ঈদে বাড়তি চাপ, চাপা কান্না পাথর ভাঙা শ্রমিক পরিবারে
Published: 5th, June 2025 GMT
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত পাথর ভাঙার কাজ করতে হয় নাকুগাঁও স্থলবন্দরের শ্রমিকদের। দৈনিক মজুরি পান ৩০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালানোর পর সঞ্চয় বলতে কিছু থাকে না। তার মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে অনেকের সংসার চালাতেই হিমশিম অবস্থা। এর মধ্যে ঈদ এলেই বাড়তি চাপ বোধ করেন শ্রমিকরা। এ অবস্থায় বেতন বৃদ্ধি ও প্রতি ঈদে বোনাসের দাবি জানিয়েছেন তারা।
নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও স্থলবন্দরের পাথর ভাঙার শ্রমিক রয়েছে চার হাজারের অধিক। তাদেরই একজন মোহাম্মদ আলী। জায়গা-জমি বলতে কিছুই নেই তাঁর। বন্দরের পাশে সরকারি একটি আশ্রয়ণের ঘরে বসবাস করেন। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। ছেলে এইচএসসি পাস করে বেকার। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
ছোট মেয়ে পড়ালেখা করছে। মোহাম্মদ আলী প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মজুরি পান ৩০০ টাকা। এই সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা তাঁর। এর মধ্যে ঈদ মানেই তাঁর কাছে বাড়তি চাপ। কারণ যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালানোর পর সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না। সে ক্ষেত্রে ঈদ উৎসবে সন্তানদের পোশাক, বাজার-সদাই করাটা রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কেবল মোহাম্মদ আলী নন, একই অবস্থা অন্য শ্রমিকদেরও।
শ্রমিকরা জানান, মজুরির ৩০০ টাকা দিয়ে সংসার চালাতে তাদের হিমশিম অবস্থা। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারেন না। পরিবারের লোকজনের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। কোনো দিন কাজ বন্ধ থাকলে থাকতে হয় অনাহারে-অর্ধাহারে। সংসার চালাতে ধারদেনাও করতে হয়। পাথর ভাঙার কাজে মজুরি ছাড়া বাড়তি সুযোগ সুবিধা পান না। এ কাজে রয়েছে মৃত্যুর ঝুঁকি। শ্রমিকদের দাবি, তারা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। এ অঞ্চলে তেমন কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় শ্রমিকরা কম মজুরিতেই পাথর ভাঙার কাজ করেন।
বন্দরের পাথর ভাঙার শ্রমিক রাব্বানী, নাজমুল ও বেলায়েত হোসেনের ভাষ্য, পাথর ভাঙার কাজে মজুরি ছাড়া বাড়তি কোনো সুযোগসুবিধা পান না। আসন্ন ঈদে এখনও বোনাস পাননি। তাদের দাবি, বর্তমান দ্রব্যমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মজুরি বাড়ানো প্রয়োজন।
কথা হয় নারীশ্রমিক বণিতা নেংমিনজার সঙ্গে। তিনি জানান, পাথর ভাঙার সময় পাথরের কণা, ধুলাবালু চোখে-মুখে লাগে। সর্দি-কাশি সারাবছরই লেগে থাকে। মেশিনের শব্দে মাথা ঝিমঝিম করে। পাথর ভাঙার যন্ত্রে কাজ করলে শরীরের ক্ষতি হয় জানার পর কাজ করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বণিতা বলেন, ‘পেটের দায়ে আমরা পাথরের কাজ করি। পাথর ভাঙার কাজটা খুব কষ্টের।’
পাথর ভাঙা শ্রমিক মোহাম্মদ আলীর ভাষ্য, প্রায় ৫ বছর আগে একদিন পাথর ভাঙার সময় একটি বড় কণা তাঁর চোখে প্রবেশ করে। পরে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ কিনে ব্যথা কমিয়ে আবারও কাজে নেমে পড়েন। কয়দিন যেতে না যেতেই চোখে খুব জ্বালাপোড়া শুরু হয়। সে সময় কিছুটা চোখে ঝাপসা দেখলেও পরে চিকিৎসার অভাবে একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায়ই কাজ করতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালানোই মুশকিল। ঈদে কোরবানি দেওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।’
পাথর ভাঙার আরেক শ্রমিক আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে টাকার জন্য কাজ করি, কিন্তু ন্যায্য টাকা পাই না; যা পাই তা দিয়ে কোনো রকমে জীবন চালাই। ঈদ এলেই বাড়তি চাপ তৈরি হয়।’ তাঁর ভাষ্য, সচ্ছল পরিবারগুলোতে যখন ঈদের আনন্দ লেগে থাকে, তখন তাদের মতো পাথর ভাঙা শ্রমিকদের পরিবারে থাকে চাপা কান্না। কোরবানির ঈদে তাকিয়ে থাকতে হয় অন্যের মুখের দিকে।
বন্দরের লোড-আনলোড শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ এনায়েত হোসেন বলেন, ঈদুল ফিতরে বন্দরের কার্ডধারী শ্রমিকদের ঈদ বোনাস হিসেবে নগদ অর্থ, শাড়ি, লুঙ্গি ও সেমাই-চিনি দেওয়া হয়। আর দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের শুধু সেমাই-চিনি দেওয়া হয়। ঈদুল আজহার সময় শ্রমিকদের কোনো বোনাস দেওয়া হয় না। তাদের দুই ঈদেই সমানভাবে বোনাস দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বন্দরের শ্রমিকনেতা সুজন মিয়া জানান, পাথর ভাঙা মেশিনের উচ্চ শব্দ আর ধুলাবালুর মধ্যে কাজ করতে হয় তাদের। রাতে মাথাব্যথা ও নিদ্রাহীনতায় ভোগেন অধিকাংশ শ্রমিক। অর্থের অভাবে অনেকে চিকিৎসাও করাতে চান না। বর্তমান বাজারে সামান্য মজুরিতে ঠিকমতো সংসার চলছে না শ্রমিকদের। এ কারণে ঈদ উৎসবে আনন্দের বদলে অনেক পরিবারে চাপা কান্না বিরাজ করে।
বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুলের ভাষ্য, কোনো শ্রমিক কাজ করার সময় দুর্ঘটনার শিকার বা অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তাদের বেতন-বোনাসের বিষয়টিও বিবেচনা করা হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ক জ কর পর ব র অবস থ র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
এই অদম্য মেয়েদের আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না
অবহেলিত মেয়েরা কঠিন একটি কাজ সম্পন্ন করেছেন। অনেকের কাছে এখনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অসাধ্য এক অর্জনকে বাস্তবের জমিনে নামিয়ে এনেছেন আমাদের বাঘিনীরা। সাফ পর্যায় জয় করে নারীদের ফুটবলকে এশীয় পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বিশ্বকাপও খেলে ফিরতে পারেন এই অদম্য বাঘিনীরা।
এখন বলাই যায়, নারী ফুটবলের বিশ্ব পর্যায়ে কড়া নাড়ছেন আমাদের মেয়েরা। ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাঁরা। শুধু ফুটবলই নয়, আমাদের নারী জাগরণের নতুন দিশা হতে পারে মেয়েদের এই সাফল্য। এই মেয়েরা সারা দেশের মেয়েদের জন্য উদাহরণ। নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের নতুন দিনের আলোকবর্তিকা আমাদের নারী ফুটবল দল।
ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। সফলতা খুব সহজে আসেনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে কঠিন এক সংগ্রামের ফসল মেয়েদের আজকের এই অর্জন। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত পল্লি থেকে কোহাটি কিষ্ক, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সানজিদা আক্তার বা রাঙামাটির দুর্গম গ্রাম মগছড়ি থেকে ঋতুপর্ণা চাকমাদের আজকের এই পর্যায়ে আসার ইতিহাসটা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
এই পথচলায় সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। ছিল আর্থিক টানাপোড়েন, অনিশ্চয়তা। জীবনের এমন কোনো সংকট নেই, যা তাঁদের সামনে আসেনি। কিন্তু হিমালয়সম সেই বাধাকে সাহসিকতার সঙ্গে পেছনে ঠেলে আজকে তাঁরা এশীয় পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করেছেন।
তাঁদের অর্জনের তুলনায় রাষ্ট্র দিতে পেরেছে খুবই কম। বলতে গেলে, তাঁরা পেটেভাতে দেশের জন্য খেলে দিচ্ছেন। যেন খেলার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চলছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আদলে। যৎসামান্য যে বেতন দেওয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। যেকোনো সাফল্যের পর যখন মেয়েদের কাছে শুনতে চাওয়া হয়, ‘আপনারা কী চান?’ উত্তরে মেয়েরা জানান, ‘নিয়মিত বেতনটা চাই। আর বেতনটা বাড়ালে আরও ভালো হয়।’ ২০২৫ সালে এসে এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দেশে মেয়েদের নিয়মিত লিগ হয় না। অন্য কোনো টুর্নামেন্টও হয় না নিয়মিত। নিয়মিত খেলার জন্য আমাদের মেয়েদের ভুটান লিগে খেলতে যেতে হয়। কেবল আবাসিক ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলেই মেয়েদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নামতে হয়। সেই সব খেলায় তাঁরা নিয়মিত লিগ খেলা দলগুলোকে বলে-কয়ে হারাচ্ছে।
আমাদের খেলাধুলাকে রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। শুধু নারী ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে তৃণমূল থেকে। তবেই নতুন নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। ঢাকাকেন্দ্রিক খেলার কুফল কী হতে পারে, তার বড় উদাহরণ আমাদের ছেলেদের ফুটবল। সারা দেশে নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক লিগ না হওয়ার কারণে নতুন নতুন ফুটবলার বেরিয়ে আসছেন না।কী পরিমাণ প্রতিভার অধিকারী হলে ন্যূনতম সুবিধা না পেয়েও এ পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। ভারত ও নেপালে নিয়মিত মেয়েদের খেলা হয়, লিগ হয়। আর আমরা তাদের এখন নিয়মিতই হারাই। এখন সাফের বাইরের দলগুলোকেও আমরা হারাতে শুরু করেছি।
এই মেয়েদের প্রচেষ্টা ও সাহস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড রকম ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে তাঁরা খেলতে নামেন। ভয়হীন ফুটবল খেলেন। সব থেকে বড় কথা, খেলার যেকোনো ধরনের ট্যাকটিকসের সঙ্গেই তাঁরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন। আগে আমাদের মেয়েরা কিছুটা রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতেন। রক্ষণ সামলে প্রতি-আক্রমণে যেতেন। এবার এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে মেয়েরা পুরো খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন।
আমাদের মেয়েরা এবার হাই প্রেসিং ফুটবল খেলেছেন। এই দল আগের থেকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ফুটবল খেলে। বল পায়ে রাখতে পারে। তাদের বল ডিস্ট্রিবিউশন আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। পাসিংও ভালো। পজিশন সেন্স চমৎকার। বিশেষ করে বল হারালে দ্রুত নিজেরা অবস্থান নিতে পারে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে হাই লাইন ডিফেন্স করে গেছে দুর্দান্তভাবে। আর বাহরাইনের সঙ্গে শামসুন্নাহার জুনিয়র যেভাবে গতি সঞ্চার করে ডিফেন্স থেকে বেরিয়ে ওয়ান টু ওয়ানে গোলরক্ষককে পরাজিত করলেন ঠান্ডা মাথায়, তা আমাদের পুরুষ দলের স্ট্রাইকার বা উইঙ্গাররাও করতে পারেন না। নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকা একটি দলের কাছে এর বেশি আশা করা উচিত নয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের সেই আশাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি বুঝে মাঠে খেলাটা তৈরি করতে পারেন।
মেয়েদের এই লড়াইকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সিরাত জাহান স্বপ্না বা আঁখি খাতুনের মতো খেলোয়াড়দের আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক লিগ নিয়মিত আয়োজন করতে হবে। এর পাশাপাশি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে লিগের আয়োজন করতে হবে।
‘সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এই মেয়েরা আমাদের ফুটবল নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।’