ফ্যাসিস্ট সিস্টেম মাথাতেও আসন গেড়েছে : মাহবুব মোর্শেদ
Published: 30th, April 2025 GMT
মাহবুব মোর্শেদ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৭৭ সালে, রংপুরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে। এরপর জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে দেশের গণমাধ্যমের সংকটের কথা। গণঅভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশা বিবেচনায় সংকট কতটা দূর হয়েছে রয়েছে সে কথাও। রাইজিংবিডি ডটকমের যুগপূর্তি উপলক্ষ্যে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ূন শফিক।
হুমায়ূন শফিক: কীভাবে সাংবাদিকতায় আসলেন? আপনার পড়ালেখা তো অন্য সাবজেক্টে।
মাহবুব মোর্শেদ: আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছি। প্রত্নতত্ত্বেই যে ক্যারিয়ার গড়তে হবে এমন ভাবনা ছিল না। আমরা যারা লেখালেখি করি বা করতাম আমাদের একটা ভাবনা ছিল যে, লেখালেখি করতে হলে ঢাকায় আসতে হয়। কারণ বইপত্র, লেখকদের সঙ্গে সম্পর্ক বা অন্যান্য ব্যাপারগুলো সাধারণত ঢাকাকেন্দ্রীক হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে আমি কারমাইকেল কলেজে এক বছর বাংলায় পড়েছি। কারমাইকেল কলেজ থেকে তখন রংপুরের যে সাহিত্য সার্কেল বা ওখানকার যে অন্যান্য বইপত্রের যে উৎস, সেগুলোতে গিয়ে ভাবতাম, এখানে বইপত্রের উৎসগুলো অনেক দূরে। তখন ইন্টারনেট ছিল না এবং মোবাইলও ছিল না। ফলে আমার একটা বড় প্রায়োরিটি ছিল যে ঢাকা যেতে হবে। সেই সূত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। জাহাঙ্গীরনগরে কোন সাবজেক্টে পড়বো; সেটা আর্কিওলজি, ফিলোসফি না বাংলা সেইটা আমার প্রায়োরিটিতে ছিল না। আর্কিওলজিতে পড়ে ওই সাবজেক্টেই ক্যারিয়ার গড়বো এমন চিন্তাও ছিল না। আমরা আর্কিওলজির সপ্তম ব্যাচ। তখনও বিসিএস-এ বা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে আর্কিওলজি থেকে ঢোকার সুযোগ ছিল না। শুধু একটি সুযোগ ছিল টিচিং। যারা ভালো রেজাল্ট করবে তারা ওই পেশায় যাবে– ব্যাপারটা ছিল এমন। কিন্তু অনান্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও আর্কিওলজি ছিল না। আমরা যে ক্যারিয়ার নিয়ে ক্যাম্পাস জীবনে খুব ভেবেছি, তাও না।
আমার একটা চিন্তা হতো লেখার জন্য সহায়ক হবে কোন পেশা? মাস্টার্সের শেষ দিকে ভেবেছি, কী করা যায়? একবার ভেবেছি, এনজিওতে কাজ করবো কিনা? পরে খুব চ্যালেঞ্জিং হবে কিনা? আবার ভেবেছি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ঘোরা যাবে; সেটাও ভালো হয়। কিন্তু এখানে কাজের স্ট্রেস অনেক বেশি। সেটাও ভেবেছি। পরে আমি দুইটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটা হতে পারে অ্যাড ফার্ম। কারণ আমাদের পরিচিত অনেক বড় ভাই, যারা লিখতেন, তারা অ্যাড ফার্ম দিয়ে অনেকেই ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। আরেকটা আমি ভেবেছি যে, পত্রিকা হতে পারে। তো আমি ‘আজকের কাগজে’ ঢুকে গেলাম। অনেক অনেক লেখক সাংবাদিকতা করেছেন, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমার ক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় কাজ করেছে যে, মার্কেজ সাংবাদিকতা করেছেন। একটা লেখা আমাকে খুব প্রভাবিত করে যে, সাংবাদিকতা পৃথিবীর সেরা পেশা। মার্কেজের আত্মজীবনী আপনারা যারা পড়েছেন, তারাও দেখবেন যে তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক বড় একটা অংশ আছে। যদিও একটা বিতর্ক আছে, সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থাকলে লেখার ব্যাপারটা কী হবে? এটা লেখককে সহায়তা করে না কি বিচ্ছিন্ন করে; না কি এক ধরনের প্রবলেম তৈরি করে।
আমার কাছে মনে হয় যে, একটা সমস্যা আছে কিন্তু সাংবাদিকতা হলো ডে টু ডের যে ব্যাপার সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু লেখা একটা ইউনিভার্সেল বা কালোত্তীর্ণ ব্যাপারের মধ্যে থাকতে হয়। আরেক দিকে সাংবাদিকতা এক ধরনের সেলিব্রেটি হিসেবে তৈরি করে দেয়। ফলে এক ধরনের ডিসিশনের মধ্যে থাকতে হয় যে, সাংবাদিক হিসেবে আমি ওই ধরনের সেলিব্রেটি বা ফোকাসটা নেব কিনা। মানে আপনি সাংবাদিক, ‘সাংবাদিক’ পরিচয়টা সবাই দিতে পছন্দ করে, নিতে পছন্দ করে। যে কোনো জায়গায় সাংবাদিক বললে একটু বেশি খাতির করে বা তারা জিনিসটাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু লেখক ওইরকম না। আমি খুব সচেতনভাবে ‘লেখক’ পরিচয়টাকে সামনে আনার চেষ্টা করেছি। মানে আমি খুব প্রোফেশনালি জিনিসটাকে নিয়েছি, শেখার চেষ্টা করেছি, নানাভাবে। সাংবাদিকতার সব সেক্টরে কাজ করার মতো একটা চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাইরে যে একটা সামাজিক জগৎ, বা আমাদের অ্যাসোসিয়েশন; সেখানে আমি ‘লেখক’ পরিচয়টাকে সামনে আনার চেষ্টা করছি। এটা একটা চয়েস।
হুমায়ূন শফিক: যাই হোক, আমরা আপনাকে লেখক হিসেবেই চিনি। সাংবাদিক পরিচয় পরে জানতে পেরেছি।
মাহবুব মোর্শেদ: যেহেতু আমি লেখার জন্যই সাংবাদিকতায় এসেছি, তো লেখাটাকেই আমি প্রাধান্য দিয়েছি।
হুমায়ূন শফিক: এটা অনেকেই বলেন যে, লেখালেখির ক্ষেত্রে শিক্ষকতা ভালো পেশা। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মাহবুব মোর্শেদ: লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা অবশ্যই ভালো পেশা। আপনি চিন্তা করে দেখুন, একটা ছেলে, একটা মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় খুবই কম বয়সে। অর্থাৎ উনিশ-বিশ বছর বয়সে। শিক্ষক হওয়ার জন্য এখানে শুধু ভালো লেখাপড়া করলেই হয় না, একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হয় শিক্ষকদের সঙ্গে। সরকারপন্থী হতেই হবে, না হলে শিক্ষকরা আপনাকে নিয়ে আগাবে না। শিক্ষক হওয়ার জন্য যে পড়া, সেটার ব্যাকরণ একেবারেই আলাদা। একজন ছাত্র যখন শিক্ষক হতে চাইবে, তখন শুরু থেকে শিক্ষকদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হতেই হবে, ফার্স্ট হতেই হবে, সরকারি দলের হতেই হবে; পড়ার বাইরে এগুলো মেনটেইন করতে হবে। এগুলো যখন আমি বুঝলাম তখন ভাবলাম, না এগুলোতে আমি যাবো না।
আরেকটা জিনিস হলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন ঢুকি, আমাদের চয়েসটা অন্য দিকে নিয়ে যায়। তখন ‘ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন’ শুরু হয়ে গেছে। এটা ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে, প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ ক্যাম্পাস। আমর মনে আছে, আমি ট্রান্সপোর্টে ছিলাম, একটা মিছিল যাচ্ছিল; অটোমেটিক্যালি মিছিলটার সঙ্গে আমি হেঁটে গেলাম। আমার যে স্বভাব; আমার স্বভাব আমাকে মিছিলে টেনে নিয়ে গেলো। আমি নিজেকে ভার্নারেবল করে তুললাম। এখন ওই চয়েসটা, যখন আপনি একটা মিছিলে চলে গেছেন এবং আপনার ওটা পছন্দ হয়েছে, ওটা কন্টিনিউ করছেন। আপনি জিনিসটার সঙ্গে ইনভলভ্ হয়ে গেছেন। তখন ওই চয়েসটা আপনাকে একটা দিকে নিয়ে যাবে। দেখা যাবে যে আপনি একের পর এক মিছিল করছেন, আন্দোলন করছেন। আপনার অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হচ্ছে। ওখানে গিয়ে আমরা আড্ডা, আন্দোলন, চা খাওয়া– এই যে একটা আড্ডার সার্কেল, আন্দোলনের সার্কেল, এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে আমরা অন্য দিকে চলে গেলাম। আমাদের একটা ক্লাসরুম তৈরি হলো, যে ক্লাসরুম আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো। সেখানে আমরা প্রচুর বই পড়তাম, আমরা হয়তো একটা ভালো স্টুডেন্টের থেকেও বেশি পড়তাম। কিন্তু আমার যে পাঠ্যসূচি, সেটা খুব বেশি পড়ি নাই। লাইব্রেরিতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতাম।
আপনি জানেন, জাহাঙ্গীরনগরের লেখকদের একটা আলাদা সার্কেল ছিল। বড় সার্কেল ছিল। এ সময় যারা লিখছেন তাদের একটা বড় অংশ জাহাঙ্গীরনগর থেকে আসা। তো ওই সময় যেটা হতো নতুন বই, নতুন চিন্তা, কে কী পড়ছে, কোন গল্প, কোন কবিতা, কোন ট্রেন্ড কোথায় গিয়ে ঠেকছে; এই জিনিসগুলা, রাজনৈতিক সার্কেল, সাহিত্যিক সার্কেল এগুলো খুব জড়ানো ছিল। আন্তঃসম্পর্ক ছিল। এজন্য জিনিসটা আর শিক্ষকতার দিকে গেলো না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে, শিক্ষকরা লিখতে পারে; তাদের অনেক সময় থাকে। কিন্তু তাদের নৈতিক অবস্থানে থাকতে হয়। যেহেতু তারা ছাত্রছাত্রীদের পড়ায়, এজন্য তাদের ভাষাগত, বিষয়গত জায়গায় একটা নৈতিক অবস্থান মেনটেইন করতে হয়। কারণ হলো, তারা এমন কিছু বলতে পারে না, লিখতে পারে না, যা সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা বিপ্লবী কোনো আইডিয়া নিয়ে সামনে হাজির করতে পারে না। ধরেন যৌনতা নিয়ে ডিল করার ব্যাপার, এটা কিন্তু একজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে অনেক কঠিন। ফলে ফিকশন লেখার জন্য বা কবিতা লেখার জন্য তাকে অনেকটা ট্র্যাডিশনাল থাকতে হয়। এটা একটা ঝামেলা আমার কাছে মনে হয়। আমাদের সমাজের যে অবস্থান, সেইটাও তো বিবেচনা রাখতে হবে। তবে আমার কাছে মনে হয়, এটা অনেকের ক্ষেত্রে নাও হতে পারে। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর উপন্যাসে খুব চমৎকারভাবে যৌনতা, নানান রকমের এক্সপেরিমেন্টাল আইডিয়া এনেছেন। সমাজ সংসার সম্পর্কে অনেক ক্রিটিক্যাল ব্যাপার তাঁর লেখায় আছে। হাসান আজিজুল হকের মধ্যে আছে, শওকত আলীর মধ্যে আছে। হ্যাঁ তাঁরা সবাই শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু আমি জানি না তাঁরা কীভাবে পেরেছেন। তাঁরা আমাদের মেজর রাইটার। আবার অনেককে দেখি যে, তারা সেভাবে পারে নাই।
হুমায়ূন শফিক: ছাত্র অবস্থায় আপনি কোনো রাজনৈতিক দল করেছেন কিনা? আপনি একটু বামধারার আমরা যতদূর জানি।
মাহবুব মোর্শেদ: আমি খুব বামধারার যে তা না। আমি সবসময় বামধারার ক্রিটিক ছিলাম। বামধারার রাজনীতিকে ক্রিটিক্যালি দেখেছি। যেহেতু আমাদের অ্যাসোসিয়েশন রাজনীতির আগে আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েছে; আমরা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন– এমন অসংখ্য আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ফলে এই আন্দোলনগুলোতে আদর্শিকভাবে বামপন্থিদলগুলো উৎসাহী হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও পার্টিসিপেট করে। ওই যে বললাম, সবসময় একটা বিপ্লবী মনোভাব আমার মধ্যে কাজ করে এবং আমি ওই জায়গাটাকে মনে করি আমার ‘খাসলত’। আমি যে একটা জায়গায় আছি, তার বিপরীতে আমার চিন্তা কাজ করতে থাকে। মূলত আমরা পাঠচক্র ভিত্তি করে কর্মতৎপরতা চালাতাম। কিন্তু আমরা বাম সংগঠনগুলোর কড়া সমালোচনা করতাম। এবং তারাও এই তর্ক-বিতর্কগুলোতে আসতো, তারা প্রভাবিত হতো, আমরাও। আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করতাম, এর বাইরে দেখা যেত যে সমালোচনা, খোঁচাখুঁচি, বিতর্ক এগুলোর ভেতর দিয়ে চলতো আরকি।
আপনি জানেন যে, জাহাঙ্গীরনগরে একটা ফ্যামিলিয়ার আবহ থাকে। দশ বছর, বিশ বছর আগেও যারা কাজ করে গেছে তাদের সঙ্গে নতুনদের এক ধরনের কানেকশন তৈরি হয়, শিক্ষকদের এক ধরনের কানেকশন তৈরি হয়। আড্ডা, সমালোচনা ও নানা ধরনের কমিউনিকেশন তৈরি হয়। ফলে এই বৈপরিত্য, সমালোচনার মধ্যেও আমরা কিন্তু সহাবস্থানের মধ্যে থাকতে পারতাম। আমি বাম কোনো সংগঠন করি নাই। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মনে হবে যে, উনি মনে হয় বাম সংগঠন থেকে এসেছেন। আমাদের লেখকদের মধ্যে অনেকে সরাসরি কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন নাই, বা সাংবাদিকদের মধ্যেও অনেকে কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন নাই; কিন্তু মনে হয় যে এরকম।
হুমায়ূন শফিক: আপনার পড়ালেখা শেষ হলো তাহলে ২০০২ বা ২০০৩ সালের দিকে। তখন আপনি পত্রিকায় ঢুকলেন?
মাহবুব মোর্শেদ: আমি তো থিসিস করলাম ‘আইকোনোগ্রাফী’ নিয়ে, মূর্তিতত্ত্ব। প্রতীমা তত্ত্ব আরকি। থিসিসটা জমা দেওয়ার আগেই ‘আজকের কাগজে’ ঢুকলাম। খুব অল্প বেতন ছিল তখন। ভাবলাম একটা কিছু শুরু করতে হবে, ঢুকে যাই। এর অনেক দিন পরে থিসিস জমা দেওয়া হলো, তারপর ভাইভা দিলাম।
হুমায়ূন শফিক: ওই মুহূর্তে সাংবাদিকতার পরিবেশ কেমন ছিল?
মাহবুব মোর্শেদ: নব্বই দশকে এরশাদের পতনের পর ‘আজকের কাগজ’ শুরু হলো। তখন এটা পাইওনিয়ার প্রজেক্ট ছিল। এর আগে ‘ইত্তেফাক’ ‘দৈনিক বাংলা’ এরা একটু ওল্ড স্টাইলে জার্নালিজম করতো। আজকের কাগজের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের চলতি ভাষা, স্মার্ট ভাষায় সাংবাদিকতা; এই জিনিসগুলো তৈরি হলো। ইনফ্যাক্ট, আজকের কাগজের একটা অংশ ভেঙে ‘ভোরের কাগজ’ তৈরি হয়েছে। আবার ভোরের কাগজের একটা অংশ ভেঙে ‘প্রথম আলো’। একটা হলো ইত্তেফাকের ধারা, আরেকটা হলো আজকের কাগজের ধারা। ইত্তেফাকের যে ধারা, মানে যারা একটু ঐতিহ্যগত ওল্ড ফ্যাশন সাংবাদিকতা; সেই জিনিসটা ওখানে ছিল। কিন্তু আজকের কাগজই প্রথম বললো যে, তরুণরা আসবে, তারা নিজের নামে কলাম লিখবে। তার আগে তো কলামে নাম যেত না। যেটাকে আমরা বলি পোস্ট এডিটোরিয়াল। এই ধারাগুলো তৈরি হলো।
তারপরে ফিচারে একটা স্মার্ট ধারা তৈরি হলো। এই ধারাটাই কিন্তু এখন বাংলাদেশে প্রথম আলোর মাধ্যমে একটা প্রমিনেন্ট ধারা তৈরি হয়েছে। তো আজকের কাগজে আমরা যখন গেছি তখন তো তার বিগত যৌবন। সার্কুলেশন কম কিন্তু সেখানে একটা জিনিস ছিল শেখানোর, শেখার। এক ঝাঁক তরুণ কাজ করতো। তাদের মধ্যে খুব ভালো ইন্টারেকশন কাজ করতো। আমার কাছে মনে হয় যে তারা এখন অনেকেই খুব ভালো জায়গায় আছে। আমরা আজকের কাগজেই একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছিলাম। আমাদের মধ্যে খুব আড্ডা হতো, ইন্টারনেট ব্যবহার করার ব্যাপার, কম্পিউটার ব্যবহার করার ব্যাপার; ফুল ফ্যাসেলিটি শুরু হলো। অন্যান্য হাউসের খবর আমরা নিতাম। অন্যান্য হাউসে ওরকম ফ্যাসেলিটি ছিল না। অনেক প্রমিনেন্ট সাংবাদিক তখন ওই হাউসে কাজ করতো। ফলে আমরা বেতন কম পেলেও খুব এনজয় করতাম। অফিস শেষ করে আজিজ মার্কেটে যাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি, রাতে ফিরছি– এ রকম একটা ব্যাপার ছিল।
হুমায়ূন শফিক: আজিজ সুপার মার্কেটে তো প্রচুর আড্ডা দিয়েছেন আপনারা?
মাহবুব মোর্শেদ: হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। ইউনিভার্সিটি লাইফের পরেও। বইয়ের একটা বড় উৎস ছিল সেখানে। তখন তো ফোন ছিল না যে মানুষ কাউকে কল দিয়ে বলবে, ‘এখানে আসো’। মানুষ আজিজ মার্কেটে যেত, কারণ জানতো যে, যাকে খুঁজছি তাকে পাওয়া যাবে।
হুমায়ূন শফিক: সরকার থেকে তো একটা চাপ থাকেই পত্রিকার ওপর। যে সময় সাংবাদিকতা শুরু করলেন, তখন পরিবেশ কেমন ছিল?
মাহবুব মোর্শেদ: নাম বলা ঠিক হবে না, ধরেন আমি একটা পত্রিকায় কাজ করছি; তারা আওয়ামী ধ্যান-ধারণার, ঘরানায় বিশ্বাসী। হঠাৎ করে শোনা গেলো, একজন মন্ত্রী আসবেন। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। তখন তারা বললো যে, তাহলে শহীদ জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়ার ছবি কোথায় রাখছো? আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমি যেখানে বসতাম তার একটু সামনেই সম্পাদকের রুম, প্রকাশকের রুম; আগে বোধ হয় কোনো আওয়ামী লীগের নেতা ভিজিটে এসেছিলেন, তো তারা শেখ মুজিবের ছবি টাঙিয়ে রেখেছিল। তো হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন সুন্দর দুইটা ফ্রেম এনে শেখ মুজিবের ছবিটা সরিয়ে জিয়ার ছবি টাঙিয়ে রাখা হলো।
আবার মনে করেন, আমি একটা পত্রিকায় কাজ করতাম, আমাকে সম্পাদক বললো, মাহবুব এডিটোরিয়ালে কিন্তু ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান’ লিখতে হবে। তারপর যখন বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাচ্ছে, আমি তাই লিখেছি, তখন বললো যে, এতো বিশেষণ দেওয়ার দরকার কি? শুধু ‘জিয়াউর রহমান’ লিখলেই তো হয়। দুইটা উদাহরণ দিলাম, কারণ আমাদের জার্নালিজমের যে ধরন, সেখানে স্বাধীন সাংবাদিকতা করার জন্য কেউ পত্রিকা বের করছে, এটা খুব রেয়ার। এখানে যে পত্রিকা বের করছে সে অপারচুনিটি খুঁজছে যে, পত্রিকাটা বের করে আমি টাকা কামাবো। বা আমার একটা পলিটিক্যাল প্রভাব তৈরি হবে।
হুমায়ূন শফিক: ভাবছে যে সিকিউরিটি তৈরি হবে।
মাহবুব মোর্শেদ: সিকিউরিটি তো প্রাইমারি। সরকার তাকে বলবে কি, সরকার তাকে বলার আগেই সে সরকারের কাছে যাচ্ছে– ‘ভাই, এইটা ছাপছি, এইটা করছি, আপনার ছবিটা কিন্তু বড় করে দিছি। দেখেন ওনাদের নিউজটা কিন্তু ভেতরের পাতায় দিছি।’ যে বিজনেসম্যান, ইনভেস্ট করে তার আগ্রহই থাকে ওটা। এখন সাংবাদিক যারা কাজ করে তারা তো এখানে কর্মচারী। ইনভেস্টর কী চায়? ইনভেস্টর চায় মন্ত্রীর সঙ্গে, বড় বড় অফিসিয়ালদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে। সেখান থেকে সুবিধা, টেন্ডার বাগাতে। নানান রকমের কাজ পেতে। তার অন্যান্য বিজনেস সাপোর্ট দিতে। এগুলোতে হাজারটা বিজনেস। এই ইনভেস্টর কিন্তু মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে আগেই বলে রাখে, একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। এ ভাবেই তো জিনিসগুলো হয়। যাদের আমরা বলি যে, ‘খুব ভালো সাংবাদিকতা করছে!’ তারা হয়কি, এই ব্যাপারগুলো বুঝতে দেয় না। বাকিরা বুঝতে দেয়।
পত্রিকা হলো এমন একটা বিজনেস যেখানে আপনার একটা পত্রিকা বানাতে যে টাকা লাগে– যেমন এখন একটা পত্রিকা বানাতে খরচ হয় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ টাকা। এই পত্রিকা আপনি বিক্রি করছেন ১২ টাকায়। তাহলে এই একমাত্র প্রোডাক্ট পৃথিবীতে যার বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি। এটা যদি আপনি ফেয়ার মার্কেটের কথা চিন্তা করেন তাহলে পত্রিকা বিক্রি করতে হবে ন্যূনতম ৩৫ টাকায়। এখানে নানারকম পার্সেন্টেজ আছে, হকারদের একটা পার্সেন্টেজ দিতে হয়। এখন বিষয়টা হচ্ছে, এই বিশ টাকা আপনাকে দেবে কে? বিজ্ঞাপনদাতারা দেবে। তাহলে বিজ্ঞাপনদাতারা আপনার ইনভেস্টর। তার মানে আপনি পত্রিকাটা বিক্রি করছেন তাদের ওপরে ভরসা করে। ফলে এটা তো ডিপেন্ডেট একটা জিনিস। এই সিস্টেম থেকে বের না হলে পত্রিকাকে ইনডিপেন্ডেন্ট করা যাবে না।
অন্যভাবে বললে, পত্রিকা করপোরেট বিজ্ঞাপনদাতা, বিজনেসম্যানদের প্রোডাক্ট। আমরা যারা সাংবাদিক তারা ওই স্বার্থ রক্ষা করি। কারণ হলো বেসিক জায়গা অর্থনীতি। সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতার কথা বলা হয় মিডিয়ায়। কিন্তু আপনি নিজেই তো গ্যাপ রাখছেন ২০ টাকা। তার মানে আপনি মূল যে সুতা, সেটা তো আগেই বিক্রি করে ফেলছেন। আপনি যাদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন নেন, যাদের ব্যাংক, বীমা, অমুক-তমুক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এদের সঙ্গে আপনি বাঁধা। এটাই আপনার ইকোনমি। ফালে সারা বিশ্বেই সাংবাদিকতা হুমকির মুখে। আমাদের দেশেও তাই। আগে মানুষ বুঝতো না। এখন মানুষ বোঝে কীভাবে নিউজ ম্যানুফ্যাকচারিং হয়। কীভাবে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ, করপোরেটদের স্বার্থ, বিজনেসম্যান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। কীভাবে সে শাসকের পক্ষে কনসেন্ট তৈরি করে। কীভাবে একটা পত্রিকা অ্যাপারেন্টলি দেখায় যে, সে জনগণের পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু সে টাকা তো নিচ্ছে করপোরেটদের কাছ থেকে।
সুতরাং সে কখনও জনগণের কথা বলে না। সে ভান করে। এটা হলো লিবারেল শাসন ব্যবস্থার একটা হাতিয়ার যে, পত্রিকা দিয়েই আমরা শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখছি। এই যে ম্যাকানিজম, এর একটা বড় অংশ হলো পত্রিকা। এটা একটা ধারণা, এটা একটা শাসন ব্যবস্থারই অংশ। মানুষ আপনাকে ভোট দিচ্ছে। এরপর বলছে, পাঁচ বছরের জন্য চালাও। আমরা জানি, গত তিন টার্মে ভোটই হয় নাই। এখন আদর্শ একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণ একবার ভোট দেয় পাঁচ বছর চলে, এখন এই যে পাঁচ বছরের মধ্যে সরকার কী করছে? সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কী করছে? এটা কীভাবে জানছে জনগণ? লিবারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পত্রিকাটা সেই সব কিছু জনগণকে জানাচ্ছে। মানুষ মনে করছে, ওকে ওরা চালাচ্ছে। এর মধ্যে জবাবদিহিতা আছে, স্বচ্ছতা আছে। এভাবে পত্রিকা হয়ে ওঠে খুবই এসেনশিয়াল পার্ট। এই যে আদালতে বিচার হচ্ছে, আমলাতন্ত্র চলছে, এটা চলছে, ওটা চলছে এবং পত্রিকাও চলছে। পত্রিকা জনগণকে তথ্য দিয়ে বলে, হ্যাঁ কিছু সমস্যা আছে কিন্তু চলছে ভালো। শেখ হাসিনার ইলেকশনে ঠিক আছে, রাতে ভোট হইছে কিন্তু তারপরেও জিনিসটা চলছে।
আপনি দেখেন, সাংবাদিকরা গিয়ে শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করছে, মন্ত্রীদের প্রশ্ন করছে – এটা কী? সে একটা অভিনয় করতে থাকে। বা ধরেন, এখন আমরা যাদের প্রশংসা করছি; তারা ওই জিনিসটাও তৈরি করে। আপনি যেমন পণ্যসামগ্রী বাজারে বিক্রি করছেন, তারাও এসব জিনিস একইভাবে বাজারে বিক্রি করে। বলে যে, ওকে, এভরিথিং ইজ ওকে। সরকার ভালো না চালালেও তারা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে আছে। আমরা গিয়ে প্রশ্ন করতে পারছি। ওমুক মন্ত্রীর জামাই কিন্তু এই ইয়েতে ধরা খেয়েছে, আমরা কিন্তু এই নিউজ দিয়েছি– এভাবে। এর মধ্যে দিয়ে তারা কী করে? এই যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, এটা কিন্তু আমরা জানতে পারি নাই। আমরা একটা ধারণার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত জানি না যে, এই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আসলে কত?
যেমন একটা উদাহরণ দেই—রাতে ভোট হয়েছে। কিন্তু কোনো পত্রিকায় কি তথ্যপ্রমাণ সহকারে এসেছে? ওই জায়গায় সে চ্যালেঞ্জ করবে না। কারণ ওই ব্যবস্থার সে অংশ। ধরুন, বিবিসিতে একটা নিউজ এসেছে, এ রকম নিউজ আমরা পেয়েছি। এখন গবেষণা, পাবলিক পারসেপশন এগুলোর মধ্যে দিয়ে রাতে হলেও এটা একটা প্রকাশ্যে ঘটা ঘটনা। এর সাথে নানান ধরনের লোক জড়িত। সাংবাদিকরা জানতো। আমরা কিন্তু এই ডকুমেন্টেশন পত্রিকা থেকে পেলাম না। আবার হয়তো হঠাৎ করে দেখবেন কোনো কোনো পত্রিকায় এমপিদের বিরাট আমলনামা ছাপা হলো। কিন্তু এই ব্যক্তিগুলোর প্রোফাইল দেখেন— একটু লো প্রোফাইল, একটু ঝামেলায় আছে এরা। এদের ছেপে ছেপে পত্রিকাগুলা দেখাবে, দেখছো আমি কিন্তু সরকারি দলের এই লোকগুলার কথা ছেপেছি। কিন্তু সালমান এফ রহমানকে ধরো, হাসান মাহমুদকে ধরো—এরকম ধরো। তা করবে না। আবার ক্ষমতার মধ্যে মোস্ট পাওয়ারফুল যে থাকে, হয়তো সে বলেছে, ওরে একটু ধরো, আমার কথা শুনছে না। তখন হয়তো সাংবাদিক বললো, হ্যাঁ ভাই পাইছি। তখন সম্পাদক আবার বলছে, ও তো পাওয়ারফুল। তখন আবার সাংবাদিক বলছে, না ভাই সমস্যা নাই; ওই দিক থেকে গ্রিন সিগন্যাল আছে। এভাবেই তো জিনিসটা ছাপা হয়। তখন আবার ওই নিউজ ছাপা হওয়ার পরে সে দৌড় দিয়ে যায়। বলে যে, নেত্রী আমার নিউজ ছাপছে! নেত্রী বলছে, হ্যাঁ নিউজ ছাপছে আসো আমি ঠিক করে দেই। আবার সে সাইজ হয়ে যায়। এই তো সিস্টেম।
হুমায়ূন শফিক: এই সিস্টেম বর্তমানে কেন চেঞ্জ হচ্ছে না?
মাহবুব মোর্শেদ: চেঞ্জের জন্য আমি সব আলোচনায় বলার চেষ্টা করি। ধরেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল প্রায় সাড়ে ১৫ বছর। এ সময় তারা কোনো পত্রিকা, কোনো অনলাইন, কোনো টেলিভিশন নিজেদের দলের বাইরে কোনো লোককে দেয় নাই। যেগুলো ভিন্নমতাবলম্বী ছিল, বিএনপি, জামায়াত বা অন্যান্য সেগুলোকে বেশিরভাগ বন্ধ করেছে। তাদের ডিক্লারেশন বাতিল করেছে। নানাভাবে তাদের হেনস্তা করেছে, বাকিদের মালিকানা চেঞ্জ হয়েছে। এখন বিষয়টা হয়েছে কি, এই যে তারা যে অ্যাটমোসফেয়ার তৈরি করেছিল, সেই অ্যাটমোসফেয়ারের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী কোনো টিভি, অনলাইন প্রকাশিত হওয়ার পরিস্থিতিই ছিল না। শুধু তাই নয়, টপ বসরা প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনের চাটুকার কিন্তু একজন, দুইজন যায় নাই। এখন মিড লেভেলে যারা, তারাও তো ধীরে ধীরে একটু আওয়ামীপন্থী, একটু ভারতপন্থী; একটু ভারতপন্থী না অনেকটা ভারতপন্থী। তারা বসদের পরের পজিশনে। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা দেখেছি যে, একটু ভিন্নমতাবলম্বীদের শেষ পর্যন্ত কি পরিণতি হয়েছে।
আপনার কোনো মতামত যদি থাকে তাহলে আপনি ওখানে চাকরি করার অযোগ্য। আপনার যদি কোনো পলিটিক্যাল অপিনিয়ন থাকে তাহলে আপনি ওখানে চাকরি করার অযোগ্য। মানে কী? দেখেন কী হতো, কর্মীরা তাদের পার্সোনাল ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে সেগুলো মনিটর করা হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে কে আওয়ামীপন্থী, কে বিএনপিপন্থী আইডেন্টিফাই করা হতো। কোনো একজন কর্মী স্ট্যাটাস দিচ্ছে, আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করছে; এটাকে তারা ইগনোর করতো। কিন্তু যে কোনো একজন কর্মী যখনই সরকারবিরোধী কোনো ক্রিটিক্যাল, কোনো পোস্ট দিত, তখনই কিন্তু তারা বসদের ডাক পেত, ‘এই তোমরা খুব বিপ্লবী হয়ে গেছো?’ এখন এটা চাকরির ক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাবিত করতো? আমি দেখেছি বা জানি কিন্তু বলা ঠিক হবে না। বলা হতো যে, ‘এই ছেলেটাকে নেওয়া যায়, ভালো। কিন্তু সরকারবিরোধী। কখন কী ফেইসবুকে লিখে ফেলে, এই ছেলেটাকে নেওয়া দরকার নাই।’ ফলে আমি যেটা বোঝাতে চাচ্ছি, টপ টু বটম; হ্যাঁ কর্মী আছে, সাধারণ কর্মী আছে, কিন্তু অপিনিয়ন যাদের আছে এ রকম সাংবাদিক এখানে ঢুকতে পারে নাই। ফলে এরা কী করেছে, এরা হলো চালাক। রাতারাতি দল বদল করে ফেলেছে। তারা কেউ ছাত্রদের পক্ষে, কেউ বিএনপির পক্ষে, কেউ জামায়াতের পক্ষে রং বদল করে ফেলেছে, মুখোশ বদল করে ফেলেছে। যখনই একটা ক্রাইসিস তৈরি হবে তখন তারা আবার আওয়ামী লীগ হয়ে যাবে।
এরা কখনও আওয়ামী লীগের দুর্নীতি প্রকাশ করবে না। আওয়ামী লীগের যে হত্যা, গুম, খুন, ছাত্রহত্যা, ছাত্র জনতার ওপর যে হামলা এগুলোর নিউজ তারা আর করবে না। শহীদদের নিউজ করবে না। এটাই তো বাস্তবতা। তারা যে কোনো সুযোগ কাজে লাগাবে। কারণ তারা মোক্ষম সময়কে কাজে লাগাবে। নেগেটিভ একটা সরকার ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু তো থাকেই। ওই লোকটা আওয়ামী লীগের পারপার্স সার্ভ করতে অভ্যস্ত। তাদের দ্বারা পেইড অনেকে আছে। সবাই না। তাদের পেইড লোক নানান রকমের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত। ওই প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। এই লোকগুলা তো আল্টিমেটলি গিয়ে ওই কাজটাই করবে। ফলে সরকার চেঞ্জ হলো, শেখ হাসিনার পতন হলো; তার মানে মিডিয়ায় একটা চেঞ্জ চলে আসবে তা কিন্তু না। এটা তো একটা বুদ্ধিভিত্তিক অঙ্গন।
আরেকটা ব্যাপার হলো, আওয়ামীপন্থী লোকজন মিডিয়ার ব্যাপারে বা মিডিয়াতে বেশি কাজ করে। এবং বেশি ইনভেস্ট করে। তাদের একটা বড় স্টেক আছে, আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, তারা হলো ভারতপন্থী। তারা মিডিয়ার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। তাদের ওই মেন্টালিটির সাংবাদিক বেশি। অন্যরা মাইনোরিটি। তারা হলো ম্যাকানিজমগুলা আরও বেশি ডিপলি করে, এতে তাদের আধিপত্য তৈরি হয়; অটোমেটিক একটা সাপোর্ট তৈরি হয়। এখানে তারা এগিয়ে থাকে। এই জিনিসটা যে আপনি মোকাবিলা করবেন, গায়ের জোরে করতে পারবেন না। বুদ্ধির জোরে করতে হবে। এখানে ন্যারেটিভ চেঞ্জ করার ব্যাপার আছে। বিশাল একটা বয়ান তৈরি করার ব্যাপার আছে। এখানে অনেক লোকের মতামত জড়িত। এখন অনলাইনের মতামত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।
এটা হলো সম্পূর্ণরূপে কৌশলগত ব্যাপার। আপনার আইডিয়া লাগবে যে, আপনি কী আনবেন? কোন জিনিসটাকে ফোকাস করবেন? কোন ঘটনাকে ফোকাস করবেন? টিভিতে কী দেখাবেন? মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা মোস্ট এসেনশিয়াল। রাষ্ট্র, সরকার চালানোর জন্য মিডিয়া ব্যবস্থাপনা খুবই এসেনশিয়াল পার্ট। সেই জায়গাটা আপনি কীভাবে করবেন? সেটা কিন্তু আপনার ডিসিশনের ব্যাপার। এখন যদি আপনি ইমম্যাচিউর; ‘একজন এসে বললো, ভাই আপনাকে খুব সন্দুর লাগছে!’ আপনি গলে গেলেন। তাহলে হবে না। বড় প্ল্যান লাগবে।
ধরেন বিএনপি জামায়াত যেভাবে ভুগেছে, তাদের যেভাবে মিডিয়ায় ফোকাস করা হয়েছে, যে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে, এই ন্যারেটিভ কিন্তু একটা জেনারেশন, জেনারেশনের পর জেনারেশনের মধ্যে আছে। আমরা সচেতনভাবে খেয়াল করতে পারবো না। হাসিনার প্রতি যে রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, তার যে অপশাসন, গুম, খুন, হত্যাকান্ড, লুটপাট এগুলার কারণে তার প্রতি ইমিডিয়েট ঘৃণা তৈরি হয়েছে। হাসিনাবিরোধী একটা মনোভাব তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটা মনোভাব তৈরি হয়েছে; কিন্তু এই যে ফ্যাসিস্ট সিস্টেম সেটা তো অন্যভাবে; মাথাতেও আসন গেড়েছে, সেটা কিন্তু মোকাবিলা করা অনেক কঠিন। শেখ হাসিনা গেছে, মানে ইমিডিয়েট সমস্যা গেছে। আরও অনেক ন্যারেটিভ তৈরি হতে থাকবে। ওটা রিপ্রোডিউস হতে থাকবে। তাহলে এর বিকল্পটা কী? এখানে আমাদের লিটারেচার, আমাদের গান, কবিতা এবং মিডিয়া একটা বিগ পার্ট। এই জায়গাটাতে আপনাকে কিছু কাজ করতেই হবে।
হুমায়ূন শফিক: শেষ করি আপনার লেখালেখির অবস্থান নিয়ে। বর্তমানে আপনি বাসস-এ জয়েন করেছেন। এখন কী লিখছেন?
মাহবুব মোর্শেদ: লেখার একটা পার্ট থাকে যে মসলা সংগ্রহ করা। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। এখন আমি মসলা সংগ্রহ করতেছি। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেছি। লেখার জন্যই তো সবকিছু। পেট চালানোর জন্য অনেক কিছুই করতে হয়। শুরুতেই বললাম লেখার জন্য এই পথে আসছি। সুতরাং লেখা অব্যাহত রাখতেই হবে।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম হব ব ম র শ দ কর র ব য প র ল খ র জন য র ব যবস থ এক ধরন র অন য ন য মন ত র র আম র ক ছ অবস থ ন ন ন রকম ক জ করত দ র একট ইনভ স ট ইন ট র ক জ কর অন ক ক কর ছ ন ব জন স ব দ কত আম দ র মন ভ ব র জন ত স গঠন ত রপর সরক র ক ষমত তখন ত সমস য হওয় র করত ম আপন ক আপন র ব এনপ করছ ন করব ন ন করত ন করছ
এছাড়াও পড়ুন:
জাকসু নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের কাউন্সিল কক্ষে তপশিল ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। তিনি বলেন, জাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৩১ জুলাই।
বিস্তারিত আসছে...