প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রায় নিয়মিত প্রাক্‌–বাজেট আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে কমবেশি অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা, প্রতিযোগী বা সমমানের দেশগুলোর উদ্যোগ বিবেচনায় আমাদের করণীয় এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ ভালো ভালো কথা অনেকে বলেছেন; আমিও বলেছি।

কিন্তু বাজেট উপস্থাপনার পর সেগুলোর বেশির ভাগ ন্যূনতমভাবেও প্রতিফলিত হয়নি। তাই সময় পরম্পরায় আমাদের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া অনেকটা আটপৌরে বা গতানুগতিক কাঠামোয় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বর্তমান সরকার কোনো বিপ্লবী সরকার নয়, তাই তাদের কাছ থেকেও আমরা কোনো বিপ্লবী বাজেট আশা করছি না। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী আর বাজেট ব্যবস্থাপনায় কিছুটা আপাতসততা নিয়েই হয়তো আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

বেশ কয়েক বছর ধরেই চাপে রয়েছে অর্থনীতি। এর মধ্যে গেল আগস্টে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা থাকলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতি রয়েছে। অনেকের মতে, এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বা ধোঁয়াশা। এই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছে। নতুন বাজেট ঘোষণার আগে অর্থনীতিতে আটটি বড় চ্যালেঞ্জের উপস্থিতি দেখছে খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি অবশ্যই একটি ভালো দিক।

বাজেট সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি একটি প্রতিবেদনে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি এবং শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো প্রধান চ্যালেঞ্জ।

তারা যথার্থই বলেছে, অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানিসংকটে শিল্প উৎপাদন ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকর বাজেট প্রণয়নে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রাক্‌–বাজেট আলোচনায় আমাদের অনেকের সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা নিজেও এগুলো নিয়ে একমত হয়েছেন। সেই বিবেচনায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের চলমান আটটি কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ এবং কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমে গেছে। ব্যবসা সম্প্রসারণও থমকে গেছে। বিনিয়োগের ওপর এমন নেতিবাচক প্রভাবের কারণে নতুন কর্মসংস্থানের গতি ধীর। বিনিয়োগ পরিস্থিতি বুঝতে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি অন্যতম নির্দেশক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে সোয়া ৩ লাখ। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ ৩০ হাজার। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৪ লাখ। এর কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন সরকারের দ্বিধা নাকি শ্লথগতি, জানি না। তবে চলতি বছরের ৯ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন মাত্র ৪০ শতাংশ। বাস্তবায়নের গুণগত মানের কথা নাই–বা বললাম।

তথ্যানুযায়ী অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণেও দেখা গেছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা আদায়ের দাবিতে আন্দোলন-হামলার ঘটনায় কিছু পোশাক কারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাজেটের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নতুন বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো খাতের কর্মযজ্ঞ বাড়ানো হবে।

পত্রিকানুযায়ী আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এনবিআরকে আদায় করতে হবে। এনবিআরবহির্ভূত কর এবং কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে তা (জুলাই-মার্চ) মাত্র ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা কম। আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম অটোমেশনসহ শুল্কছাড় ও কর অব্যাহতি কমিয়ে আনাসহ নতুন বেশ কিছু খাতে ভ্যাট ও কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

আমরা আগেই জেনেছি, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যয়ের আকার চলতি বছর থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ধরা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটের আকার কমলেও পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। তেমনি উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার। আগামী বাজেটে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি ইতিমধ্যে একনেক অনুমোদন করেছে।

দেশি-বিদেশি উৎসে এখন সরকারের মোট ঋণ প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকা। নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে দেশি ও বিদেশি মিলে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে শুধু সুদ পরিশোধেই সরকারের ব্যয় প্রস্তাব করা হচ্ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত ব্যয় আরও বেশি হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

গতানুগতিক বাজেট, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যে আমাদের অর্থনীতিকে সাবলীলভাবে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে না, তা নিয়ে আমরা প্রায় সবাই একমত। অন্যদিকে একটি সত্যিকার প্রভাবশালী বাজেট প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নে জনপ্রশাসন বা রাজস্ব প্রশাসন, এমনকি একটি নৈমিত্তিক সরকারের সক্ষমতা নিয়েও আমাদের সন্দেহ রয়েছে। এই সন্দেহ দূরীকরণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি রাজনীতিটাকেও ঠিক করতে হবে। কান্ডারি বাছাইয়েও হতে হবে খুব সতর্ক। 


মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নত ন ব জ ট বছর র ব সরক র র র জন ত আম দ র ব যবস ন নয়ন

এছাড়াও পড়ুন:

সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি বাস্তবায়নে কমিটি 

সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (গভর্নেন্স পারফরমেন্স মনিটরিং সিস্টেম- জিপিএমএস)’ বাস্তবায়নে অর্থ উপদেষ্টা  সালেহউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে তিন সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করেছে সরকার। 

সম্প্রতি এই কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

কমিটিতে বাকি দুই সদস্য হলেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারি কাজের জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিতে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) পরিবর্তে নতুন সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (জিপিএমএস) চালু করা হয়েছে। এই জিপিএমএস বাস্তবায়নে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার), বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব কমিটিকে সহায়তা করবেন। তাছাড়া, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে।

এ কমিটি জিপিএমএস বাস্তবায়নের বিষয়ে সার্বিক দিক-নির্দেশনা দেবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসে সেকশন ১-এর আওতায় প্রস্তুত করা পরিকল্পনা অনুমোদন দেবে এবং অর্থবছর শুরুর আগে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত করবে এ কমিটি।

এছাড়া, প্রতি অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসের সার্বিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে। জিপিএমএস বিষয়ে সরকারের দেওয়া অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টানা তিন মাস কমল দেশের পণ্য রপ্তানি
  • বেসরকারি ঋণ তলানিতে, তবে ঋণপত্র খোলায় গতি
  • টানা দুই মাস আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে
  • তিন মাসে গৃহকর আদায় কমেছে ৩০ কোটি টাকা
  • জুলাই–সেপ্টেম্বরে ঋণছাড়ে এগিয়ে বিশ্বব্যাংক ও রাশিয়া, কোনো অর্থ দেয়নি চীন
  • সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি বাস্তবায়নে কমিটি