গোশত দেখে নয়, গেরস্ত দেখে কোরবানির পশু কিনুন
Published: 31st, May 2025 GMT
গেরস্তের গরুগুলো গোশতে নয়, স্বপ্নে ভরা। স্বামীহারা মহিরুণের মা গতর খেটে দিনের পর দিন বড় করে তোলেন একটি গাই। সেই গাই প্রসব করে একটি ষাঁড় বাচ্চা। মহিরুণের মায়ের চোখ-মুখ খুশিতে চিকচিক করে ওঠে। দুধ বেচেন, সেই টাকায় কুঁচো চিংড়ির ভাগা কিনে আলু-কচু দিয়ে দিনাতিপাত করেন। স্বপ্ন দেখেন—ষাঁড় বাচ্চাটাকে বড় বলদ করে বিক্রি করবেন। সেই টাকায় বিয়ে দেবেন মেয়েটারে।
মহিরুণের মায়ের মতো ষাটোর্ধ্ব কৃষক জয়নাল মিয়ার পিঠ ও কোমর বাঁকা হয়ে গেছে হালের জোয়ালের মতো। তিনি দুটি গরু বড় করে তুলছেন। স্বপ্ন—অভাব ঘোচাতে আদরের ‘ছাওয়াল’টারে বিদেশে পাঠাবেন। পেটের পীড়ায় ভোগা রহিম মিয়া স্বপ্ন দেখেন, ছাগলজোড়া বিক্রি করে এবার ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখাবেন। ভবতোষ পোদ্দারের স্বপ্ন, গরু আর ছাগলজোড়া বিক্রি করে এবার যেভাবেই হোক, মেটাবেন মহাজনের ঋণের বোঝা। আথালের বাছুরসমেত গাই বিকিয়ে ঝড়ে ভেঙে পড়া পাটখড়ির ঘরটারে দোচালা টিনের ঘর করার স্বপ্ন দেখেন ভূমিহীন খতেজা বিবি।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি এবং উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে পশুর দাম এবারও বেশি হতে পারে। কোনো কারণে পশু বিক্রি কম হলে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খামারিরা, কৃষকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আগে দেশের বাইরে থেকে যে কোনো পন্থায় পশু আনার পথ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।এমন হাজারো স্বপ্ন নিয়ে নাম না-জানা অসংখ্য গ্রামে খেটে খাওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁদের প্রিয় গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া বড় করে তোলেন। মাঠে-ঘাটে চরিয়ে, বাগানের লতাপাতা কুড়িয়ে তাঁরা বড় করে তোলেন প্রাণীগুলো। তাঁদের প্রায় সবারই স্বপ্ন—বয়সোপযুক্ত প্রাণীগুলো কোরবানির হাটে বিক্রি করবেন, একটু বেশি দাম পাবেন।
আবহমানকাল থেকে গ্রামবাংলায় কোরবানির পশু বিক্রি হয় রং ও গঠন দেখে।
কোরবানিদাতাদের কাছে মাংসের পরিবর্তে অগ্রাধিকার থাকে গরুর রং, চোখ, পেট ও লেজের গড়ন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নগর ও শহরে ভিন্ন এক সংস্কৃতির উদ্ভব হতে দেখা গেছে। এর ছোঁয়া লেগেছে গ্রামগুলোতেও। কোরবানির প্রাণীগুলো কতটা মোটা, কত মণ মাংস হবে—এর ওপর হিসাব কষে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। বিষয়টা দোষের নয়; বরং ন্যায্যতার। তবে প্রান্তিক গেরস্তের স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এখানে সামর্থ্যবান মানুষের প্রতি একটি আবেদন জানাতে চাই, আপনারা গোশতের পরিমাণ দেখে নয়; বরং গেরস্তের ধরন দেখে কোরবানির পশুর মূল্য পরিশোধ করুন। সম্ভব হলে গ্রামে খুঁজে খুঁজে অসহায় ও দরিদ্র কৃষকদের বের করুন। তাঁদের হাড্ডিসার গরু-ছাগলগুলো বেশি দামে কিনুন। এতে এই মানুষগুলোর অনেক উপকার হবে। খুশি হবেন সৃষ্টিকর্তা। কোরবানি তো সৃষ্টিকর্তার খুশির জন্যই দিয়ে থাকেন; তাহলে সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা স্রষ্টার সৃষ্টিকে খুশি করবেন না কেন?
দুই.মনে রাখবেন, প্রাণের মূল অস্তিত্ব কৃষিতে। কৃষি অর্থনীতি মানব অর্থনীতির মূল ভিত্তি। শুধু দীনহীন নয়, জগতের তাবৎ ধনকুবেরকেও কৃষিপণ্য খেয়ে বাঁচতে হয়। তাঁদের ইট-চুন-সুরকি বা লোহালক্কড় খেলে চলে না। প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত যন্ত্রে বিশ্ব হাতের মুঠোয় চলে এলেও তাঁদেরও এসব খেয়েই বাঁচতে হয়। তাঁরা যন্ত্র, সফটওয়্যার বা মহাকাশের শূন্যতা খেতে পারেন না; অর্থাৎ কৃষিই হলো মানবজাতির অস্তিত্ব।
সারা বিশ্বের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে পশু পালনের গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের পশুপালন অর্থনীতির ‘সিজনাল ইনজেকশন’ হলো পবিত্র ঈদুল আজহা—যা আমাদের কাছে কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। এটি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়; বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিশেষ করে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর সঙ্গে অর্থনীতির জোগান, বাজার ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, পণ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের গভীর সংযোগ রয়েছে।
কোরবানিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া পালন করা হয়। ছোট, মাঝারি ও বড়—বহু খামারি প্রাণী লালন-পালন করেন শুধু কোরবানির বাজার লক্ষ্য করে। অর্থনীতিতে ‘সিজনাল ইনজেকশন’ হলো কোনো উৎসব বা মৌসুমকে কেন্দ্র করে একসঙ্গে অনেক অর্থের আগমন। আর বাংলাদেশে পশু পালন অর্থনীতির সিজনাল ইনজেকশন হলো কোরবানির ঈদ। এটি হলো গ্রামীণ অর্থনীতির নগদ অর্থপ্রবাহ। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ খরচ হয় কৃষি, খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, পরিবার গঠন, চিকিৎসা ইত্যাদি খাতে।
প্রাণী লালন-পালনে ঘাসের পাশাপাশি দরকার হয় খড়, খইল ও ভুসির; যা মূলত কৃষিজাত পণ্য। এতে ফসলের উপজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে ও কৃষকেরা এসব বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন। কোরবানির মৌসুমে পশুর হাট বসে, যেগুলো স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। হাটে ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, খাঁচা নির্মাণ ইত্যাদি কাজে বহু মানুষ অস্থায়ীভাবে কাজ পায়—এটি একধরনের কৃষি-সম্পৃক্ত অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান।
কোরবানির সময় বিপুল চামড়া আহরিত হয়, যা বাংলাদেশের চামড়াশিল্প ও রপ্তানি খাতের কাঁচামাল। উপযুক্ত সংরক্ষণ, সংগ্রহ ও মূল্য নিশ্চিতের প্রতি সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। বেশ কয়েক বছর ধরে কাঁচা চামড়ার দামে যে খারাপ অবস্থা গেছে, আশা করা যায়, এবার এটার কিছুটা হলেও উন্নতি হবে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গ্রামীণ পর্যায়ে গরুর সর্বনিম্ন চামড়ার দাম ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা। চামড়া বেচা টাকা গরিব ও অসহায় মানুষদের হক বা অধিকার। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এতিমখানাগুলোর পুঁজির অন্যতম উৎসব চামড়া বেচা টাকা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশে কোরবানির জন্য প্রস্তুত পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৮ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭। এর মধ্যে রয়েছে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু ও মহিষ এবং ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৬৮০টি ছাগল ও ভেড়া। এ ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির পশু রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে এই সংখ্যা পর্যাপ্ত। অতিরিক্ত ২০ লাখ ৬৮ হাজার প্রাণী রয়েছে। গত বছর (২০২৪ সাল) দেশে কোরবানির পশু জবাইয়ের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮। প্রস্তুতি ও অতিরিক্ত পশুর সরবরাহ বিবেচনায় এবার কোরবানির পশু জবাইয়ের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি এবং উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে পশুর দাম এবারও বেশি হতে পারে। কোনো কারণে পশু বিক্রি কম হলে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খামারিরা, কৃষকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আগে দেশের বাইরে থেকে যে কোনো পন্থায় পশু আনার পথ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
সীমান্তে গরু চোরাচালান বন্ধে কঠোর হতে হবে। কারণ, ঈদুল আজহা কৃষিনির্ভর অর্থনীতির একটি মৌসুমি চালিকা শক্তি। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা ও নীতিগত সহায়তা পেলে কোরবানিকে ঘিরে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের কৃষি ও খামার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। আর হৃদয়বান-সামর্থ্যবান মানুষদের একটু উদ্যোগ ঘুরিয়ে দেবে গ্রামের অসহায়-দরিদ্র কৃষক নারী-পুরুষের জীবন।
মো. ছানাউল্লাহ সহসম্পাদক, প্রথম আলো
sanaullah@prothomalo. com
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক রব ন র প গ রস ত
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের সমর্থকদের সরি বললেন লিটন
পাকিস্তানের কাছে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ হারের পর দর্শক-সমর্থকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক লিটন দাস। বলেছেন, তাঁর দল সামনে ঘুরে দাঁড়াবে।
গতকাল লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের কাছে ৭ উইকেটে হারে বাংলাদেশ। একই মাঠে আগের দুই ম্যাচে ৩৭ ও ৫৭ রানে হেরেছিল লিটনের দল।
সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে আগে ব্যাট করেছিল পাকিস্তান, বাংলাদেশকে দিয়েছিল ২০২ রানের লক্ষ্য। আর শেষ ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করেছে বাংলাদেশ দল পাকিস্তানকে দিতে পেরেছে ১৯৭ রানের লক্ষ্য। আগের দুই ম্যাচে রান তাড়ায় বাংলাদেশ সফল না হলেও প্রায় কাছাকাছি রান পাকিস্তান তুলে নিয়েছে ১৬ বল হাতে রেখে।
ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লিটন বলেন, ‘আমরা আগের দুই ম্যাচেও বোলিং ও ফিল্ডিং ভালো করিনি। (আজকের) পিচে ব্যাটিং ভালো করেছি। ভালো উইকেট। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটসম্যানের জন্য কীভাবে বোলিং করতে হবে, সেটা আমাদের শেখা দরকার এবং ভাবা দরকার।’
সিরিজের তিন ম্যাচের সব কটিতে হেরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি আসলে কিছুই নেই। তবে ইতিবাচক দিক কী আছে—সঞ্চালকের এমন প্রশ্নে লিটন তুলে ধরেছেন তৃতীয় ম্যাচে পারভেজ হোসেন-তানজিদ হাসানের ১১০ রানের জুটি ও অন্যদের ব্যক্তিপর্যায়ের সাফল্যের কথা, ‘ইমন (পারভেজ) ও তানজিদ সত্যিই ভালো ব্যাটিং করেছে। আর বেশির ভাগ ছেলেই নিজেদের চেষ্টাটা করে গেছে, ভালো করেছে।’
গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে সিরিজের সব ম্যাচেই বাংলাদেশ সমর্থন পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দর্শকদের ধন্যবাদ জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন লিটন, ‘দর্শকদের সমর্থন চমৎকার ছিল। তারা দুই দলকেই সমর্থন করেছেন। কোনো ম্যাচই জিততে পারিনি বলে আমি বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছে সরি। আশা করি, আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’
লিটনের দলের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর পরবর্তী অভিযান জুলাই, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। তার আগে শ্রীলঙ্কাতেই দুই টেস্ট ও তিন ওয়ানডে খেলবে বাংলাদেশ দল। যার শুরুটা হবে ১৭ জুন গল টেস্ট দিয়ে।