মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্তর্মুখী নীতি গ্রহণ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা যে এখনো ভেঙে পড়েনি, তাতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন বিশ্বের নীতিপ্রণেতারা।

গতকাল শনিবার শেষ হওয়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পাঁচ দিনব্যাপী বসন্তকালীন বৈঠকে মূলত বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ বৈঠক চালকালে ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমন নিয়েও কথা বলেছে।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে ফেডারেল রিজার্ভ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছেন, তাতে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ও অর্থমন্ত্রীদের মনে এখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো, মার্কিন ডলার যেভাবে এত দিন বিশ্বের নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যেভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে গেছে, সেই ব্যবস্থা কি অক্ষুণ্ন থাকবে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষমেশ ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের বরখাস্ত করার হুমকি থেকে সরে আসায় নীতিপ্রণেতারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। বিষয়টি হলো, ফেডের চেয়ারম্যান বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নীতিপ্রণেতাদের কাছে ডলার অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত। ফলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে—এমন হুমকি দেওয়া হলে ডলারের ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। কিন্তু ট্রাম্প মনে করেন, জেরোম পাওয়েল একজন পরাজিত মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না, তাতেও অনেকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। যদিও মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এ দুই প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস কনফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্রই এই দুটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে সমর্থন দিয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রবার্ট হোলজম্যান বলেছেন, এই সপ্তাহ ছিল স্বস্তির সপ্তাহ। মার্কিন প্রশাসনের অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু তিনি মনে করেন না, এটাই যুক্তরাস্ট্রের চূড়ান্ত অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিষয়ে তাঁর সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ফেডারেল রিজার্ভের রাজনৈতিকীকরণ বা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে ফেলার মতো পদক্ষেপ বিশ্বের অধিকাংশ নীতিপ্রণেতার জন্য বোঝা কষ্টকর।

নীতিপ্রণেতাদের মূল উদ্বেগ হলো, বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বের বাইরে তাঁরা অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইদানীং কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। সম্প্রতি ইইউ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অঞ্চলে হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ায় এ মর্যাদা পেয়েছে, অর্থাৎ মানুষ ইউরোতে আস্থা রাখছে।

কিন্তু যে নীতিপ্রণেতারা রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁদের ভাষ্য হলো, ইউরোপের মুদ্রা এখনই ডলারকে হটিয়ে দিতে পারবে না, বরং বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র যতই অস্থিতিশীল হোক, বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইউরো তেমন একটা জনপ্রিয়তা পাবে না। এখন বিশ্বের ২০ শতাংশ রিজার্ভ রাখা হয় ইউরোতে; সেখানে হয়তো সামান্য কিছু যোগ হতে পারে।

যে ২০ দেশ ইউরো ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে কেবল জার্মানির ঋণমান বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয়। অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিনিয়োগকারীরা যা চান, তা দেওয়ার ক্ষমতা আছে কেবল জার্মানির। অন্যান্য দেশ ঋণগ্রস্ত। শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেও রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে রাশিয়া ইউরো অঞ্চলের কাছাকাছি হওয়ার কারণেও ইউরোর ওপর নির্ভরশীলতা সেভাবে বাড়বে না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এদিকে জাপান দেশ হিসেবে অনেক ছোট। চীনের মুদ্রাও অনেক নিয়ন্ত্রিত; এ পরিস্থিতিতে ডলারের ভিন্ন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে; যার পেছনে আছে ফেডারেল রিজার্ভ ও দুটি ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠান।

বস্তুত যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার; এ দুই প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া টিকতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কঠিন হলেও অনেকে মনে করেন, ক্রেডিট কার্ড ও স্যাটেলাইট সেবার জন্য হাতে গোনা কয়েকটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল থাকা চ্যালেঞ্জিং।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ও আইএমএফ র ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ

২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।

আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।

পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।

সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের কিস্তির প্রস্তাব উঠছে আইএমএফ পর্ষদে
  • আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
  • ট্রাম্প ও আইএমএফ—এই দুই পায়ের ওপর দাঁড়ানো এবারের বাজেট: আনু মুহাম্মদ