ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করল হামাস
Published: 16th, April 2025 GMT
ইসরায়েলের দেওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস। ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির এ প্রস্তাবের আওতায় হামাসকে অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। খবর বিবিসির।
যুদ্ধবিরতির আলোচনায় সম্পৃক্ত একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে হামাসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কথা জানান। তিনি বলেন, হামাসের মূল চাওয়া হলো চূড়ান্তভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা। কিন্তু ওই প্রস্তাবে এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না বরং হামাসের হাতে থাকা জীবিত জিম্মিদের অর্ধেককেই মুক্তি দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা অব্যাহত থাকার মধ্যেই সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে এমন কথা জানা গেল।
ফিলিস্তিনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, মিসরের মাধ্যমে দেওয়া প্রস্তাবে স্পষ্টত হামাসকে নিরস্ত্র করার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু এতে ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তাই হামাস এ প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো আলোচনায় এবারই প্রথম ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হামাসকে নিরস্ত্র করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এটাকে ফিলিস্তিনি সংগঠনটির জন্য চূড়ান্ত সীমারেখা (রেডলাইন) হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ইসরায়েল সময়ক্ষেপণ করছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছে। হামাসের হাতে থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের উদ্ধার করার চেষ্টায় এমনটা করা হচ্ছে।
হামাস জানিয়েছে, তাদের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দিতে তারা প্রস্তুত। তবে এর বিনিময়ে তারা যুদ্ধের সমাপ্তি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার চান।
এর মধ্যে বিবিসি জানতে পেরেছে, মিসরের মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সামনে আনা হয়েছে। সেটা বিবেচনা করছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। যদিও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনার বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেনি।
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার ও নৃশংস হামলার ১৮ মাস চলছে। জাতিসংঘের সতর্কতা, এই ১৮ মাসের মধ্যে এখন গাজার মানবিক পরিস্থিতি সবচেয়ে বাজে অবস্থায় রয়েছে।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে ওয়াশিংটনে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন। এর কয়েক দিন পরই গত সপ্তাহের শেষের দিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের কাছে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
এরপর বিষয়টি নিয়ে প্রধান আলোচক খলিল আল-হায়ার নেতৃত্বে হামাসের একটি প্রতিনিধিদল মিসরের রাজধানী কায়রোয় দেশটির গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র কর মকর ত প রস ত ব
এছাড়াও পড়ুন:
রেনু বেগমের ‘বুকভাসা চোখের পানি’ কেন
‘৩২ বছর ধরে পঙ্গু স্বামীক নিয়া ঘর করি। শ্বশুরের ১৪ একর জমি ছিল। সোগ নদীতে গেইচে। অগেও দুইবার বাড়ি ভাঙছে। এ বছরও বাড়ি ভাঙি যাইবে। খালি আল্লাহর কাছে কান্দি আর কই, আল্লাহ হামাক বাঁচান। হামার বাড়িটা ভাঙি যায়, তবুও কেউ রক্ষা করিল না।’ ঈদের আগের রাতে রেনু বেগম কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের বুড়িরহাটে তিস্তা নদীসংলগ্ন রেনু বেগমের বাড়ি। তাঁদের বাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে, এ খবর পেয়ে ঈদের আগের রাতে সেখানে গিয়েছিলাম। রেনু বেগম ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনে দুইবার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তৃতীয়বার ৫৯ ভোটে হেরেছেন। তাঁর হেরে যাওয়ার পরের বছর বাড়ি ভাঙতে শুরু করে। তাঁর থাকার টিনের ঘরের একাংশ বর্তমানে ভাঙনের মধ্যে পড়েছে। রেনু বেগমকে সহায়তা করার কেউ নেই। বরং এক মেয়ে ঘরজামাইসহ থাকেন। আরেক মেয়ে বিধবা হয়েছেন। তাঁর মেয়েকেও পালনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
ঈদের আগের রাতে রেনু বেগমের বাড়ি রক্ষা করা যাবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। এটা বুঝতে পারছিলাম, বাড়িটি রক্ষা করতে হলে রাতেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তিস্তায় কখন পানি বাড়বে, এটি বলা কঠিন। ঈদের রাতে ফোন দেওয়ার বিষয়ে উচিত-অনুচিত না ভেবে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানকে ফোন দিই। বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করি। আরও কয়েকজন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর সঙ্গেও কথা বলি। রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী আমাকে জানান, রাতেই কাজ শুরু করবেন। কখন কাজ শুরু হবে, আমি সেই অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষার ফাঁকে রেনু বেগমের সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হয়।
রেনু বেগম এখন যে বাড়িতে আছেন, তাঁর গোয়ালঘর গত বছরে ভেঙে গেছে। এ বছর ভেঙেছে রান্নাঘর। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন রেনু বেগমরা। নদীর ভাঙনে নিঃস্ব। তাঁদের অনেক জিনিসপত্র ছিল। সেগুলো ছিল রান্নাঘরে। কয়েক দিন আগে রাতে বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ ছিলেন না। প্রচণ্ড ঝড় ছিল। সারা রাত বাতাস। বাড়িও নদীসংলগ্ন। জোরে জোরে কেঁদে কেবল আল্লাহকে ডেকেছেন রেনু বেগম। বাতাসে ঘরের চাল উড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে আরও আতঙ্কিত হয়েছেন।
একটি ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে। এমন শব্দ শুনে তিনি এক মেয়ে ও তিন নাতনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সকালে উঠে দেখেন, তাঁর রান্নাঘর সম্পূর্ণটাই নদীতে চলে গেছে। চেয়ার-টেবিলসহ অনেক ফার্নিচার, প্রয়োজনীয় আসবাব—কিছুই ধরে রাতে পারেননি। মুরগি ছিল, সেগুলোও আর পাননি। রেনু বেগম বলেছিলেন, ‘আমি অনেককে বলছিল, বাহে হামার বাড়িটা বাঁচে দাও। মানুষের মনে কোনো মায়া নাই। যদি মানুষের জন্য মায়া না থাকে, তাহলে তারা কিসের মানুষ? রাইতে ঘুমাই না। কখন যে বাড়ি ভাঙি যায়, সেটাই ভয়।’
প্রতিবছর নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলোর আর্থিক ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান রাখা না হলেও সেই ক্ষতি নিয়ে কথা হয়। ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করারও চেষ্টা হয়। কিন্তু নদীভাঙনে যে মানবিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কি পরিমাপ করা যায়? নদীপারের একজন মানুষেরও বাড়ি নদীগর্ভে আর বিলীন না হোক। নদীভাঙনের বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হোক। রেনু বেগমদের বুকে যেন চোখের পানি আর না জমে।আকাশে মেঘ তখন চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। রাতও গভীর হচ্ছিল। নদীর দিকে ঘন অন্ধকার। আমার সঙ্গে হামিদুল নামের একজন গিয়েছিল। তার কথার স্বরে বুঝতে পারছিলাম, সে রেনু বেগমের এই কষ্টের কথা নিতে পারছে না। আমি রেনু বেগমের সঙ্গে যতই কথা বলছিলাম, আমার বুকটাও কষ্টে ভারী হয়ে উঠছিল। একের পর এক কষ্টের কথা বলছিলেন তিনি। একজন মানুষ কত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে?
পরিবারের জন্য অন্যের বাড়িতে প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন তিনি। ওই বাড়িতে একবার লোহার শলাকা ওপর থেকে মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। দুই দিন জ্ঞান ফেরেনি। তাঁর নাকি বাঁচারই কথা ছিল না। মাথায় হাত দিয়ে ক্ষতের জায়গা দেখাচ্ছিলেন রেনু বেগম।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য তাঁর অন্য আত্মীয়ের খবর জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন আরেক কষ্টের ঝুড়ি খুললেন। তাঁর স্বামীরা ছয় ভাই ছিলেন। নদীভাঙনের কবলে পড়ে একেকজন একেক দিকে গেছেন। এক ভাই চলে যান কুমিল্লায় কাজ করতে। সেখানেই মারা গেছেন। এক ভাই কাজের সন্ধানে যান দিনাজপুরে। এক ভাই রাজারহাটে অন্য খানে কাজ করেন। দুই ভাই ১০ শতক জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন। এই বাড়ি ভেঙে গেলে তাঁরা চলে যাবেন ঢাকায়। ঢাকায় কোথায় যাবেন, কী করবেন, তা তিনি জানেন না।
ঈদের দিন কী করবেন, এ কথা জিজ্ঞেস করতেই আবারও কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘খাওয়ার কিচ্ছু নাই। বাপের বাড়ি থাকি আইজ ৫০০ টাকা আনছি। কী করমো, জানি না। আল্লাক কই, আল্লাহ হামাক তুলি নেও। আমার বুকভরা চোখের পানি। আমার কোনো সুখ নাই বাবা।’ এরই মধ্যে যাঁরা নদীভাঙন রোধে কাজ করেন, তাঁদের একজন এসে হাজির হন। প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান তাঁকে পাঠিয়েছেন।
মাহবুবুর রহমান রংপুর থেকে ঈদের রাতে ৪০ কিলোমিটার দূরে বুড়ির হাটে আসতে চেয়েছিলেন। কাজ শুরু হওয়ায় আর আসতে হয়নি। প্রকৌশলীদের সম্পর্কে হাজারও খারাপ কথার মধ্যে তাঁর আন্তরিকতাটুকু মনে রাখার মতো। তিনি কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ভাঙন বন্ধে কাজের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চান, তিস্তায় যেন একটি বাড়িও না ভাঙে। তার জন্য যে ব্যবস্থা নিতে হয়, তিনি তা-ই সে ব্যবস্থা নিতে চান।
বাড়িটি আর কতদিন টিকে থাকবে