আব্বাই আমার জীবনের গুরু, আমার ওস্তাদ, আমার স্বপ্নদ্রষ্টা ও পথপ্রদর্শক। আমার জীবনের কথা বলতে গেলে আসলে তাঁর কথাই বলতে হবে। আমার আব্বা-মা যেমন আমাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন, তেমনি কীভাবে এখানে জীবন যাপন করব, তাঁরাই সেসব বিষয় শিখিয়ে দিয়েছেন এবং তৈরি করেছেন আমাকে। একটা সাধারণ আটপৌঢ়ে জীবন হতে পারত আমার। কিন্তু না, আব্বা তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মীর্না মা আর সবার চেয়ে আলাদা হবে। তার নিজস্ব পরিচয় হবে। সে স্বাবলম্বী হবে। বাংলা সংগীতকে সে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে। ভালো মানুষ হবে সে। আরও কত স্বপ্ন ছিল তাঁর। আব্বা আমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি কিংবা পারিনি, সেটা আমার শ্রোতা-পাঠকেরাই বলতে পারবেন। পাঠক, আমি আমার আব্বাকে স্মরণ করেই আমার জীবনের অতি সাধারণ ও ছোটখাটো কিছু ঘটনা বা দৃশ্যের কথা যা আমার মনে আছে, তা আপনাদের কাছে বলার চেষ্টা করছি।

শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ কোন মাপের শিল্পী ছিলেন, কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, কত হাজার গান রেকর্ড করেছেন, মানুষের হৃদয়কে তাঁর কণ্ঠ আর গান দিয়ে ছুঁতে পেরেছিলেন কিংবা তিনি কি সফল হয়েছিলেন, নাকি নিছকই একজন গায়ক ছিলেন নাকি তাঁর অসংখ্য গান দিয়ে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন? তিনি সত্যিকার অর্থে বাঙালিদের, বিশেষ করে নজরুলের সঙ্গে মুসলমান বাঙালিদের সংগীত দিয়ে জাগাতে পেরেছিলেন কি না, এসব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গের মূল্যায়ন করবেন আব্বাসউদ্দীনের শ্রোতারা, দেশের আপামর জনসাধারণ। যাঁরা এখনো তাঁর গান শুনলে মুগ্ধ হন, তাঁরা।

আমি বলছি আমার আব্বা আব্বাসউদ্দীনের কথা। তাঁর সন্তান হিসেবে তাঁকে আমি অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। সব সন্তানের কাছেই তাদের মা–বাবা শ্রেষ্ঠ। কিছুদিন আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম, ছোট্ট একটা মিষ্টি মেয়ে ছোট্ট দুটো হাত আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলছে, ‘মাই ফাদার ইজ গ্রেটেস্ট কিংবা মাই ফাদার স্ট্রংগেস্ট।’ আর দশটা সন্তানের মতো আমারও ইচ্ছা করে চিত্কার করে বলি, মাই ফাদার ইজ দ্য বেস্ট। কিন্তু সত্যিই কি তা–ই? কেন? কেন তিনি বেস্ট? এ জন্যই কি তিনি মস্ত বড় শিল্পী ছিলেন? সবাই তাঁকে চেনেন এবং দেশপ্রেমিক বলে জানেন। না, ওসব তো কখনো ছোটবেলায় উপলব্ধি করিনি। শুধু তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, তাঁর অশেষ স্নেহ-মমতা পেয়েছি। প্রতিটি কাজে তাঁর সাহচর্য ও সাহায্য পেয়েছি।

সন্তানের কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা হলো ‘বন্ধুত্ব’। সেটা দিয়েছেন আব্বা; অন্তত যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন। হ্যাঁ, আরও বন্ধুবান্ধব যে ছিল না আমার, তা নয়। কিন্তু আব্বার সঙ্গে সব-সব-সব কথা অকপট বলতে পারতাম। আর আমার আব্বা? সবচেয়ে ভালো বন্ধুর মতো মন দিয়ে শুনতেন এবং মজার মজার মন্তব্য করতেন। মন খারাপ থাকলে মন ভালো করে দিতেন।

আজকাল কজন মা–বাবা আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানকে অনেক সময় দিতে পারেন? আপনারা বলবেন, এই ব্যস্ততার মধ্যে সন্তানদের বেশি সময় দিতে পারি না। কিন্তু আমার আব্বাও তো প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। চাকরি, গান, অসংখ্য অনুষ্ঠানে ছুটে যাওয়া ইত্যাদি সবই ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবনে। কিন্তু এসবের মধ্যেও আমাদের জন্য তাঁর সময়ের কমতি ছিল না। স্কুল থেকে ফিরে তাঁকে বলতে হতো, কী হলো স্কুলে, মজার কিছু ঘটল কি না। সেসব তিনি শুনতেন। দেখতাম, তিনি রীতিমতো সবকিছু উপভোগ করছেন। কলেজ থেকে ফিরলেও একই ব্যাপার। তারপর গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব সময় তাঁর কাছ থেকে একই রকম উত্সাহ ও সময় পেয়েছি।

আব্বা সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের হয়তো বলে গেছেন, ‘মাগো, তোমরা পড়াশোনা করো, আমরা একটা সিনেমা দেখে আসি।’ পরদিন হয়তো আমাকে আর তাতাকে পয়সা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সেই সিনেমা দেখতে।

যে সময় বয়ঃসন্ধিকাল, সেই সময়ই সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব পেয়েছি আব্বার কাছে। সব কথাই আব্বার কাছে না বলা পর্যন্ত শান্তি পেতাম না। আব্বাও খুব ধৈর্য ধরে শুনে বুঝতেন আমার মনের সব-সব কষ্ট-বেদনা। মিষ্টি করে বুঝিয়ে তা দূর করে দিতেন।

আব্বা সত্যিই তাঁর সন্তানদের ভীষণ ভালোবাসতেন। সন্তানদের প্রতিটি ব্যাপারেই তাঁর প্রখর নজর ছিল। আমাদের খাওয়াদাওয়া, বেড়ানো, মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরে গিয়ে বেড়িয়ে আসা—সব দিকেই তাঁর খেয়াল ছিল। বিদেশি কোনো শিল্পী এলে তাঁদের চট্টগ্রাম, সিলেট, দার্জিলিং—এসব জায়গায় অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া-আসা সবই করতেন। মনে পড়ে, আব্বার সঙ্গে ম্যাজিশিয়ান পিসি সরকারের ম্যাজিক দেখতে যাওয়ার কথা; মনে পড়ে, একজন নামকরা রাশিয়ান জ্যোতিষীর কাছে হাত দেখাতে যাওয়ার কথা; বাড়িতে উপমহাদেশের নামকরা সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে আনার কথা; কলকাতায় উপমহাদেশের বিরাট ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর সঙ্গে আলাপ করতে নিয়ে যাওয়ার কথা; মনে পড়ে, কলকাতায় নামকরা কমলা সার্কাসে সার্কাস দেখতে যাওয়ার কথা।

ফুল কার না ভালো লাগে? কে না ফুল ভালোবাসে? কিন্তু কজন ভালোবাসে ফুল ফোটাতে? নিজের হাতে বাগান করতে? সকাল-বিকেল গাছে পানি দিতে? আমার আব্বাকে এটাই করতে দেখেছি। সকালবেলা উঠেই দেখতেন কোন ফুলের কোন কলিটি ফুটল। কোন গাছটার গোড়া পরিষ্কার করতে হবে। শুধু কি ফুলের গাছ? আমাদের পুরানা পল্টনের বাড়ির ভেতর দিকে অনেকখানি জায়গা ছিল। সেখানে আব্বা সবজি, তরকারির বাগান করতেন। টমেটো ধরলে সবাইকে সেটা কেটে খাওয়াতেন।

একটা মজার গল্প বলি। একদিন বিকেলে আব্বা বাগানে লুঙ্গি পরে কাজ করছিলেন। এমন সময় এক বিদেশি ভদ্রলোক এসে আব্বার কথা জিজ্ঞেস করলে আব্বা মেহমানকে সসম্মান ঘরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরই তিনি ধোপদুরস্ত হয়ে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, যা আব্বার খুব প্রিয় পোশাক ছিল, তা পরে সাহেবের সামনে আসতেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন যে একটু আগে বাগানে যিনি মালির কাজ করছিলেন, তিনিই স্বনামধন্য আব্বাসউদ্দীন। ভদ্রলোক সত্যিই অবাক হয়েছিলেন সেদিন।

আপনাদের যদি জিজ্ঞেস করি, আপনাদের স্ত্রীকে কতখানি ভালোবাসেন? হয়তো অবাক হবেন যে এ আবার কেমন প্রশ্ন? হয়তো অনেকেই বলবেন, ‘বউকে তো ভালোবাসিই। এ আবার জাহির করতে হবে নাকি?’ কেন বলছি এ কথা? দেখেছি, মায়ের প্রতি আব্বার যে ভালোবাসা, তার কোনো তুলনাই হয় না। আমার মায়ের নাম লুত্ফুন্নেসা খাতুন। আব্বা আদর করে ডাকতেন ‘আলেয়া’ বলে। স্ত্রীকে যে কতখানি সম্মান করা যায়, করতে হয়, আব্বাকে তা করতে দেখেছি এবং দেখে অবাক হয়েছি। এমন কোনো কাজ নেই, যা মাকে না বলে করেছেন। সব কথা মাকে জিজ্ঞেস করতেন। ‘আলেয়া, তুমি কী বলো?’

মায়ের প্রতি আব্বার যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, তা বুঝতে পেরেছি মায়ের কাছে লেখা আব্বার কতগুলো চিঠিতে। আব্বা তখন কলকাতায়। মা দাদার বাসায় বলরামপুরে থাকতেন। ‘প্রাণের আলেয়া’কে তাঁর লেখা চিঠিগুলো পড়ার মতো। যদি কখনো সুযোগ হয়, ওগুলো ছাপিয়ে দেব। তখন আপনারাও বুঝতে পারবেন স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার গভীরতা। তবে হ্যাঁ, দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য যে কখনো হয়নি, তা বলব না। কিন্তু সন্তানদের সামনে কখনো তাঁদের ঝগড়া করতে দেখিনি। দরজা বন্ধ করে যা বোঝাপড়া করার তা করে নিয়ে দেখতাম, আব্বা মাকে রিকশায় নিয়ে চলে গেলেন বেড়াতে। কিংবা সিনেমা দেখতে।

আব্বা সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের হয়তো বলে গেছেন, ‘মাগো, তোমরা পড়াশোনা করো, আমরা একটা সিনেমা দেখে আসি।’ পরদিন হয়তো আমাকে আর তাতাকে পয়সা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সেই সিনেমা দেখতে। ছবিতে গান ভালো হলে সেই ছবি আব্বা তিনবার-চারবার দেখতেন। আমাকেও সঙ্গে নিতেন। আমাদের ছোটবেলায় সুচিত্রা-উত্তম ছিলেন নামকরা নায়ক-নায়িকা। আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন আব্বার ভীষণ প্রিয় শিল্পী। তাঁর রেকর্ড বাজারে এলেই কিনে নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে গান শিখে ফেলতে বলতেন। পরে আবার তাঁকে সেই গান গেয়ে শোনাতে হতো। হুবহু না তুললে আবার দেখে নিতে বলতেন।

হ্যাঁ, আমার গানের কথায় চলে এসেছি, তা–ই না? এ ব্যাপারে অবশ্য লেখালেখি করেছি। আব্বা তাঁর মেয়েকে শিল্পী বানাবেন, সেটা তাঁরই স্বপ্ন ছিল। একটিমাত্র মেয়ে; তাকে কী করলে যে সম্পূর্ণ একটা মানুষ এবং একজন গুণী কণ্ঠশিল্পী হবে, তা ছিল তাঁরই সাধনা। সেই সাধনা, সেই স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি কি না, জানি না বা কতটুকু পেরেছি, সেটা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। শুধু আমাকে নয়, আমাদের তিন ভাইবোনকেই তিনি মনের মতো করে মানুষ করতে চেয়েছেন। সে জন্যই হয়তো আমাদের সব ভালো-মন্দের দিকে খেয়াল রেখেছেন।

কজন মা–বাবা এখন তা করেন? টিউশন বা কোচিংয়ে পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করি আমরা। কিন্তু আব্বা? নিজের হাতে বড় বড় খাতা বানিয়ে তাতে প্রতিটি ইংরেজি শব্দের মানে মুখস্থ করতে বলতেন আমাকে, যাতে আমার ইংরেজিটা ভালো হয়। ইংলিশ মিডিয়াম কনভেন্ট স্কুলে আমাকে ভর্তি করালেন, যেটা ওই সময় ঢাকার সবচেয়ে ভালো স্কুল ছিল এবং সত্যিই আমি তিন মাসের মধ্যে উঁচু ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম। এ–ই ছিলেন আমার আব্বা। আমি প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো করলে দেখতাম তাঁর আনন্দ। সব কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীকে বলতেন তাঁর মেয়ের সাফল্যের কথা।

খেতে কে না ভালোবাসে! আমরা সবাই খেতে ভালোবাসি। আব্বা ভালোবাসতেন সবাইকে খাওয়াতে। ভালোবাসতেন বাজার করতে। প্রচুর বাজার করতেন। সবচেয়ে নতুন সবজিটা, সবচেয়ে বড় মাছটা আনতেন বাড়িতে। সে সময় ফ্রিজ ছিল না। তাই মা হিমশিম খেতেন এসব মাছ-সবজি টাটকা রাখতে। বাজার করে হয়তো ফোন করে দিলেন কবি গোলাম মোস্তফা চাচার পরিবারকে কিংবা জসীমউদ্​দীন চাচা আর তাঁর পরিবারকে। সবাইকে নিয়ে হইচই করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন আব্বা।

আব্বা ট্যুরে যেতেন প্রায়ই ঢাকার বাইরে। যেখানে যেটা ভালো, সেই খাবার নিয়ে আসতেন। সিলেট থেকে কমলা, দিনাজপুর থেকে আম–লিচু, চট্টগ্রাম থেকে আব্বার প্রিয় শুঁটকি মাছ। এখানকার চমচম, ওখানকার দই, সেখানকার মিষ্টি, সন্দেশ ইত্যাদি। আব্বা ট্যুর থেকে এলে তাই আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। আর হাঁড়ি ভরে যেসব খাবার আসত, তা দিয়ে-থুয়ে খাওয়া হতো। 

আব্বা প্রতিনিয়ত আমাদের নানান ছলে নানাভাবে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মনে আছে, প্রায় ৬৫ বছর আগে, তখন আমরা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে একটা বাড়িতে থাকতাম। আমি তখন পাশেই কনভেন্ট স্কুলে আর ভাই সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে পড়ে। আমরা দুই ভাই–বোনই তখন রেডিওতে ছোটদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এ গান করি নিয়মিত এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানেই আমরা ১০ টাকা পাই। সেই টাকা আব্বা আমাদের নামে ব্যাংকে রাখতেন।

হঠাৎ একদিন আব্বা আমাদের দুই ভাই–বোনকে ডেকে দুজনকে ১০ টাকা করে দিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমাদের যা ভালো লাগে, কিনে নাও।’ তখনকার ১০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। সে সময় সদরঘাট, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর ও নবাবপুর ছিল বাজার এলাকা। আমরা দুই ভাই–বোন খুব খুশিমনে রওনা দিলাম বাজার করতে। চষে বেড়ালাম সব চেনা-অচেনা দোকান এবং ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলাম। এসে দেখি, আব্বা অধীর আগ্রহে বসে আছেন আমরা কী কেনাকাটা করলাম, তা দেখার জন্য। দুজনকেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী কিনলাম আমরা। আব্বাকে অবাক করে দিয়ে আমরা দুজনই তাঁকে টাকা ফেরত দিলাম। আব্বা তো অবাক এ–ই ভেবে যে কেন আমরা কিছুই কিনলাম না। আমাদের একটাই উত্তর ছিল যে আমাদের তো সবকিছুই আছে, তাই কিছুই কেনার ছিল না। আব্বা হয়তো এটা ভেবেই আনন্দিত হলেন যে তাঁর সন্তানেরা কত অল্পতেই সন্তুষ্ট। তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। আমি এখন ভাবি, এখন যদি কোনো ছোট শিশুর হাতে হাজার টাকাও দেওয়া হয়, তাহলে তারা সেই টাকা খরচ করে ফেলবে। কারণ, তাদের অনেক থাকলেও তাদের আরও অনেক চাই।

শিল্পীরা যে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হন, এটা আমরা সবাই জানি। তাঁরা নিজের সাফল্য ছাড়া আর কারও কথা ভাবেন না। কে কাকে টেক্কা দেবেন, এটাই সবার ভাবনা। আব্বাকে দেখতাম উল্টোটা। নিজে তো বিরাট শিল্পী। প্রথমে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, তারপর নজরুলের বিভিন্ন ধরনের গান; বিশেষ করে ইসলামি গান, যা পুরো দেশের ঘুমন্ত মুসলমানকে জাগিয়ে তুলেছে। তারপর পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকা, জারি, সারি, মুর্শিদিসহ সব ধরনের গান তিনি গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে এনে শহরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন এবং শ্রোতারা তা ভীষণভাবে গ্রহণ করল। কিন্তু তিনি একা গেয়েই ক্ষান্ত হননি। গ্রাম থেকে আরও প্রতিভাবান শিল্পীকে কলকাতায় এনে তাঁদের কণ্ঠে সেসব গান রেকর্ড করালেন। কারও মধ্যে সামান্যতম প্রতিভা দেখলেই তাঁকে উত্সাহে ভরিয়ে দিতেন আব্বা। এ প্রসঙ্গে সোহরাব হোসেন, বেদারউদ্দীন, আবদুল আলীম, আবদুল লতিফসহ বহু শিল্পীর নাম করা যেতে পারে। যাঁরা আব্বার কাছে উত্সাহ পেয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ রকম আরও বহু গুণের কথা আব্বার সম্পর্কে বলতে পারি। সেসব সম্পর্কে আগেও লিখেছি এবং বলেছি।

বাংলার বুলবুল, পল্লিসম্রাট, জনদরদি শিল্পী, সমাজসচেতন শিল্পী ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত আব্বাসউদ্দীনের কথা লিখলাম না। লিখলাম শুধু আমার আব্বার কথা যা এই মুহূর্তে মনে হলো যে আগে বলা হয়নি। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন নয়, মানুষ আব্বাসউদ্দীন আমার প্রাণপ্রিয় আব্বা।

আমার এই লেখা পড়লে দেখবেন বারবার আমার আব্বার কথা আসবে। তিনি আমার জীবনের সঙ্গে এত বেশি গভীরভাবে জড়িয়ে আছেন যে এখনো আমার চিন্তাভাবনা ও
দৈনন্দিন জীবনে তাঁকে যেন আমি অনুসরণ করি। তিনি যেন আমার সঙ্গে কথা বলেন। পরামর্শ দেন। হাসেন। মজা করেন। সাহস ও শক্তি দেন। অনুপ্রেরণাও দেন তিনি। সত্যি বলতে কি, আব্বা আমার জীবনকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন, সে বিষয়ে আমার কোনো ভাবনা ছিল না। যখন আমি আমার জীবনকে খেয়াল করলাম, দেখলাম, আব্বাই আমার জীবন গড়ে দিয়েছেন। আমি তেমন কিছুই করিনি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স কর ব জ র কর অন ষ ঠ ন কলক ত য় কর ছ ন ন আম র আম দ র বলত ন ন করত ন মকর র করত করত ন সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ