বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া করিডর: শ্রমিক পাঠানো নিয়ে সমস্যা কাটবে কীভাবে?
Published: 2nd, June 2025 GMT
প্রায় এক বছর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার পর দুই দেশ বর্তমানে আবারও বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ শুরু করার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়া আবারও উৎস দেশগুলো থেকে শ্রমিক নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর জানান দেয়।
১৩ মে ২০২৫ বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা ও বাংলাদেশের শ্রমিকদের অংশগ্রহণসংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য গমন করেন এবং সেখানে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, আলোচনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, তা হচ্ছে নতুন করে শ্রমবাজার খোলা হলে বাংলাদেশ থেকে কী প্রক্রিয়ায় সেখানে লোক প্রেরণ করা হবে অর্থাৎ আগের মতো কতিপয় রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটই কাজ পাবে, নাকি বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক প্রেরণের সুযোগ পাবে—এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দ্বিতীয়ত যাঁরা গত বছর শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর যেতে পারেননি, তাঁদের মালয়েশিয়াতে যাওয়ার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এ ছাড়া এবারের আলোচনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রাধান্য পেতে পারে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশকে লেখা দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব আজমান মোহাম্মদ ইউসুফের ২৩ এপ্রিল তারিখের একটি চিঠির বিষয়বস্তু, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ নিউজের বরাতে প্রকাশ পেয়েছে। চিঠিতে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশকে মানব পাচারসংক্রান্ত বার্ষিক মার্কিন প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ার রেটিং উন্নত করার জন্য দুই দেশের মধ্যে শ্রম অভিবাসনে অন্যায়ের ‘অপ্রমাণিত অভিযোগ’ পর্যালোচনা এবং প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে।
উল্লেখিত ইস্যুগুলো আমি এখন একটি করে আলোকপাত করব। প্রথমত, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অধীন ২০২২ থেকে ২০২৪ সময়ে প্রায় চার লক্ষাধিক শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়াতে গমন করেন।
মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আরোপিত শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে কিছু সিলেক্টেড রিক্রুটিং এজেন্সি লোক প্রেরণের অনুমতি পায়। যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি লোক প্রেরণের এই অনুমতি পেয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তারা বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে এনলিস্টেড হয় বা শ্রমিক প্রেরণের অনুমতি পেয়েছিল। একজন অভিবাসী থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো চার্জ করা হয়। সে সময় অভিযোগ ওঠে যে শ্রমিকেরা হাজার হাজার ডলার পরিশোধ করেও মালয়েশিয়াতে প্রতিশ্রুত চাকরি পাননি এবং ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে মানবেতর ও অনিশ্চিত জীবনের সম্মুখীন হয়েছেন।
এ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত কমিশনারের অফিস থেকেও তীব্র সমালোচনা করা হয়। এ ছাড়া কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশের একটি নির্দিষ্ট ডেটলাইন বেঁধে দেওয়ায় প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি ভিসা, বিমানের টিকিট সবকিছু ঠিক থাকার পরও সে সময় মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি। ৩০ মে ২০২৪ তারিখ ছিল মালয়েশিয়া কলিং ভিসায় এন্ট্রির নির্দিষ্ট সময়সীমা। এর ফলে বেশির ভাগ শ্রমিক সম্পূর্ণ বা সিংহভাগ খরচ পরিশোধ করার পরও বিদেশে না যেতে পেরে ধারদেনায় দুর্বিষহ পরিস্থিতির স্বীকার হন। এগুলো সবই অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় লেক অব গভর্নেন্স বা সুশাসনের অভাবকেই ইঙ্গিত করে।
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে অভিবাসন পদ্ধতি নিয়ে যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, সিন্ডিকেট করা যায়, এমন সিস্টেম যেন আবারও ফিরিয়ে না নিয়ে আসা হয়। এর মাধ্যমে আবারও একই ধরনের পরিস্থিতি যথা উচ্চ অভিবাসন খরচ, ঠিকমতো কাজ না পাওয়া এবং ঋণগ্রস্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
রিক্রুটমেন্ট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অভিবাসনের ফলে একটি বড় অভিযোগ এসেছে যে কোনো কারণ ছাড়াই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণের কারণে অতিরিক্ত দেড় লাখ টাকা শ্রমিকদের ওপর চার্জ করা হয়। এ টাকা সিন্ডিকেটের মূল হোতাগণ অন্যায্যভাবে বা অন্যায়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাই অবশ্যই সিন্ডিকেট সিস্টেম থেকে সরকারকে বের হয়ে আসতে হবে এবং অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে কিংবা সব এজেন্সির জন্য লোক প্রেরণের অধিকার প্রদান করতে হবে, যা মালয়েশিয়ার সরকার অন্যান্য উৎস দেশগুলোর ক্ষেত্রেও দিয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, মানব পাচার এবং অর্থ পাচারের অভিযোগকে অমূলক ঘোষণা দিয়ে বা সেগুলো বিচার না করে এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য উৎস দেশকে চাপ প্রদান করা মূলত ন্যায়বিচার পরিপন্থী। এটা সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে সাহায্য করবে প্রতিকার না করে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার পরিস্থিতি (টিআইপি) রিপোর্টে মালয়েশিয়ার রেটিং শুধু বাংলাদেশ কর্তৃক অভিযোগ প্রত্যাহারের ওপর নির্ভর করে না। শ্রমিকদের অমানবিক পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বেশ কিছু কোম্পানি শ্রমিকদের কর্মব্যবস্থা করতে পারেনি, কাজ না পেয়ে অনেক শ্রমিকেরা অনাহার–অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন, যা সময়-সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রিপোর্ট হচ্ছে।
শ্রম অভিবাসনের উচ্চ খরচ শ্রমিকদের ঋণের বোঝায় ফেলে এবং বিদেশে যাওয়ার পর তাঁদের নির্যাতনের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। মানবাধিকারকর্মীরা বহু বাংলাদেশি ও অন্যান্য অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতন, এমনকি ঋণের জালে আটকে পড়ার ঘটনাও নথিভুক্ত করেছেন, যা প্রথম পয়েন্টে বর্ণিত রিক্রুটমেন্ট সিস্টেমের যে জটিলতা ও অসারতার দিকেই আবারও ইঙ্গিত করে। মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থকে সংরক্ষণ করে যে ব্যবস্থাটি তৈরি করা হয়েছে, তার আশু পরিবর্তন দরকার। কেননা, সিন্ডিকেটের কারণেই অভিবাসন খরচ দ্বিগুণ হয়েছে বিগত ১০ বছরে।
এসব ঘটনা মালয়েশিয়ার মানব পাচারসংক্রান্ত রেকর্ডকে প্রভাবিত করেছে। এক দশকের অধিকাংশ সময় ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বলছে, মালয়েশিয়া মার্কিন মানব পাচার শিকার সুরক্ষা আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মান পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত ১০ বছরে অন্তত ৮ বার যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মালয়েশিয়া হয় যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না, নয়তো নেওয়া পদক্ষেপগুলো সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়।
দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান যে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মানব পাচার ও অর্থ পাচারের যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিকার না করে উল্টো বাংলাদেশকে অভিযোগ প্রত্যাহার করার চাপ দেওয়া মূলত আন্তর্জাতিকভাবে মালয়েশিয়ার অবস্থানকে আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং এটা সংঘটিত অন্যায়গুলোকে আরও প্রশ্রয় দেবে এবং পুনরায় শ্রমিকদের একই পরিণতির শিকার হতে হবে।
গত বছরে শ্রমিক প্রেরণের অব্যবস্থাপনার বা শ্রম অভিবাসনসংক্রান্ত অনিয়মগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্ত শুরু করে এবং অভিবাসন সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে অভিযোগ করা হয়।
গত অক্টোবরে বাংলাদেশ পুলিশ মালয়েশিয়ার সরকারকে দুজন অভিবাসন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার ও দেশে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ করে, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিবাসী শ্রমিকদের পাচার, অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনও কতিপয় রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মালিক ও সাবেক সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে, যাঁদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
এমতাবস্থায় মালয়েশিয়ার চাপে বাংলাদেশকে মানব পাচার, অর্থ পাচার ও অর্থ আত্মসাৎ–সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো যদি প্রত্যাহার করতেও হয়, তবুও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনি প্রক্রিয়াতে যে মামলাগুলো চলমান, তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এটি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতাও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। ভুক্তভোগী শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং তাঁদের যে অভিযোগগুলো রয়েছে, তা আমলে নিয়ে অবশ্যই এই দুষ্টুচক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তৃতীয়ত, ৩০ মে ২০২৪ মালয়েশিয়াতে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার কারণে যেসব শ্রমিক বৈধ কাগজপত্র বা ভিসা থাকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, তাঁদের বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করা। বিগত এক বছরে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা শ্রমিকদের বিষয়ে অনেক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফরকালে যাঁরা কলিং ভিসা থাকা সত্ত্বেও যেতে পারেননি, তাঁদের মালয়েশিয়াতে কাজের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে আশ্বাস দেন এবং মালয়েশিয়া থেকে জানানো হয় এ রকম বৈধ কলিং ভিসা থাকা সত্ত্বেও যেতে পারেননি, তার সংখ্যাটি আনুমানিক ১১,০০০ হাজার।
আনোয়ার ইব্রাহিম তাঁদের নেওয়ার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে একাধিকবার জানান দেন। যদিও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন যে প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়া আট হাজারের মতো (গতবার না যেতে পারা) শ্রমিককে মালয়েশিয়াতে কাজের সংস্থান করে দেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক ও সংবাদমাধ্যমের সূত্রমতে, এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
কিন্তু মালয়েশিয়ার সরকার সম্প্রতি যে সংখ্যাটি বলেছে, তা খুবই কম। সুতরাং প্রকৃত সংখ্যাটি আসলে কত, কী নিরূপণ জরুরি এবং অন্য যাঁরা একই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটাও আলোচনায় আসা উচিত। তাঁদেরকেও কর্মসংস্থানের সুযোগ বা পুনর্বাসনের জন্য ও জরুরিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
অভিবাসী শ্রমিকেরা আমাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম মূল উৎস। তাঁরা সম্মানের সঙ্গে যাতে মাইগ্রেশন করতে পারেন এবং নিশ্চয়তার সঙ্গে তাঁরা গন্তব্য দেশে যাতে কাজ পেতে পারেন—এর নিশ্চয়তা বিধান করা বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং অগ্রাধিকারের বিষয়। তা না হলে আমাদের কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক আয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ড.                
      
				
                    
    
				 মোহাম্মদ রাশেদ আলম ভূঁইয়া পিএইচডি (অভিবাসন ও অনিশ্চয়তা/ ঝুঁকি), সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষক, রামরু
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অর থ প চ র শ রমব জ র প রক র য পর স থ ত র সরক র ব যবস থ পদক ষ প গ রস ত প র নন মন ত র র জন য র অন য অন য য গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
জাতির স্বার্থে খোলামেলা আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারসহ সব পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শফিকুর রহমান।
জাতীয় নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা সময়মতো ঘোষণা করা হবে বলে বলেও জানান তিনি। এছাড়া, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, জামায়াতের তালিকা কবে ঘোষণা করা হবে জানতে চাইলে দলের আমির বলেন, “তারাও (বিএনপি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭ টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আবার এটিও চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।”
“আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরো অনেককে আমরা ধারণ করব, দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।”
আসন্ন নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে জামায়াতের আমির বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই।”
মতানৈক্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: রাজনীতিতে মতানৈক্য কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”
“আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই” বলেন তিনি।
খোলামেলা আলোচনার আহ্বান:
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি ও গণভোটের বিষয়ে শফিকুর রহমান বলেন, “আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি দিয়ে দিয়েছি।”
সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, উনারা সময় বেঁধে দেই নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, তাহলে তারা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবে। সরকার ভালো কথাই বলেছে।”
তিনি বলেন, “আমরাই সবার আগে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে জাতির স্বার্থে একটা সমাধানে পৌঁছি। আমরা আশা করি, অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন।”
এর আগে গতকাল সোমবার জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি:
আবারো দলের আমির নির্বাচত হওয়া প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, “আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার ওপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, “আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য, আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়।”
বিদেশ সফরের কথা তুলে ধরে শফিকুর রহমান বলেন, “আপনারা হয়ত জানেন গত মাসের ১৯ তারিখ আমি ওমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে ওমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে সেখানে পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখা করার সুযোগ হয়েছে।”
“সেখান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আর আমরা বলেছি, প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথমবারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে।”
ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এর বাইরে যে সব শর্ত তা যেন শিথিল করে দেয়।”
তুরস্ক সফর সফল হয়েছে জানিয়ে দলটির আমির বলেন, “তুরস্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সঙ্গে আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছে জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি।”
তিনি বলেন, “দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং ইকিউয়িটির ভিত্তিতে।”
সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ভোরে ঢাকায় ফেরেন।
এ সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দলের সিনিয়র নেতারা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।
দলের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলালসহ কেন্দ্রীয় আরো অনেক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা