ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে একজনের ফাঁসি কার্যকর
Published: 1st, May 2025 GMT
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে এক ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। দেশটির বিচার বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ইরানের বার্তা সংস্থা মিজানে প্রকাশিত বিচার বিভাগের ঘোষণায় বলা হয়, গতকাল বুধবার সকালে মোহসেন লাঙ্গারনেশিন নামের ওই ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই বছর ধরে লাঙ্গারনেশিন মোসাদকে ‘ব্যাপক লজিস্টিক, প্রযুক্তিগত এবং কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত সহায়তা’ দিয়ে আসছিলেন।
লাঙ্গারনেশিনের বিরুদ্ধে ওঠা সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগগুলোর একটি হলো, তিনি ২০২২ সালের মে মাসে ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ড কোরের (আইআরজিসি) কর্নেল সাইয়াদ খোদায়িকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন। ঘটনার দিন তেহরানে নিজ বাড়ির দিকে ফিরছিলেন কর্নেল খোদায়ি। ওই সময় দুটি মোটরসাইকেলে করে আসা বন্দুকধারীরা তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে।
মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কর্নেল খোদায়ির হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছিল।
মিজানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, খোদায়ির গতিবিধি নজরে রাখার জন্য মোহসেন লাঙ্গারনেশিন নিজে একটি মোটরসাইকেল কিনেছিলেন। তিনি সেই মোটরসাইকেলের মাধ্যমে নজরদারি চালাতেন এবং সব তথ্য মোসাদকে সরবরাহ করতেন। হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন।
শুধু তা–ই নয়, লাঙ্গারনেশিনের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিল্প এলাকা ইস্পাহানে হামলায় সহায়তার অভিযোগও আনা হয়েছে।
ইরান সরকারের দাবি, মোহসেন লাঙ্গারনেশিনের বিরুদ্ধে তাদের হাতে গোয়েন্দা ও প্রযুক্তিগত প্রমাণ রয়েছে। এসব তথ্য প্রমাণ করে যে লাঙ্গারনেশিন এসব অভিযানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। লাঙ্গারনেশিন নিজেই তাঁর সম্পৃক্ততার কথা সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করেছে ইরান সরকার।
তবে নরওয়েভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা ইরান হিউম্যান রাইটসের (আইএইচআর) প্রধান মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম বলেছেন, ‘লাঙ্গারনেশিনকে সম্পূর্ণ একতরফা ও অনৈতিক বিচারের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। নির্যাতন করে তাঁর স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।’
বার্তা সংস্থা এএফপিকে মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম বলেন, ‘ইরানি কর্তৃপক্ষের মৃত্যুদণ্ডযন্ত্র প্রতিনিয়ত বেগবান হয়ে উঠছে—আরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।’
এসব মৃত্যুদণ্ডকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন মাহমুদ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন আবদুর রহমান বোরুমান্দ সেন্টার লাঙ্গারনেশিনের মামলাটি নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। সংগঠনটি বলছে, মোহসেন লাঙ্গারনেশিনকে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে গ্রেপ্তারের পর বিচারক আবুলঘাসেম সালাভাতির নেতৃত্বে তেহরানের একটি রেভল্যুশনারি কোর্টে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারক সালাভাতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা আছে। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার জন্য তাঁর কুখ্যাতি রয়েছে।
বোরুমান্দ সেন্টার আরও বলেছে, লাঙ্গারনেশিন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল দাবি করেছিলেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ইরানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ অভিনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী নাজানিন বনিয়াদি লিখেছেন, ‘রক্তপিপাসু ইসলামি প্রজাতন্ত্র আবারও একজন নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসি দিল।’
ইসরায়েলের সঙ্গে দশকের পর দশক ধরে ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ইরান এর আগেও মোসাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অনেক মানুষকে ফাঁসি দিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে চালানো নাশকতা ও গুপ্তহত্যার চেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের এমন শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
মোসাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনজন পুরুষ ও একজন নারীকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
লাঙ্গারনেশিনের মৃত্যুদণ্ড এমন সময়ে কার্যকর করা হলো, যখন কিনা ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি অভিযোগ করেছেন, এই আলোচনার প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে ইসরায়েল সচেতনভাবে ষড়যন্ত্র করছে। তেহরানের তথ্যমতে, আগামী শনিবার রোম শহরে ওমানের মধ্যস্থতায় ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে চতুর্থ দফার পারমাণবিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল ঙ গ রন শ ন র ক র যকর র কর ছ
এছাড়াও পড়ুন:
এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)
আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।
১. এটাই জান্নাতের পথ
এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’
এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি
বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।
তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’
এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।
৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট
মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?
এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।
৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা
পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।
৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।
আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫৭. পালিয়ে যাওয়া
ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।
৮. সহনশীলতার খেলা
পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।
৯. অস্বস্তিকর আলাপ
মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।
১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা
পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা
গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
১২. নিয়তের পবিত্রতা
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)
যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।
১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা
পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন
একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)
এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা
চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’
এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’
১৬. মায়ের শক্তি
আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।
১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত
আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।
১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট
পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।
২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব
এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।
সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪