুল আমিন বলেন, ‘সাগরে যাওয়ার পরে কয়েকবার জাল ফেলতে পেরেছি। অল্প কিছু ইলিশ পেয়েছি, বাকি সব আজেবাজে মাছ। পরে ট্রলারে সমস্যা হওয়ার কারণে চলে এসেছি।’
মোরেলগঞ্জ থেকে মাছ কিনতে আসা তৈয়ব মুন্সি বলেন, ‘অনেক দিন পর এলাম। দাম বেশি, তবু কিছু মাছ কিনছি। এখন এলাকায় বিক্রি করতে পারলে ভালো হয়।’
আরও পড়ুনসাগরে মাছ ধরায় ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ আজ, সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন১১ জুন ২০২৫বাজারে ইলিশের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ইলিশ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রুপচাঁদা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এ ছাড়া কঙ্কণ, তুলারডাটি, ঢেলা, চ্যালা, ভেটকি, লইট্টা, ছুরি, জাবাসহ নানা মাছ বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধীরে ধীরে ট্রলারের সংখ্যা ও মাছের পরিমাণ বাড়লে দামও স্বাভাবিক হবে।
কেবি বাজারে মাছ বিক্রি হয় সাধারণত ‘পণ’ হিসেবে। এক পোণে ৮০টি মাছ থাকে। আকার অনুযায়ী প্রতি পোণের দাম নির্ধারিত হয়। ক্রেতারা ঢাকের শব্দে বিট দিয়ে মাছ কেনেন।
কেবি বাজার আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনুপ কুমার বিশ্বাস বলেন, অবরোধের পর আজই প্রথম বঙ্গোপসাগর থেকে ট্রলার এসেছে। তেমন মাছ পায়নি। তবে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পাইকার আসছেন। যার কারণে দাম কিছুটা বেশি। তবে মাছ বেশি হলে দাম কিছুটা কমে আসবে।
উল্লেখ্য, মাছের প্রজনন ও টেকসই আহরণ নিশ্চিত করতে বঙ্গোপসাগরে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এ সময় সাগরে সব ধরনের মাছ ধরা, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ছিল ৬৫ দিন।