ছবি: সংগৃহীত

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

এলএনজি: নতুন ঔপনিবেশিক হাতিয়ার?

আধুনিক সভ্যতা জ্বালানিনির্ভর। শিল্পকারখানা তো বটেই, দৈনন্দিন প্রতিটি কাজে বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা অচল। দুনিয়াজুড়ে সাধারণভাবে কয়লা, গ্যাস, তেল প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি বিশেষত কয়লা পোড়ালে বিপুল পরিমাণ কার্বন বাতাসে নির্গত হয়। অতিরিক্ত কার্বন বাতাসে মিশে পৃথিবীকে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর করে ফেলছে। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তাই দুনিয়াব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার পরিকল্পনা চলছে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি ত্যাগ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। লক্ষ্য, ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। নেট জিরো হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন নির্গত হচ্ছে, ঠিক ততটাই কোনো না কোনোভাবে অপসারণ করে ফেলা। অর্থাৎ ভূমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন জমা হবে না– এমন একটি অবস্থা।

ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সদস্য দেশগুলোও নেট জিরো অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ এর অন্যতম সদস্য। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বতন্ত্রভাবে কার্বন নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার না করলেও সিভিএফের সদস্য হিসেবে নেট জিরো অর্জন করা নৈতিক দায়। অর্থাৎ আমাদেরও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস সূর্যের আলো, পানির স্রোত, বাতাস ইত্যাদি। নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের জোর তৎপরতা থাকা উচিত হলেও, দুঃখজনকভাবে আমরা সেদিকে না গিয়ে এখনও জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। আগের চেয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। তা ছাড়া কয়লা নিয়ে অনেক বিতর্ক বলে আমরা আরেক জীবাশ্ম গ্যাস বিশেষত এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দিকে ঝুঁকছি। 

আমাদের জ্বালানি পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়েছে জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি)। সরকার তা অনুমোদনও করেছে। এতে পরিষ্কারভাবে এলএনজির কথা বলা হয়েছে। শুধু এলএনজি নয়; হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া প্রভৃতি ব্যবহার করেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। যদিও এসব উপাদান পৃথিবীতে ‘ফলস সল্যুশন’ বা ভুয়া প্রযুক্তি হিসেবে পরিচিত। বিস্ময়কর, আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করছে জাপান। এর অন্যতম সুফলভোগী হবে আমেরিকা। ইতোমধ্যে এক্সিলারেট এনার্জি, কাতার এনার্জি এবং ওকিউ ট্রেডিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি করেছে। পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কেনা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে ২৯ বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। সমঝোতা অনুযায়ী, আর্জেন্টের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৫০ লাখ টন এলএনজি কিনবে।

এলএনজি আমদানি, মজুত ও বিতরণের অবকাঠামো বাংলাদেশে নেই। তাই বিদেশি ঋণ ও কোম্পানির সাহায্যে বিশেষ অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সামিট গ্রুপ ও এক্সিলারেট এনার্জি দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) বসিয়েছে, যার প্রতিদিন ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস মজুত করার ক্ষমতা আছে। এ জন্য প্রতিবছর প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করতে হয়। সামিট গ্রুপের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০২৪ সালের জুলাইতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা স্থগিত করতে হয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরে তা আবার চালু করা হয়। সম্প্রতি মহেশখালীতে একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল বসানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। 

পরিহাসজনক হলো, আমরা অঙ্গীকার করেছি জ্বালানি স্থানান্তর অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাব। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানি এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছি। অঙ্গীকার অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রণোদনা দিলে, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে এর প্রসার ঘটত এবং জ্বালানি-স্বনির্ভরতাও বাড়ত। জ্বালানি-স্বনির্ভরতার দিকে না গিয়ে আমরা জ্বালানি কোম্পানি ও সরবরাহকারী দেশগুলোর স্বার্থে শক্তিশালী দেশগুলোর ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছি! আর শক্তিধর দেশগুলোও এলএনজিকে নতুন ঔপনিবেশিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

প্রসঙ্গত, বিগত দুই দশকে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে। আমরা প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি, যদিও প্রকৃত সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুতের প্রায় সবটাই কয়লা, গ্যাস ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হয়। এ ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ মাত্র ৪ শতাংশের মতো। অথচ অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশে গৃহস্থালি খাতে সর্বোচ্চ ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে না। যদি প্রথম ধাপে গৃহস্থালি খাতের বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের ওপর জোর দিই, তাহলে অনায়াসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। তা না করে এলএনজির অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিক বৈদেশিক মুদ্রার চাপে থাকতে হবে, তা যে কেউ অনুভব করতে পারেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বিদেশে গিয়ে নিম্নমানের কাজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়, তা আমরা জ্বালানি খাতেই ব্যয় করে ফেলব– এটি কি কোনো যুক্তিসিদ্ধ কাজ হতে পারে?

আবার প্রয়োজনের অনেক বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির আওতায় আমাদের প্লান্ট বসিয়ে রেখে উৎপাদন ব্যয় জুগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যক্তিমালিককে রাষ্ট্রীয় অর্থ দিয়ে ধনী থেকে ধনীতর করছি।    

উল্লিখিত এলএনজি ক্রয়চুক্তির কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রনায়করা আমাদের বাহবা দিতে শুরু করেছে। এই বাহবা যে তাদের স্বার্থ রক্ষা করার কারণে মিলছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসার লক্ষ্যে এ দেশে এসে ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকরা যখন দেখে একটি কোম্পানির দ্বারা তারা লাভবান হচ্ছে, তখন তারা ওই কোম্পানিকেই শক্তি জোগায় ভারতবর্ষকে শাসন করার। একশ বছর পর ব্রিটিশরাজ নিজেই ভারতবর্ষকে শাসন করার দায়িত্ব নেয়। প্রকৃতপক্ষে শাসনের নামে তারা ভারতবর্ষের অর্থ-সম্পদ পাচার করে তাদের দেশে নিয়েছে; তাদের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে আমরাও ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিলাম। এমনিভাবে অনেক দেশই আরেক দেশ দ্বারা শাসিত হয়েছে। রাজনীতি-বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে উপনিবেশ বলে। এখন আর ক্ষমতাধর কোনো দেশ সরাসরি অন্য কোনো দুর্বল দেশ দখল করে না। যত ক্ষমতাধরই হোক; দখলকারী দেশটি আগ্রাসী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। যেমন রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে বলে দুনিয়াব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। 

দেশ দখলের পরিবর্তে আজ চলছে ব্যবসা তথা অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ। কৌশলে শক্তিশালী অর্থনীতির একটি দেশ অন্য একটি দেশের অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ করছে। বাণিজ্য দ্বারা দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। বাণিজ্যিক কৌশলে বাজিমাত করাই হচ্ছে সবল অর্থনীতি বা শক্তিশালী দেশগুলোর উদ্দেশ্য। বাণিজ্য করার জন্য প্রয়োজন জুতসই পণ্য। যার কাছে সেই পণ্য আছে, সে প্রকৃত ক্রীড়নক তৈরির ভূমিকায় মঞ্চে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে যেখানে জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর, এলএনজি বর্তমানে একটি নতুন ‘জ্বালানি পণ্য’ হিসেবে আবির্ভূত। তা দিয়ে শক্তিশালী এবং ওই পণ্য নিয়ন্ত্রক দেশটি আমাদের অর্থনীতি, স্বার্থচিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। একেবারে ঔপনিবেশিক হাতিয়ার, যা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে উদ্যত। 

গৌরাঙ্গ নন্দী: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং চেয়ারপারসন, সেন্টার ফর এনভায়নমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ (সিইপিআর); হাসান মেহেদী: জ্বালানি খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং প্রধান নির্বাহী, কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (ক্লিন)

সম্পর্কিত নিবন্ধ