দেশের ৬৪ জেলা সদরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়নি ১৬ বছরেও। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৪১টি জেলায় ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে নির্মিত ভবন স্থানীয় আইনজীবীদের অনাগ্রহে ৯ বছরেও উদ্বোধন করা যায়নি। জেলা আদালত থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এ ভবন নির্মাণ হওয়ায় আইনজীবীরা সেটি ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছেন। অথচ ভবনটি নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয়ছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা।
এদিকে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অন্তত ২৫ জেলার বিভিন্ন আদালতে দেড় শতাধিক বিচারককে এজলাস ভাগ করে বিচারকাজ পরিচালনা করতে হচ্ছে। দুপুরে একটি আদালতের বিচারকাজ শেষে একই এজলাসে বিকেলে অন্য আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে বিচারিক কর্মঘণ্টা অপচয়ের পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদেরও ভোগান্তি হচ্ছে।
আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, ৬৪ জেলা সদরে বহুতলবিশিষ্ট সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। প্রথম পর্যায়ে তিন দফায় পাঁচবার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এর আওতায় ৪১ জেলায় ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। বাকি ২৩ জেলায় ভবন নির্মাণের জন্য এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের সারসংক্ষেপ চূড়ান্ত করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে গত বছরের জুনে পরিকল্পনা কমিশনে আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় ওই প্রস্তাব পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। এর আলোকে সুপারিশ বাস্তবায়নে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) মেহেদী হাসান সমকালকে বলেন, ডিপিপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। এটি শিগগিরই পরিকল্পনা কমিশন হয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। জুনের মধ্যে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। তিনি জানান, আগামী অর্থবছরের শুরুতেই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এদিকে সিজেএম ভবন নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে জেলা জজদের প্রতি দেওয়া অভিভাষণে উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সুপ্রিম কোর্টে গত ২১ অক্টোবর দেওয়া ভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বর্তমানে অনেক জেলায় বিচারকদের চেম্বার ও এজলাস শেয়ার করতে হয়। ফলে কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহার করতে না পারায় মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা কমে যায়।’
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে গাজীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ ২২টি জেলায় জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলেও ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। স্থানীয় বিরোধে সৃষ্ট আইনি জটিলতায় খাগড়াছড়িতে জমি অধিগ্রহণ থমকে আছে। ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী, পাবর্ত্য জেলায় ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক আইন রয়েছে। বিষয়টি জটিল হওয়ায় সম্প্রতি ভূমি অধিগ্রহণ আইন এবং পার্বত্য ভূমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত দুটি আইন সমন্বয় করে জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
২৩টি জেলায় আদালত ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। জেলাগুলো হলো– গাজীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নরসিংদী, শেরপুর, নেত্রকোনা, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ফেনী, চাঁদপুর, কক্সবাজার, নাটোর, নওগাঁ, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বাগেরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও বরগুনা। ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৮ সালের জুনে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
এদিকে বগুড়া, পঞ্চগড়, পাবনা, ভোলাসহ অনেক জেলায় আদালত ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রণালয় থেকেও পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়মের চিত্র দেখে স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। যারা সদুত্তর দিতে পারেননি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আর্থিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাপ্তরিক প্রাক্কলন ও অগ্রগতির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, একক প্যাকেজটির কার্যক্রম বিভক্ত করা হয়েছে, চুক্তিতে অত্যাবশ্যকীয় কিছু কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে, বাস্তব কাজের পরিমাণ ও পরিমাপ কমানো হয়েছে, ইন্টারনাল স্যানিটারি ও ওয়াটার সাপ্লাই এবং ইন্টারনাল ইলেকট্রিফিকেশন কাজের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে একেবারেই অপ্রতুল অর্থের প্রাক্কলন করায় ব্যয় অত্যধিক বেড়েছে। এ ধরনের অনিয়মের দায়ভার প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
নারায়ণগঞ্জের নতুন সিজেএম ভবন ব্যবহার থেকে আইনজীবীদের বিরত থাকা প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সরকার হুমায়ূন কবির সমকালকে বলেন, ‘দুই আদালত দুই জাগায়। যাওয়া-আসা, সময়, যানজট ইত্যাদি সমস্যার কারণে সিজেএম আদালত ভবন ব্যবহার থেকে আইনজীবীরা বিরত রয়েছেন। তবে সরকার চাইলে নতুন ভবনটি চালু করা সম্ভব।’ তাঁর মতে, সিভিল মামলাগুলো বিদ্যমান (পুরোনো) আদালতে এবং নতুন ভবনে জজ আদালতসহ ফৌজদারি-সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার করা হলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর পর নতুন আদালতের পাশে আরও ভবন নির্মাণ করে পুরোনো আদালতকে নিয়ে আসতে হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভবন ন র ম ণ প রকল প র প রস ত ব ব যবহ র আইনজ ব র জন য পর য য় স জ এম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরাও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে: হাইকোর্ট
শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ দিতে পারবে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নেওয়া সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি রেজাউল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ সোমবার এ রায় দেন।
একই সঙ্গে ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালার আলোকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে পরীক্ষার আয়োজন করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষা আগামী ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
আইনজীবীদের তথ্যমতে, শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গত ১৭ জুলাই এক স্মারকে জানায়। এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কেরানীগঞ্জ পাবলিক ল্যাবরেটরি স্কুলের পরিচালক মো. ফারুক হোসেন, শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিসহ ৪২ জন চলতি বছর রিটটি করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রুল দিয়ে ওই স্মারকের কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য স্থগিত করেন। শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতিসংক্রান্ত ১৭ জুলাইয়ের ওই স্মারক (ম্যামো) কেন আইনগত কর্তৃত্ব–বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালার আলোকে বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়।
আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী নিয়াজ মোর্শেদ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষে আইনজীবী মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ ইজাজ কবির।
পরে আইনজীবী নিয়াজ মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ দিতে পারবে বলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গত ১৭ জুলাইয়ে স্মারক অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালা অনুসারে সব বেসরকারি অর্থাৎ বেসরকারি নিম্নমাধ্যমিক, রেজিস্ট্রার্ড কিন্ডারগার্টেন, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রেজিস্টার্ড/অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত/স্থাপনা ও প্রাথমিক অনুমতিপ্রাপ্ত চালু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এ জন্য ১৫ দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের ফলে শুধু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই নয়, এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে।
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা ১৯৮১ সালে প্রবর্তন করা হয় বলে জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আইনজীবী মুনতাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এটি চলে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নতুন নীতিমালার আলোকে পিএসসি পরীক্ষা হয়। এতে যারা ভালো করত, তাদের বৃত্তি দেওয়া হতো। তবে করোনার সময় ২০২০ ও ২০২১ সালে তা বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে আবার বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হয়, তবে তা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার নীতিমালার (সংশোধিত–২০১৬) আলোকে। বিভিন্ন কারণে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এটি বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২৫ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। বেসরকারি শিক্ষার্থীরাও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে—এমন নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তারা যাতে পরীক্ষা দিতে পারে সে জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে।