Prothomalo:
2025-09-17@21:07:58 GMT

ঐতিহ্যের উজ্জ্বল কান্ডারি

Published: 14th, April 2025 GMT

সাইদুর রহমান বয়াতি

বাংলাদেশের এ সময়ের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির কান্ডারিদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক বহুমাত্রিক সাধক হিসেবে সাইদুর রহমান বয়াতির নাম উচ্চারণ করা যায়। কেননা তিনি একাধারে সাধক কবি, পালাকার, পরিবেশনশিল্পী ও পরিবেশনশিল্পের পরিচালক; অন্যদিকে তিনি একজন উজ্জ্বলতম সুফি সাধক; এমনকি ঐতিহ্যগত তন্ত্রমন্ত্রের সাধক ও লোকায়ত চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর রয়েছে বিশেষ পরিচিতি।

সাইদুর রহমান বয়াতি মানিকগঞ্জ জেলার পুটাইল ইউনিয়নের পশ্চিম হাসলী গ্রামে ২৫ মে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তিনি মানিকগঞ্জের ভাষাশহীদ রফিক স্মরণে গান রচনা করেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করতে সক্ষম হননি। কিন্তু বাল্যকাল থেকে সংস্কৃতিচারী এই সাধক কবি ঐতিহ্যগত ধারায় প্রায় ৬০ প্রকারের সংগীত-বাণী রচনা, সুরকরণ ও পরিবেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জারি, সারি, মর্সিয়া, কীর্তন, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, ধুয়া, মালসি, তর্জা প্রভৃতি ঐতিহ্যগত সংগীতরীতিতে সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিবিধ সংকটে মানুষকে সাহস জোগাতে, উদ্বুদ্ধকরণে সংগীতের সমান্তরালে পুঁথিকাব্য রচনা ও পরিবেশন করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, করোনা মহামারির কাল নিয়ে তাঁর রচিত গান ও পুঁথিকাব্য মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।

সাইদুর রহমান বয়াতির সংগীত রচনা ও পরিবেশনের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের কবি জসীমউদ্​দীন, যুক্তরাষ্ট্রের ফোকলোরবিদ হেনরি গ্লাসি প্রমুখ। হেনরি গ্লাসি বিরচিত আর্ট অ্যান্ড লাইফ ইন বাংলাদেশ এবং ট্র্যাডিশনাল আর্ট অব ঢাকা শীর্ষক দুটি গ্রন্থে সাইদুর রহমান বয়াতির ছবিসহ পরিচিতি লভ্য। সংগীত রচনা, সুরসাধনা ও তা আসরে পরিবেশনের পাশাপাশি তিনি ঐতিহ্যগত বাদ্যযন্ত্র দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, খঞ্জনি, মন্দিরা-করতাল, একতারা, ঢোল, বায়া, চটি বা প্রেমজুড়ি প্রভৃতি বাদন ও প্রশিক্ষণ প্রদানে দক্ষ।

ঐতিহ্যগত পরিবেশন শিল্পকলার সঙ্গেও সাইদুর রহমান বয়াতি বাল্যকাল থেকে সম্পৃক্ত। মাত্র ১০ বছর বয়সে পারিবারিক সদস্যদের হাত ধরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন আসমান সিং যাত্রাদলে। যাত্রাদলে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি ‘ছবি রানী’ নাম ধারণ করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, সাজ গ্রহণের সুবিধার জন্য দুই কানের লতিতে ছিদ্র করেছিলেন, যা এখনো দৃশ্যমান। যাত্রাদলে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে তিনি নারীদের মতো হাতে রুপার চুড়ি, কানে ঝুমকা ও গলায় মালা পরে কাটিয়েছেন অনেক দিন। নারী চরিত্র হিসেবে তিনি সিরাজ-উদ-দৌলা যাত্রায় লুৎফা, হরিশচন্দ্র যাত্রায় শৈব্যা, হোসেন শহিদ যাত্রায় মায়মুনা, রঘু ডাকাত যাত্রায় মনিকা দেবী প্রভৃতি নারী চরিত্রে রূপদান করেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রায় ১০০টি যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন।

এই সাধক সামাজিক জীবনে লোকচিকিৎসক হিসেবেও পরিচিত। এ ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করেছেন। কেননা সমাজের সাধারণ ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের সুচিকিৎসার জন্য তিনি একদিকে প্রাকৃতিক জ্ঞান তথা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছগাছড়া, লতাপাতা, শিকড়বাকড়কে ব্যবহার করেছেন। জীবনের একটি পর্যায়ে সাইদুর রহমান বয়াতি খাগড়াছড়ি জেলার একজন সন্ন্যাসী রামানন্দ চাকমার কাছে তন্ত্রমন্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখনো তিনি রামানন্দ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তিন শতাধিক মন্ত্র মানবকল্যাণের জন্য স্মৃতিতে ধারণ করে চলেছেন। সাপের কামড় থেকে রক্ষার মন্ত্র, গরু-বাছুরের চিকিৎসার মন্ত্র প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে তিনি নিজের এলাকার জনগোষ্ঠীকে নানাভাবে উপকৃত করেছেন। 

সুফি সাধনায় দীক্ষিত এই সাধকের ঐতিহ্যিক পরম্পরায় জীবনের নানা পর্যায়ে দেহকেন্দ্রিক সাধনা, বিচিত্র সংগীত উপাসনা, লৌকিক ও মারেফতি আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে সামাজিক মানুষের আত্মিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একই সঙ্গে ইসলামি শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফতপন্থী ধর্মসাধনার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে অদ্যাবধি সংগীত, নৃত্য, কৃত্য, নাট্য ইত্যাদি চর্চা ও প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁর এই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সাধনার সঙ্গে হিন্দু, মুসলিম, বৈষ্ণব, বাউল, তান্ত্রিক, যোগাচারীদের নিবিড় মৈত্রী প্রত্যক্ষ করা যায়। অনন্য এই সাধক বাংলাদেশের বিচিত্র ধরনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির যেমন কান্ডারি, তেমনি এই ভূখণ্ডে আগত, জন্ম নেওয়া এবং চর্চিত বিচিত্র ধরনের ধর্ম, মত, ভাব, দর্শন ও পথের স্বচ্ছ অধিকারী।

ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। 

কৃপাসিন্ধু রায় সরকার.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য মন ত র কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে