আজ আপনাদের দুটি সত্য ঘটনার মুখোমুখি করতে চাই। প্রথম ঘটনাটি ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী শামীমার (ছদ্মনাম)। যে বয়সে তার পড়াশোনা করার কথা, সে সময় তার পরিবারের হাল ধরার জন্য পোশাককর্মী হিসেবে নেমে পড়তে হয় জীবনযুদ্ধে। কিন্তু বাসা থেকে গার্মেন্টসে যাওয়ার পথে একটি বখাটে যুবক দ্বারা প্রায়ই সে হয়রানির শিকার হতো। যুবকটি তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে চাইত। শামীমা প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করে যেত।

এক সন্ধ্যায় যুবকটি তার পিছু পিছু বাড়িতে গিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। প্রতিবেশীরা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। কিন্তু শাস্তি না দিয়ে ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতে শামীমাকে বাধ্য করে। শুরু হয় শামীমার দুর্বিষহ জীবন। বৈবাহিক ধর্ষণসহ তাকে সহ্য করতে হয় আরও অনেক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। তার অভিভাবককে জানানোর পর তারা কোনো প্রতিবাদ না করে সেই ধর্ষণকারী স্বামীর সঙ্গেই তাকে থাকতে বাধ্য করে। দিনের পর দিন এসব সহ্য করতে না পেরে শামীমা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরিবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তার প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। পরবর্তী সময়ে হাসপাতাল থেকে তাকে কাউন্সেলিংয়ের জন্য রেফার করা হয় মনঃস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কাউন্সেলিংয়ের পর সে ধীরে ধীরে মানসিক শক্তি ফিরে পায়।

এবার আসি দ্বিতীয় ঘটনায়। গল্পটি রহমান (ছদ্মনাম) নামের ১২ বছর বয়সী একটি ছেলের। যে তার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে বাড়ি থেকে দূরে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। প্রথম দিকে পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও ধীরে ধীরে তার আচরণে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যায়। মায়ের প্রাণবন্ত ছেলেটি যেন হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে যায়, অল্পতেই সবকিছুতে বিরক্ত হয়। যে কাজগুলো করতে সে একসময় খুব ভালোবাসত, সেগুলোর প্রতিই তার যেন আর কোনো আগ্রহ নেই। মা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। বাবাকে অনুরোধ করেন তাকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য।

বাড়ি ফিরে এসে রহমান তার মাকে জানায় সে কীভাবে তার চেয়ে বড় এক শিক্ষার্থীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, মাদ্রাসার একজন পুরুষ শিক্ষকও তাকে প্রায়ই নির্যাতন করত। বাড়ি আসার পরও এই মানসিক ক্ষতগুলো তাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়াত। সে সব সময় ভীত ও তটস্থ হয়ে থাকে। খাওয়াদাওয়ার প্রতিও কোনো আগ্রহ নেই। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মনঃস্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে তাকে ট্রমাভিত্তিক থেরাপি, আচরণগত সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় মানসিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। শুধু তাকে নয়, তার মা-বাবাকেও মনঃস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কাউন্সেলিং প্রদান করা হয় যে তার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে। নিয়মিত যত্নে রহমানের মানসিক স্বাস্থ্যের ‍উন্নতি হয়।

দুটি ঘটনা পড়েই আপনার কাছে নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, এ ঘটনাগুলো তো নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই তো পত্রিকার পাতায়, ফেসবুকের নিউজফিডে এসব ঘটনা ছাপা হচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিক তাই। বাংলাদেশের ছেলে ও মেয়েশিশুর যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার খবর নতুন কিছু নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচের মেয়েদের সঙ্গে আশঙ্কাজনক পরিমাণে যৌন সহিংসতার ঘটনার রিপোর্ট রয়েছে। বিশেষ করে, করোনার বছরগুলোতে (২০১৯-২০২১) শিশু নির্যাতন মারাত্মক আকার ধারণ করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তিন শতাধিক ধর্ষণের রিপোর্ট করা হয়েছে।

২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসেও নিয়মিত শিশু নির্যাতনের সংবাদ জানা যায়। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যেই নারী ও শিশু ধর্ষণের ৫০টি ঘটনা ঘটে। শুধু মেয়েশিশু নয়, রহমানের মতো কিশোরের নিপীড়িত হওয়ার ঘটনাও তো আমরা দেখতে পাই। পুরুষ নির্যাতন নিয়ে প্রতিবেদন খুব একটা হয় না। তবে পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিনই এই খবরগুলো চোখে পড়ে।

গত ৩০ এপ্রিল নোয়াখালীর মাদ্রাসায় শিশু মৃত্যুর ঘটনা বা ১৫ মে প্রথম আলো অনলাইনে লক্ষ্মীপুরের মাদ্রাসার শিশুশিক্ষার্থী নির্যাতনের মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন, শিশু নিপীড়ন এবং হয়রানির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমের কারণে মানুষ এসব বিষয় আগের চেয়ে বেশি জানতে পারছে। সচেতনতাও বাড়ছে। কিন্তু তথ্যগুলোর প্রচার নির্যাতিত মানুষ ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং ট্রমার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো ঘটনার সংখ্যার তুলনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অথবা আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মানসিক ও আইনগত সহায়তার পরিমাণ খুব কম।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকারের অধীনে থাকা নন-কমিউনেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি) প্রোগ্রাম বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কিছু ওয়েলবিয়িং সেন্টার বা মনঃস্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করে, যেখানে আইসিডিডিআরবি তাদের টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে থাকে। এই ওয়েলবিয়িং সেন্টারগুলোকে স্থাপনের জন্য আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে নন-কমিউনেবল ডিজিজ কন্ট্রোল এবং গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (জিএসি)।

বাংলাদেশের পাবলিক হাসপাতালগুলোর একটি কক্ষে এই ওয়েলবিয়িং সেন্টারগুলো খুব সুসজ্জিত এবং পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সেখানে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে মানসিক সেবা দেওয়া যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি এখানে প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানী এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে। এমনকি সেন্টারগুলো আইনগত বা মানবাধিকার সহায়তার প্রয়োজন পড়লে সেটিও করার চেষ্টা করে। উপজেলা স্তরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করার পর তাদেরকে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। আবার জেলা স্তরে, তাদের একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জেলা সুপারিনটেনডেন্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ওয়েলবিয়িং সেন্টারগুলো কীভাবে তাদের সাহায্য করছে? সহিংসতার শিকার একজন নারী নিকটস্থ হাসপাতালে যান, যেখানে চিকিৎসকেরা প্রাথমিক মূল্যায়ন শেষে জানান যে তাঁর বিশেষায়িত মানসিক সহায়তার প্রয়োজন আছে কি না। আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাঁকে ওয়েলবিয়িং সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রাথমিক ব্যবস্থা করা হলেও তাঁর অবস্থার উন্নয়নে আরও বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা জরুরি।

জটিলতা বিবেচনা করে মেডিকেল অফিসার তাঁকে হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) রেফার করেন। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করেন। ওসিসি টিম তাঁর সম্মতি সাপেক্ষে তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তার ব্যবস্থায় সরকারের আইন সহায়তা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আইনি রেফারেল সম্পন্ন হওয়ার পর হাসপাতালের ভূমিকা শেষ হয়, তবে তাঁর জন্য মানসিক সহায়তা চলমান থাকে। তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ফলোআপ কাউন্সেলিং সেশন পরিচালিত হয়।। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং মানসিক ও আইনি সহায়তা সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠতে এবং ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করে।

বর্তমানে দিনাজপুর, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, শেরপুর ও নোয়াখালী জেলার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে মোট সাতটি কেন্দ্র থেকে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এসব কেন্দ্র সাত হাজারের বেশি রোগীকে মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা প্রদান করেছে। এই উদ্যোগ সেবাগ্রহণকারীদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তবে আরও বৃহৎ পরিসরে বিনিয়োগ সম্ভব হলে এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেখতে পাওয়া যাবে। জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের উদ্যোগ চলাকালে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার হওয়া উচিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ, যাতে সব নাগরিকের বিশেষ করে সহিংসতা বা ট্রমার শিকার ব্যক্তিদের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা যায়।

বাংলাদেশে নির্যাতনের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে আইনি সহায়তাও যোগ করতে হবে, যাতে সহিংসতার শিকার একজন নারী বা ব্যক্তি একসঙ্গে মানসিক সহায়তা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ পান। হাসপাতালগুলোতে ক্রাইসিস সেন্টার সম্প্রসারণের মাধ্যমে গৃহে সহিংসতা, যৌন নির্যাতন এবং শিশু নির্যাতনের শিকার মানুষের জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা, ট্রমা, কাউন্সেলিং এবং আইনি রেফারেল প্রদান সম্ভব।

এ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও আইনগত সহায়তা সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে সহায়তা, একই সঙ্গে তাদের মানসিক সুস্থতাও নিশ্চিত করা যাবে। কমিউনিটিতে বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এসব সেবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক সংস্কার প্রতিরোধ এবং প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে একটি বিস্তৃত সহায়তা কাঠামো তৈরি করা যায়। এর ফলে সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাবে এবং নির্ভয়ে ন্যায়বিচার চাইতে পারবে।

মূল কথা হলো আমাদের নীরবতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। আমাদের অগ্রাধিকার হতে হবে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে নিরাময় নিশ্চিত করা যেন শামীমা ও রহমানের মতো নির্যাতনের শিকার মানুষ উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়।

আনীকা তাসনিম হোসেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট, আইসিডিডিআরবি

ইসরাত জাবীন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার, আইসিডিডিআরবি

জেসমিন মাহমুদা জুথী সাইকোলজিস্ট, ওয়েলবিয়িং সেন্টার, আইসিডিডিআরবি

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইস ড ড আরব ন শ চ ত কর স ন ট রগ ল ক উন স ল ব যবস থ দ ন কর পর য য র জন য ন র মত সহ য ত উপজ ল র ঘটন প রথম রহম ন ও আইন

এছাড়াও পড়ুন:

‘প্লাস্টিক দূষণ রোধ করার এখনই সময়’

‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’-এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বাংলাদেশ সরকারের এই স্লোগান যেন প্লাস্টিক দূষণের বাস্তবতা। প্রতিদিন হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব হয়ে পড়ছে শহর-বন্দর, নদী-নালা ও সমুদ্র উপকূল। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি বাড়ছে মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বাকি প্রায় ৫ লাখ টন বর্জ্য থেকে যাচ্ছে প্রকৃতিতে, যা শত বছরেও নষ্ট হয় না। এই দীর্ঘস্থায়ী দূষণ মাটি, পানি ও বায়ুর সঙ্গে মিশে ইকোসিস্টেম ধ্বংস করছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় অংশজুড়ে রয়েছে একবার ব্যবহারযোগ্য পানির বোতল, পলিথিন, প্রসাধনী ও ঘরোয়া সামগ্রী।এগুলো নর্দমা ও ল্যান্ডফিলে গিয়ে বর্ষার পানিতে বাধা সৃষ্টি করে শহরে জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।বর্ষা মৌসুমে ঢাকা শহরে বৃষ্টি হলেই যে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় সেটা এসব প্লাস্টিকের কারণেই হয় বলে মনে করেন অনেকে।

আরো পড়ুন:

কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে দাম দিতে হবে : উপদেষ্টা  

কিশোরগঞ্জে পানি উঠছে না নলকূপে, খাবার পানির তীব্র সংকট

দেশের প্রধান তিন নদী-পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় প্রতিদিন পড়ছে প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক ও পলিথিন। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) জানায়, দেশের নদীগুলোর পানিতে প্রতিদিন ১৫ হাজার ৩৪৫ টন প্লাস্টিক গিয়ে পড়ে, যা সরাসরি বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিকের স্তর তৈরি হচ্ছে, মারা যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণী, ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণিবৈচিত্র্য।

ঢাকায় প্লাস্টিক দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৩০ শতাংশের বেশি উৎপন্ন হয় রাজধানীতে। প্রতিদিন গড়ে ৬৮১ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৮০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য পণ্য। মাথাপিছু বছরে যেখানে গড়ে ৯ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন হয়, ঢাকায় তা দ্বিগুণ-১৮ কেজি। নগর ব্যবস্থাপনার জন্য একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক ব্যবহারকারী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশের প্লাস্টিক ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণের বেশি। ২০১৫ সালের গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের শহরগুলোতে প্রতিদিনের বর্জ্য ৫০ হাজার টনে পৌঁছাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের প্যাকেটসহ সিঙ্গেল ইউজ প্রোডাক্টের কারণে শহর ব্যবস্থাপনায় ধস নেমেছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নে কংক্রিটের নিচে মাটি হারিয়ে ফেলায় পানির প্রাকৃতিক শোষণও হচ্ছে না। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্যে আটকে থাকা ড্রেন ও খালে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দরিদ্র ও বস্তিবাসী মানুষ।

রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “পরিবেশ দূষণের জন্য প্লাস্টিক ও পলিথিন অন্যতম দায়ী।বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, প্যাকেট ও পলিথিন সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। গত তিন মাসে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১০৮ কিলোমিটর খাল পরিষ্কার করা হয়েছে যার অধিকাংশই প্লাস্টিকে ভরপুর ছিল। সোর্স থেকে প্লাস্টিক না কমালে শুধু পরিষ্কার করে কোন লাভ হচ্ছে না।”

এই বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পরিবেশ দূষণ রোধ করতে সব সরকারি অফিসে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন।কিন্তু সার্বিকভাবে প্লাস্টিক দূষণের ফলে পরিবেশকে বিপর্যয় থেকে মুক্ত করতে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি টেকসই, বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি জনসচেতনতা ও সরকারি নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

ঢাকা/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ