উচ্চশিক্ষায় আউটকামভিত্তিক শিক্ষার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
Published: 26th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে চালু হয়েছে আউটকামভিত্তিক শিক্ষা (আউটকামবেজড এডুকেশন-ওবিই)। এই কাঠামো উচ্চশিক্ষাকে আরও দক্ষ, জবাবদিহিমূলক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। তবে তাড়াহুড়ো না করে, এই শিক্ষা কাঠামোর প্রয়োগ প্রশ্নে দেশীয় প্রেক্ষাপটে পরিপক্বতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া জরুরি। নিছক বিদেশি মডেল অনুসরণ না করে, আমাদের নিজস্ব শিক্ষাদর্শন, ঐতিহ্য ও প্রাত্যহিক বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে ওবিই বাস্তবায়ন করতে হবে।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা দেখায় সুস্পষ্ট দর্শন, কাঠামো এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির সমন্বয় ছাড়া এই মডেল টেকসই হয় না। উদাহরণস্বরূপ, আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে কে-১২ স্তরে ওবিই চালুর সময় কিছু অভিভাবক, শিক্ষক ও নীতিনির্ধারকের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, নির্ধারিত আউটকাম শিক্ষার স্বাভাবিক প্রবাহে কৃত্রিম কাঠামো চাপিয়ে দেয়, শিক্ষককে পেশাগতভাবে সীমাবদ্ধ করে এবং শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত অনুসন্ধানী মানসিকতা বাধাগ্রস্ত করে। এই প্রেক্ষাপটে ওবিইর প্রবক্তা সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম স্প্যাডি তাঁর মডেলে পরিবর্তন আনেন। তিনি চারটি মূল নীতির ওপর জোর দেন– ১) শিক্ষার উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে নির্ধারণ, ২) ব্যাকওয়ার্ড কারিকুলাম ডিজাইন, ৩) উচ্চ প্রত্যাশা তৈরি এবং ৪) বিস্তৃত শেখার সুযোগ নিশ্চিত করা। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, নির্ধারিত আউটকাম দিয়ে কি জ্ঞানের জটিলতা, অনুসন্ধানী মন ও নৈতিক বোধের বিকাশ সম্ভব?
অনেক শিক্ষাবিদের মতে, অতিমাত্রায় নির্দিষ্ট আউটকাম এবং তা মূল্যায়নের জন্য রুব্রিকনির্ভর পদ্ধতি শিক্ষাকে প্রায়ই ‘টিক মার্ক’নির্ভর প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে। সাহিত্য, ইতিহাস বা নৈতিকতা শিক্ষার মতো বিষয়কে সম্পূর্ণভাবে কাঠামোবদ্ধ ও পরিমাপযোগ্য আউটকামে বাঁধা প্রায় অসম্ভব। একইভাবে সৃজনশীলতা, নেতৃত্বগুণ বা অনুসন্ধানী মনোভাবও রুব্রিকের গণ্ডিতে পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এসব গুণ অনুভব ও অনুধাবনের বিষয়। ফলে ওবিই শিক্ষাকাঠামোর অন্যতম উদ্দেশ্য– স্বপ্রণোদিত, অনুসন্ধানভিত্তিক ও আন্তঃবিষয়ক শিক্ষা– প্রায়ই সংকুচিত হয়ে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীর অভিযোজন ও কৌতূহলের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, যা একুশ শতকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা।
অবশ্য শিক্ষাবিদ জিটারকফ যুক্তি দেন, ‘যেখানে নির্দিষ্ট ফলাফল নেই, সেখানে জবাবদিহির অভাব থেকে যায়।’ ফলে আউটকাম থাকা জরুরি, তবে তা হতে হবে প্রসঙ্গনির্ভর ও গভীরতাসম্পন্ন।
ওবিই কাঠামোর সফল বাস্তবায়নে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সংযোগ জরুরি, যেগুলোর মধ্যে কার্যকর সংযোগ ও সমন্বয় অত্যাবশ্যক। প্রথম উপাদান প্রোগ্রাম এডুকেশনাল অবজেকটিভস (পিইও): স্নাতকোত্তর পর্যায়ে (সাধারণত ৩-৫ বছরের মধ্যে) একজন শিক্ষার্থীর কী ধরনের অর্জন থাকবে, তা নির্ধারণ করে এ উপাদান। উদাহরণস্বরূপ: পেশাগত উৎকর্ষ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আজীবন শিক্ষার মানসিকতা। দ্বিতীয় উপাদান প্রোগ্রাম লার্নিং আউটকামস (পিএলও): স্নাতক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী কী ধরনের সামগ্রিক জ্ঞান, দক্ষতা ও মনোভাব অর্জন করবে তা পিএলওর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এটি প্রোগ্রামভিত্তিক একটি সমন্বিত রূপ। তৃতীয় উপাদান কোর্স লার্নিং আউটকামস (সিএলও): প্রতিটি কোর্স বা পাঠ্যবিষয়ের জন্য নির্দিষ্টভাবে কী শেখানো হবে এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থী কোন দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করবে তা সিএলও দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ তিনটির মধ্যে সিএলও ও পিএলওর কার্যকর ম্যাপিং নিশ্চিত করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি কোর্সের আউটকাম প্রোগ্রামের লক্ষ্য পূরণে ভূমিকা না রাখে, তাহলে গোটা কাঠামো প্রশ্নের মুখে পড়ে। তাই সুনির্দিষ্ট, সংগতিপূর্ণ ও প্রসঙ্গভিত্তিক সংযোগ নিশ্চিত করাই হতে হবে পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য।
ফিলিপস ও ওখস যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ‘ধার করা মডেল যথাযথ অভিযোজন ছাড়া টিকে না।’ বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা যদি যথাযথ সংবেদনশীলতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ওবিইর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো না হয়, তবে তা বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এই বাস্তবতা। ১৯৯৮ সালে তারা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করে হঠাৎ করে ওবিই চালু করেছিল। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পেয়ে ২০১০ সালে আবার ঐতিহ্যগত শিক্ষায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
আমাদের দেশেও এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কাঠামো চালু হলেও শিক্ষক প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত নয়, পাঠ্যক্রম হালনাগাদ হয়নি এবং কোর্স আউটকাম তৈরির ক্ষেত্রেও অনভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক সময় শুধু অ্যাক্রেডিটেশন পাওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত সিএলও, পিএলও তৈরির চাপে প্রাতিষ্ঠানিক সংলাপ বা প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না। ফলে দেখা যায়, একই ধরনের কোর্সে বিভিন্ন বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আউটকাম তৈরি হচ্ছে পৃষ্ঠাসম পরিসরের মধ্যে, অথচ গুণগতভাবে ভিন্ন। এতে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্যহীনতা তৈরি হয় এবং শিক্ষার্থীর প্রকৃত অর্জনের প্রতিফলন প্রশ্নের মুখে পড়ে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের এক শিক্ষক জানাচ্ছিলেন, ‘ওবিইর রুব্রিকে চমৎকারভাবে সবকিছু ঠিক ধরা যায়, কিন্তু ক্লাসে শিক্ষার্থীর যুক্তিবোধ বা বিশ্লেষণী ক্ষমতা কতটা বাড়ছে, সেটি কি আসলেই ধরা পড়ছে?’ এই প্রশ্ন আমাদের ভাবায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওবিই হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় হাতিয়ার। তবে শর্ত একটাই– এটি হতে হবে আমাদের নিজস্ব বাস্তবতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে খাপ খাওয়া একটি অভিযোজিত সংস্করণ। ওবিই শুধু একটি কাঠামো নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
এখন সময় এসেছে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার– আমরা কি শুধু একটি বিদেশি মডেল অনুসরণ করব, নাকি নিজেরাই ওবিই-কে প্রাসঙ্গিক ও প্রাণবন্ত করে তুলব? ভবিষ্যতের মানবিক, দক্ষ ও অভিযোজিত গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে এ অভিযোজনই হতে পারে একটি টেকসই পথ।
এম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব স তবত উপ দ ন আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত-পাকিস্তান কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পথে?
গত সপ্তাহে কাশ্মীরের পেহেলগামের একটি মনোরম তৃণভূমিতে ২৬ জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে ঘাতকরা তাদের বেছে বেছে হত্যা করে। আমরা ঘটনার হৃদয়বিদারক সাক্ষ্য পড়েছি। কীভাবে কাছ থেকে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে– পরিবারের সদস্যদের সেই দৃশ্য দেখতে হয়েছে। এতে প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। এসব হত্যাকাণ্ড ছিল অযৌক্তিক। এ ছাড়া আমরা পড়েছি, কীভাবে কাশ্মীরি ট্যুরিস্ট গাইড ও শিশুদের বিনোদন রাইডের পনি অপারেটররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক ভারতীয় পর্যটককে উদ্ধার করেছিলেন।
এই হামলা কারা ঘটিয়েছে, তা মৃতদের পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়– সেটা পাকিস্তানি কিংবা স্থানীয় কাশ্মীরি হোক, অথবা উভয় সম্প্রদায়ের সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের জীবন নিঃশেষ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ভারত সরকারের চতুরতার সঙ্গে গড়ে তোলা স্বাভাবিকতার মুখোশও ধ্বংস হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটনের উত্থানের ফলে এই মুখোশ টিকেছিল।
আমরা আগেও অনেকবার এখানে এসেছি। প্রায় চার দশক ধরে কাশ্মীর রক্তপাতের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে শান্ত থাকে। স্বাভাবিকতার জয়ধ্বনিপূর্ণ ঘোষণা এবং শান্তির সঙ্গে নীরবতার ইচ্ছাকৃত মিশ্রণের মধ্যে কেটেছে, যাতে এখানে আবারও ভ্রমণে যাওয়া যায়। ২০১৯ সালেও এখানে বিরাজমান স্বাভাবিক অবস্থা এবং সংঘাতের অবসানের কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু সেই ভাবমূর্তি ভেঙে যায় ফেব্রুয়ারিতে, যখন জইশ-ই-মোহাম্মদ নামে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি আধাসামরিক বাহিনীর গাড়িতে আক্রমণ করে। এতে ৪০ ভারতীয় সৈন্য হত্যা করা হয় এবং দুই দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। ১৯৪৮ সাল থেকে তারা যে তিনটি যুদ্ধ করেছে, তাতে বহু দিক থেকে দেশ দুটি সর্বদা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ছিল। নির্দিষ্ট সময় পরপর তারা যুদ্ধের চারপাশে ঘুরতে থাকে; তারপর ফিরে আসে এবং অস্ত্র ও বাগ্বিতণ্ডা চলে।
এই বিপর্যয়কর বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে একটি প্রজন্ম এখন শেষের দিকে, যার বেশির ভাগ ক্ষতি কাশ্মীরিদের গুনতে হয়েছে। তাদের ৭০ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, প্রায় ১০ হাজার হয়েছে নিখোঁজ এবং ২ লাখের বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিত (হিন্দু) বাস্তুচ্যুত। এর কারণ ১৯৮৯ সালে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বোমা বিস্ফোরণ বা পেহেলগামের মতো হামলায় ভারতীয় নাগরিকের নিহত হওয়ার ঘটনা। এটা বলা অযৌক্তিক– এ ধরনের সহিংসতা শূন্য থেকে উদ্ভূত। কারণ ব্যাপক সহিংসতার উৎস আমাদের ইতিহাস ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে। যেমন ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশভাগের এখনও জ্বলন্ত ক্ষত এবং কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের অমীমাংসিত প্রকৃতি।
২০১৮ সাল থেকে ভারত দিল্লির নিযুক্ত করা গভর্নরের মাধ্যমে সরাসরি এ অঞ্চল শাসন করে আসছে। পরের বছর মোদি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে। যদিও এখন একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী আছেন, তবু পদকে কার্যকরভাবে নামমাত্র করে তোলা হয়েছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্ত এতটাই বিকৃত হয়ে ওঠে, এই মাসের শুরুতে একটি উচ্চস্তরের নিরাপত্তা সভায় বর্তমান ক্ষমতাসীন এক কাশ্মীরিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। অঞ্চলটির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে ভারত কাশ্মীরের অভ্যন্তরে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান সীমান্তে প্রায় পাঁচ লাখ সৈন্য নিয়ে একটি বিশাল সামরিক বাহিনী বলবৎ রেখেছে। স্থানীয় বা পাকিস্তানি পৃষ্ঠপোষকতায় সশস্ত্র গোষ্ঠীদের জন্য এসব উর্বর ভূমি অবাক করার মতো কিছু নয়।
মির্জা ওয়াহিদ: ইংল্যান্ডভিত্তিক কাশ্মীরের লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম