আনুপাতিক উচ্চকক্ষ, এনসিসি ও গণভোটে রাজি নয় বিএনপি
Published: 20th, April 2025 GMT
সাধারণ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ও গণভোট এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনে শক্ত আপত্তি আছে বিএনপির। তারা এ বিষয়ে কোনো আপসও করবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এবং রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে চলমান আলোচনায় আজ রোববারের নির্ধারিত আলোচনায়ও বিএনপি এই অবস্থান তুলে ধরবে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দলটি কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছিল।
বিএনপি মনে করছে, ভোটের অনুপাতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন এবং সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন বাধ্যতামূলক করা হলে নির্বাচিত সংসদের ক্ষমতা কমে যাবে।
আবার সংবিধানের যে কোনো সংশোধনের জন্য গণভোট বাধ্যতামূলক হলে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবারের সংলাপে বিএনপি স্পষ্ট জানিয়েছে, এনসিসি গঠনে তারা রাজি নয়। তবে এ বিষয়ে সেদিন বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আজ এই আলোচনার কথা রয়েছে।
বিএনপির আশঙ্কা, এনসিসি গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারের ক্ষমতা কমে যাবে। আবার সংসদ ভেঙে দেওয়া অবস্থায় উচ্চ ক্ষমতার এই এনসিসির জবাবদিহির কোনো কাঠামো থাকবে না। আবার নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত এনসিসি চাইলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করারও সুযোগ থাকবে।
সংস্কারের জন্য গঠিত পাঁচ কমিশনের ১৬৬ সুপারিশের মধ্যে– আনুপাতিক ভোটে উচ্চকক্ষ ও এনসিসি গঠন বড় পরিবর্তন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এই দুই সুপারিশকে মৌলিক সংস্কার মনে করছে এবং তা সমর্থন করছে। জামায়াতে ইসলামীও আনুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের সুপারিশে একমত। দলটি এনসিসি গঠনেও রাজি। তবে তারা প্রস্তাব করেছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনসিসি বিলুপ্ত হবে। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সাংবিধানিক কাউন্সিল থাকবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, এনসিসি গঠিত হলে সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব হবে। আবার যখন নির্বাচনকালীন সংসদ থাকবে না, তখন সর্বময় ক্ষমতার এনসিসি রাষ্ট্রের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। তাই বিএনপি এনসিসি গঠনে একমত নয়। তিনি বলেন, আশপাশের কোনো দেশে এমন বিধান নেই। বাংলাদেশেও এমন চর্চা নেই। নতুন করে কিছু চাপিয়ে দিলে তা সমাধানের বদলে সমস্যা তৈরি করতে পারে। গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে দেশ যখন একটি পর্যায়ে উপনীত হবে, তখন এসব বিষয়ে ভাবা যাবে।
অবশ্য ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড.
সংবিধান সংস্কার
সংবিধান সংস্কার কমিশনের ৭০ সুপারিশের মধ্যে ১৪টিতে একমত এবং নীতিগতভাবে একমত বলে জানিয়েছে বিএনপি। দলটি ছয়টি সুপারিশের সঙ্গে আংশিক একমত পোষণ করেছে। বিএনপি যে সুপারিশগুলোর সঙ্গে একমত নয়, সেগুলো নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কেন একমত নয়, তার যুক্তি তুলে ধরে।
কমিশন যেসব সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি আংশিক একমত, সেগুলোতে কেন পুরোপুরি একমত নয়, তা জানতে চেয়েছে। বিএনপি কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। বাকিগুলো আজকের আলোচনায় উঠবে।
সংবিধান সংস্কারের তিনটি সুপারিশের বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানানোর কথা বলেছিল বিএনপি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, রোববারের আলোচনায় বিএনপি একই অবস্থানে থাকবে। নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকতে হবে।
যদিও ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, প্রাণবন্ত আলোচনা হচ্ছে। বিএনপিকে অনড় মনে হয়নি। তারা প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে বিস্তারিত মতামত জানাচ্ছেন। কমিশনও কিছু বিষয়ে দলটির মতামতকে গ্রহণ করেছে।
সংস্কারের সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়েও বড় মতপার্থক্য রয়েছে। কমিশন জানতে চেয়েছিল, সুপারিশ বাস্তবায়নে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। বিকল্প হিসেবে বলা হয়েছে, অধ্যাদেশ, নির্বাচনের আগে গণভোট, নির্বাচনের সময় গণভোট, গণপরিষদে ভোটাভুটি, নির্বাচনের পর সাংবিধানিক সংস্কার নাকি গণপরিষদ এবং নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে।
বিএনপি সংবিধান সংস্কারের যেসব সুপারিশে একমত ও আংশিক একমত হয়েছে, সেগুলো আগামী সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চায়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার গঠন প্রক্রিয়াও সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করার পক্ষে তারা।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে ঘোষিত বিএনপির ৩১ দফায় উচ্চকক্ষের প্রস্তাব রয়েছে। দলটির সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি চায় বিদ্যমান পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে যেভাবে সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টন করা হয়, উচ্চকক্ষের আসনও সেভাবে বণ্টিত হবে।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪০ দশমিক ৮ এবং আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। এ দুই সংসদে সংবিধানে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
৪০-৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আসন পেয়েছিল দল দুটি। এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সংবিধানের যথেচ্ছ কাটাছেঁড়া রোধে সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে। সুপারিশ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধন বিলে সংসদের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র সমকালকে বলেছে, সংবিধানকে সুরক্ষা দিতে আনুপাতিক ভোটে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন এবং সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনে বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, এভাবে স্বৈরাচার রোধ করা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করলে সংবিধানে যথেচ্ছা বদলের আশঙ্কা থাকে না। সেদিকেই যেতে হবে।
বিদ্যমান সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বাদে বাকি সব কাজ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে বাধ্য। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ স্বতন্ত্র আইনের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে আদতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ীই নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
এ একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল থেকে উচ্চ ও নিম্নকক্ষে নির্বাচিত ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার বাইরে দল থেকে একজন করে সংসদ সদস্য নিয়ে ৯ সদস্যের এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। একই সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও।
সুপারিশ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে। এনসিসি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান এবং তিন বাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ করা হবে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও নিয়োগ হবে এনসিসির মাধ্যমে।
নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে এখনও মতামত জানায়নি বিএনপি। দলটির সূত্র জানিয়েছে, তারা ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহাল চায়। যাতে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসে। দলের একজন নেতা বলেছেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে বিএনপি রিভিউ আবেদন করেছে। বিএনপি আশা করছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে। তাই এনসিসির মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ভাবনা তাদের নেই।
কমিশন সুপারিশ করেছে, সংসদ ভেঙে গেলেও এনসিসি বিলুপ্ত হবে না। নির্বাচনকালীন রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং প্রধান উপদেষ্টার মনোনীত দু’জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের এনসিসি গঠিত হবে।
বিএনপির মূল্যায়ন হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং তাঁর মনোনীত দুই উপদেষ্টাকে সদস্য করার এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রস্তাবিত এনসিসিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবেন অনির্বাচিত ব্যক্তিরা। একে ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত বিএনপি নেতারা। সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, অতীতে কী হয়েছে, তা মাথায় রেখে এত নিয়মকানুন লিখে গণতন্ত্র হয় না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে যথাযথ চর্চার মাধ্যমে এগোতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ ন র ব চনক ল ন স স প র শ কর ছ ন উপদ ষ ট র র শ অন য য় র ষ ট রপত প রস ত ব সরক র র র ক ষমত ব যবস থ র মত মত ব চ রপত ব এনপ র সদস য র গণভ ট এনস স অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট, একমত ইউনূস ও তারেক
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটেছে।
গতকাল শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে লন্ডন বৈঠক নিয়ে দেশে যে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা ছিল, সেটার সমাপ্তি ঘটেছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। এর মধ্যেই ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার–ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের এক সপ্তাহের মাথায় লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নতুন ঘোষণা এল। ধারণা করা হচ্ছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘটনাকে বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট। দলগুলো বলেছে, এর মাধ্যমে জাতি ‘স্বস্তির বার্তা’ পেয়েছে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনা ছিল। সেটা কেটে গেছে, গোটা জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। অধ্যাপক ইউনূস দুঃসময়ে জাতির অভিভাবক হিসেবে নিজের বিশালত্ব, গভীরতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি নেতা তারেক রহমানও যথোচিত সৌজন্যবোধ, পরিণত বুদ্ধি ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বলেন, বিচার বা সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বড় ধরনের মতপার্থক্য নেই। মতপার্থক্য ছিল নির্বাচনের সময় নিয়ে। দুজনের (ইউনূস-তারেক) বৈঠকের পর এই মতপার্থক্যও অনেকটা কমে এসেছে।
যদিও লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় সমঝোতা হয়েছে এবং সেটি যেভাবে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁদের ভিন্নমত নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে সরকারের সমঝোতায়ও তাঁরা অসন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন এক জায়গায়। সেটি হচ্ছে, সরকার এভাবে একটি দলের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দিতে পারে কি না? এটা কতটা নৈতিক।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এনসিপি মনে করে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
গতকাল যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে সেখানকার সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। তাঁরা প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলেন। এর মধ্যে বড় একটি সময় অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান একান্তে বৈঠক করেন। পরে ওই হোটেলেই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও তারেক রহমানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। একান্ত আলোচনায় দুই নেতা ‘সন্তুষ্ট’ হয়েছেন বলে তাঁরা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বিবৃতি (সরকার ও বিএনপি) পড়ে শোনান নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তাতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।
প্রশ্নোত্তরে যা বললেন সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধিপরে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সাংবাদিক জানতে চান, তাহলে কি সরকার এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে সরে আসছে? জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় এই বিষয়টি সুস্পষ্টই বলা আছে। আপনারা শুনেছেন। যদি সব কাজ সময়মতো আমরা করতে পারি এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা করা যেতে পারে।’
তাহলে নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণে সমস্যাটা কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি দুই পক্ষই। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ছাড়া লন্ডন বৈঠকে আর কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এ ছাড়া সংস্কার, বিচার, জুলাই ঘোষণা নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।
তবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব বিষয়ে আলোচনা তো হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। আমরা সবাই চাই, দেশ গড়ার যে প্রত্যয় আমরা নিয়েছি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই কাজটা করব। বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা সবাই ঐকমত্যে এসেছি, শুধু নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও সেটা আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে তো ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে দেশে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত আছে যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে। সংস্কারের ব্যাপারেও একই উত্তর আমাকে দিতে হয় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা সংস্কার ও জুলাই সনদ—দুটোই করব। সবার ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং আমি নিশ্চিত, খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে আলোচনার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ এ প্রশ্নে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এটা তাদের (এনসিপি) জিজ্ঞেস করুন। প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত আছে। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিচারপ্রক্রিয়া তিনি শেষ করতে চান এবং পরে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কি না, সেটা হয়ে থাকলে নির্বাচনের রূপরেখায় এর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, ‘যৌথ বিবৃতিতে এর উত্তর দেওয়া আছে। সংস্কার এবং বিচার; দুই বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে এবং আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাসী) যে এই অগ্রগতি আমরা নির্বাচনের আগেই দেখতে পাব।’
তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা তিনি কবে দেশে ফিরতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আলোচনার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমরা মনে করি না। তারেক রহমান সাহেব যখনই ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। সুতরাং এটার সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন, সময়মতো।’
সংবাদ সম্মেলনে শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বৈঠকে আলোচনায় আপনারা কি সন্তুষ্ট?’ সমস্বরে এ প্রশ্নের জবাব দেন খলিলুর রহমান ও আমীর খসরু মাহমুদ। দুজনই বলেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট।’ এর সঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘আমরা তো বলছি নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পরও নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ এরপর খলিলুর রহমান বলেন, ‘সন্তুষ্ট না হলে তো যৌথ ঘোষণা আসার কথা নয়।’
‘চারদিকে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটা কেটেছে’অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর ঢাকায় বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বৈঠক সফল হয়েছে। সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থাকে কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।
মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনের বৈঠকের পর তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় তারেক রহমান দলের নেতা–কর্মীদের অভিনন্দন ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। একই সঙ্গে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তাঁর মা ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিএনপির মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি (ইউনূস) তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবকিছু একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনের দিকে ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা।