রাজশাহীর পদ্মা নদীজুড়ে দেখা যায় শুধু ধু-ধু বালু চর। আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্তির পথে দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। কিছু জায়গায় গভীর পানি থাকলেও কারেন্ট জাল ও বড়শি ফেলে নির্বিচারে চলছে মাছ নিধনযজ্ঞ। তাই শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর কিছু অংশে জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণার পরামর্শ নদী গবেষকদের।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সালের দিকে পদ্মার গড় গভীরতা ছিল ১২ দশমিক ৮ মিটার। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় গভীরতা নেমে আসে ১১ দশমিক ১ মিটারে। পদ্মার গভীরতা কমায় আবাস সংকটে পড়ছে মাছ ও জলজ প্রাণী। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্প্রিঙ্গার উদ্যোগে কাজ করেছেন রাজশাহীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষক। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশনের গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
সরেজমিন চারঘাট উপজেলার রাওথা, বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ ও গোদাগাড়ীর হরিশংকরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা যে দেশের বৃহত্তম নদী তা চেনার উপায় নেই। চারদিকে ধু-ধু বালু চর। মাঝেমধ্যে কিছু জায়গায় পানি দেখা যাচ্ছে। সে সামান্য পানিতে কেউ বড়শি আবার কেউ কারেন্ট জাল ফেলে মাছ শিকার করছেন। ধরা পড়ছে বিশাল সাইজের বাঘাইড়, পাঙাশ, রুই, কাতলা, চিতল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ।
বাঘার মীরগঞ্জ এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, বড়শি ও কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ নির্বিচারে ধরা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে অন্তত ২৫টি কাতলা ও চিতল মাছ ধরা পড়েছে। যেগুলোর ওজন ১২-১৮ কেজি। কারেন্ট জালে একটা শুশুকও ধরা পড়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন মাছ শিকারে আসছে।
গোদাগাড়ীর হরিশংকরপুর এলাকার জেলে আব্দুল মান্নান বলেন, পদ্মা নদী চেনার উপায় নেই। নদীতে এত কম পানি আর কখনও দেখিনি। মৌসুমি জেলেরা বড়শি ও কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ শিকার করছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে পদ্মায় মাছ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।
মৎস্য অধিদপ্তর রাজশাহী জেলার তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে মাছ আহরণ হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৪০ টন, ২০২১-২২ এ হয়েছিল ২ হাজার ১৫২ টন, ২০২০-২১ এ ২ হাজার ২২১ টন এবং ২০১৯-২০ এ আহরণ হয়েছিল ২ হাজার ২৮৩ টন। প্রতিবছরই মাছ আহরণের পরিমাণ কমছে। গত পাঁচ বছরে মাছ আহরণ কমেছে ৪৩৩ টন।
গবেষকরা বলছেন, পদ্মা নদী থেকে হারিয়ে যাওয়া মৎস্য প্রজাতির ৬০ শতাংশ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ নির্বিচারে শিকার ও আবাস হারানো। ১৯৮০ সালে পদ্মায় যেখানে ৭১ জেলে মাছ শিকার করতেন, ২০১৯ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬১৬। প্রায় চার দশকে মাছ শিকারি বেড়েছে প্রায় ৩৮ গুণ। অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় প্রতিবছর একটি বড় অংশের জনগোষ্ঠী যোগ হচ্ছে এ পেশায়। অনেকে আবার নিষিদ্ধ কারেন্ট জালে মাছ শিকার করছে। এতে নির্বিচারে শিকার হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এসব কারণে পদ্মার সার্বিক জীববৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.
জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওয়ালি উল্লাহ মোল্লাহ বলেন, ‘পদ্মায় পানির গভীরতা কমেছে, পানির ফিল্টারেশন কমে গেছে। এতে বড় সাইজের রুই, কাতলা, চিতল ধরা পড়ছে। মা মাছ ধরার ব্যাপারে জেলেদের আমরা সতর্ক করছি। শুধু শুষ্ক মৌসুমের জন্য গভীর পানির কিছু অংশকে অভয়ারণ্য ঘোষণার চেষ্টা চলছে। নয়তো পদ্মা থেকে দেশীয় প্রজাতির এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদী বড়াল নদের মাধ্যমে সরাসরি চলনবিলের সঙ্গে জড়িত। পদ্মা নদীতে পানি না থাকায় চলনবিলেও পানি নেই। এর প্রভাব পড়েছে পদ্মার সঙ্গে সংযুক্ত পুরো জীববৈচিত্র্যের ওপর।
দেশীয় মাছের বৃহত্তম আশ্রয়স্থল চলনবিল ও পদ্মা নদীর মাছ ও জলজ প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। সরকারি উদ্যোগে খুব দ্রুত পানিপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি গভীর পানির জায়গাগুলো অভয়ারণ্য ঘোষণার দাবি জানান তিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ছ ও জলজ প র ণ পদ ম র পদ ম য় মৎস য
এছাড়াও পড়ুন:
মুক্তিপণ দিয়েও পাঁচ মাস ধরে ১৪ তরুণের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনেরা
অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১৪ তরুণ। কিন্তু দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঁচ মাস ধরে তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বজনদের দাবি, দালালের প্রলোভনে পড়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণও দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সন্ধান না পাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।
ইউরোপের কোনো দেশে গেলে সচ্ছলতা আসবে, এমন ধারণা নিয়ে প্রতিবছর মাদারীপুর থেকে শত শত তরুণ সেখানে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। তবে অবৈধ পথে ইউরোপ যেতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কেউবা দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত ৩৫০ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক।
সবশেষ নিখোঁজ তরুণদের সবার বাড়ি রাজৈরের বাজিতপুর ইউনিয়নে। তাঁরা হলেন পাখুল্লা গ্রামের জাহাঙ্গীর ব্যাপারীর ছেলে সালমান ব্যাপারী, চৌরাশী গ্রামের মোসলেম শিকদারের ছেলে বাবুল শিকদার, একই গ্রামের মজিবর বয়াতীর ছেলে সাজ্জাদ বয়াতী, জাকির মাতুব্বরের ছেলে বাদল মাতুব্বর, কানাই রায়ের ছেলে লিটন রায়, নিরঞ্জন বাড়ৈর ছেলে বাঁধন বাড়ৈ, কিসমদ্দি বাজিতপুর গ্রামের আলম চৌকিদারের ছেলে ইমন চৌকিদার, অহিদুল মাতুব্বরের ছেলে নয়ন মাতুব্বর, আজিজ খালাসির ছেলে খলিল খালাসি, সোনা মিয়া চৌকিদারের ছেলে সোহেল চৌকিদার, নয়াকান্দি বাজিতপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ বাড়ৈর ছেলে গৌতম বাড়ৈ, একই গ্রামের সামচু সরদারের ছেলে ইমরান সরদার, শ্রীনাথদী বাজিতপুরের জলিল বয়াতীর ছেলে আল আমিন বয়াতি ও শ্রীনদী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ঘরামির ছেলে আলী ঘরামি। তাঁদের সবার বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে।
স্বজনদের অভিযোগ, মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য বাজিতপুর এলাকার বাবুল হাওলাদার ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে প্রথমে ১৬ লাখ টাকা করে নেন। পরে লিবিয়ায় বন্দী করে আদায় করেন আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এর পর থেকে ঘরে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত বাবুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
মাদারীপুরের ১৪ তরুণ ইতালি যেতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দালালের হাত ধরে ঘর ছাড়েন। নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে তাদের ছবি হাতে স্বজনেরা