মহানবীর (সা.) জীবনচরিত পাঠ করলে সাহাবিদের নবীপ্রেমের এমন সব উপমা পাওয়া, যা আমাদের বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। আমরা মাত্র ৫টি ঘটনা উল্লেখ করছি।

১. ষষ্ঠ হিজরিতে হোদায়বিয়া নামক স্থানে মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মদিনার মুসলমানদের সন্ধি চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তির আগে কুরাইশের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয় উরওয়া ইবনে মাসউদকে। তিনি তখনো মুসলিম হননি। তিনি মুসলিম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপের ফাঁকে মহানবীর (সা.

) প্রতি সাহাবিদের আনুগত্য সম্পর্ক ধারণা লাভ করেন। চুক্তির পর কুরাইশের কাছে ফিরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বহু রাজা-বাদশার কাছে প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছি, এমনকি কায়সার-কিসরা-নাজ্জাশির সামনেও রাজদূত হিসেব উপস্থিত হয়েছি, কিন্তু আল্লাহর শপথ, কোনো বাদশাকে তার সহচরদের থেকে এতটা সম্মান পেতে দেখিনি, যতোটা সম্মান মুহাম্মাদকে তার সঙ্গীরা করছে। ‘ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৭৩২)

২. খ্যাতিমান সাহাবি আমর ইবনে আ’স (রা.) বলেন, ‘নবীজির (সা.) চেয়ে বেশি প্রিয় আমার কাছে আর কেউ নেই এবং আমার দৃষ্টিতে তার চেয়ে সম্মানীও কেউ নেই। তার দিকে কখনো আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে পারিনি। যদি আমাকে তার দেহাবয়ব বর্ণনা করতে বলা হয়, তাহলে আমি তা পারব না। কারণ, তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১২১)

আরও পড়ুন জান্নাতে দাখিল হওয়ার উপায়১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

৩. উহুদ যুদ্ধ শেষ হলে নবীজি (সা.) বললেন, ‘কে আমার কাছে সা’দ ইবনে রবির খবর নিয়ে আসবে?’ এক সাহাবি বললেন, ‘আমি আনছি, আল্লাহর রাসুল (সা.) ।’ খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় এসে তিনি দেখলেন, সা’দ ইবনে রাবি আহত অবস্থায় ময়দানে পড়ে আছেন। তার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। ওই সাহাবি বলেন, ‘আমি তাকে বললাম, নবীজি (সা.) আপনাকে খুঁজে দেখতে বলেছেন যে, আপনি জীবিত আছেন, নাকি মৃতদের দলে চলে গেছেন।’ সা’দ বললেন, ‘আমি মৃতদের দলে। তুমি আমার পক্ষ থেকে নবীজির (সা.) কাছে সালাম পৌঁছে দেবে এবং তাকে বলবে, সা’দ ইবনে রবি আপনাকে বলেছে, আমাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে তেমন উত্তম প্রতিদান দিন, যেমন প্রতিদান কোনো নবীকে তার উম্মতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। আর তোমার গোত্রকেও আমার পক্ষ থেকে সালাম দেবে এবং তাদের বলবে, সা’দ ইবনে রাবি তোমাদের বলেছে, আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো অজুহাত থাকবে না, যদি তোমাদের দৃষ্টি অক্ষত অবস্থায় নবীজির (সা.)  ওপর সামান্য আঘাত আসে।’ সাহাবি বলেন, ‘তারপর আমি তাকে ছেড়ে আসতে না আসতেই তার প্রাণ চলে গেল।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/৯৪)

আরও পড়ুনসহজে জান্নাতে যাওয়ার উপায়২০ জানুয়ারি ২০২৫

৪. বদর যুদ্ধের পূর্বক্ষণে নবীজি (সা.) মুসলমানদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাচ্ছিলেন। তাঁর হাতে একটি তির ছিল। সাওয়াদ ইবনে গাজিয়ার কাছে পৌঁছে তিনি দেখলেন, সে কাতারের বাইরে। নবীজি (সা.) (তাকে তীরের খোঁচা দিয়ে) বললেন, ‘সাওয়াদ, সোজা হও।’ সাওয়াদ বলল, ‘আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) । আমিও আপনার মতো করব।’ নবীজি (সা.) তাকে তীরটি দিলেন এবং তার পেটের ওপর থেকে কাপড় সরালেন। সাওয়াদ নবীজি(সা.) কে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেলেন। নবীজি তাকে বলেন, ‘তুমি কেন এমন করলে?’ সে বলল, ‘আল্লাহর রাসুল, একটু পর যুদ্ধ শুরু হবে। আমি চেয়েছি, শেষ সময়ে আমার চামড়া আপনার চামড়াকে স্পর্শ করুক।’ নবীজি (সা.) তার জন্য কল্যাণের প্রার্থনা করলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১/৬২৬)

৫. নবীজির (সা.) জীবনীগ্রন্থগুলোতে ‘ইয়াওমুর রাজি’ নামক একটি বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা জানা যায়। সে-সময় ধোঁকা দিয়ে জায়েদ ইবনে দাসিনা ও খোবাইব ইবনে আদিকে নামের দুই সাহাবিকে অবিশ্বাসী কুরাইশের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কুরাইশরা তাদের দুজনের জন্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। জায়েদ ইবনে দাসিনাকে হত্যার জন্য হাজির করা হলে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, ‘জায়েদ, তুমি কি চাও যে, তোমার বদলে মুহাম্মদ এখন আমাদের কাছে থাকবে, তার শিরচ্ছেদ করা হবে, আর তুমি থাকবে তোমার স্ত্রী-পরিজনের মধ্যে?’ তিনি বললেন, ‘খোদার শপথ, আমি এটা কখনো চাই না যে, আল্লাহর রাসুল (সা.)  যেখানে আছেন, সেখানেই একটি ছোট কাঁটা বিঁধে তিনি কষ্ট পাবেন আর আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকি।’ আবু সুফিয়ান বললেন, ‘মুহাম্মদকে তার সঙ্গীরা যেমন ভালোবাসে, মানুষের প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসা আমি আর দেখিনি।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/১৭২)

এ ছাড়া হোদায়বিয়ার ঘটনার পরের বছর যখন নবীজি (সা.) ওমরাহ কাজা করতে ইহরাম বেঁধে হারাম শরিফে প্রবেশ করেন, সে-সময় সাহাবিগণ তাঁকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিলেন যেমন নারীদের চুড়ি হাতের কবজিকে ঘিরে রাখে। তারা মক্কাবাসী থেকে নবীজিকে (সা.) আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন, যেন কেউ দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করে তাকে আহত করতে না পারে, বরং তেমন হলে যেন অন্য কেউ আহত হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৭৯১)

আরও পড়ুনপ্রতিবেশীকে কষ্ট দিলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না১৪ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল ল হ বলল ন দ ইবন

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ