ছবি: সংগৃহীত

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

জন-আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। এই ভূমির নিকট ইতিহাসে এটি একটি অনন্য ও ঐতিহাসিক পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কেননা জাতীয় রাজনীতিতে গভীরভাবে গেড়ে বসা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে এই অভ্যুত্থান। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন পর্যায়ক্রমে দল-মত-জাতি-শ্রেণি-লিঙ্গনির্বিশেষে আপামর জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনে নাগরিকেরা গুম, খুন, মামলা, হামলাসহ যে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিলেন; তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় প্রবল গণবিস্ফোরণ ঘটেছিল। সে কারণে এই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের পুরোনো ও নতুন রাজনৈতিক দল—সবার জন্যই বড় একটি শিক্ষা।

খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার তাঁর পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় লোকদের দিয়ে নির্বিচার বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রদের বুকে সরাসরি গুলি করে যখন হত্যা করা হয়েছে, তখন সর্বস্তরের নাগরিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদন বলছে, গণ-অভ্যুত্থান পূর্বাপর সময়ে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত মানুষের সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে আমরা শহীদ ছাত্র, শ্রমিক, শিশু ও সাধারণের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়ার মতো যেসব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা, তার বিচারপ্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আমরা মনে করি, একটি ন্যায়বিচারই জুলাই অভ্যুত্থানের হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে বড় পথ।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ায় এটি ঘিরে যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা ছিল যেমন ব্যাপক, আবার বহুমাত্রিকও। এক বছর পর এসে অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর অমিল থাকাটা বেদনাদায়ক। বিশেষ করে, প্রথম দিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও সময় যত গড়িয়েছে, ততই নারী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং শ্রমজীবী নাগরিকেরা দৃশ্যপট থেকে বাদ পড়ে গেছেন, কোথাও কোথাও তাঁরা আক্রান্তও হয়েছেন, মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। রাজনীতিতে উগ্রবাদী এবং দক্ষিণপন্থার উদ্বেগজনক উত্থান ও প্রভাব বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক বছরেও স্বাভাবিক অবস্থায় না ফেরা এবং অপরাধ বেড়ে যাওয়াটাও মানুষের অস্বস্তির বড় কারণ।

আমরা মনে করি, গত এক বছরে জনমানসে যে বড় পরিবর্তন এসেছে, সেটাই এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অর্জন। বিগত বছরগুলোতে ডিজিটাল সিকিউরিটি বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো কঠোর আইনের কারণে মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল এবং সব পর্যায়ে ভয়ের সংস্কৃতি জেঁকে বসেছিল। গত এক বছরে ডিজিটাল ও বাস্তব—দুই পরিসরেই তর্কবিতর্ক ও কথা বলার সুযোগ বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাধা থাকলেও সমাজের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য এ চর্চা অত্যন্ত ইতিবাচক।

রাজনীতিতে আর যেন স্বৈরতন্ত্র ফিরে না আসে, সে জন্য রাষ্ট্র, সরকার ও শাসনকাঠামোয় সংস্কারের একটি বড় আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। এটা সত্যি যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যে চর্চা ও বাস্তবতা, তাতে একবারেই সব সংস্কার হয়ে যাবে, এমন আশাবাদ বাস্তবসম্মত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দফায় দফায় আলোচনার পর সংস্কার নিয়ে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা উপেক্ষণীয় নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো দিনের পর দিন একসঙ্গে বসে দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে যে আলোচনা করেছে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বিগত তিনটি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনে দেশের নাগরিকেরা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এ পরিপ্রেক্ষিতে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিকেরাও অপেক্ষা করে আছেন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আমরা মনে করি, ফেব্রুয়ারি মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। আশা করি, আগামী নির্বাচনটি হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। জন-আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, এটাই প্রত্যাশিত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ