কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিশেষত ছোট ব্যবসায়ীদের দুর্গতি আর গেল না। এবারও চামড়া ব্যবসায় লাভবান হলেন ট্যানারি মালিক ও আড়তদাররা। সংবাদমাধ্যমের খবর, লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গতবারের চেয়ে এবার ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার, ঢাকার বাইরের জন্য যা নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা। সেই হিসাবে ঢাকায় কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারিত হয় ১ হাজার ৩৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৫০ টাকা। তবে সমকালের খবর, শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লবণ ছাড়া বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তুলনামূলক ছোট ও মান কিছুটা খারাপ এমন চামড়া ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর, গত বছর গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে প্রায় একই দরে।
আর খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ছাগলের চামড়া কেনায় ব্যবসায়ীদের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। অনেক স্থানে ব্যবসায়ীরা বিনা মূল্যেই ছাগলের চামড়া পেয়েছেন।
ঢাকার বাইরে গরুর চামড়ার দাম ছিল আরও কম। ‘আড়তদাররা প্রতিটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কিনতে চেয়েছে।’ বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো.
কোরবানির চামড়া প্রথমত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করেন। তারা তা বিক্রি করেন আড়তদারের কাছে। আড়তদার চামড়াটি বিক্রি করেন ট্যানারি মালিকের কাছে।
পুঁজিস্বল্পতার পাশাপাশি সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীকে দিনের মধ্যেই চামড়াটি বিক্রি করতে হয়। তুলনামূলক বড় পুঁজি এবং আয়োজন থাকার কারণে আড়তদার চামড়াটি সংরক্ষণ করে ট্যানারি মালিকের সঙ্গে দরাদরিও করতে পারেন। ফলে এ ব্যবসায় লাভের গুড় সাধারণত শেষ দুই পক্ষেরই ভাগে যায়।
এমন কথা বলার কারণ হলো, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যখন ধার-কর্জ করে সংগৃহীত পুঁজি ধরে রাখতে হিমিশিম খাচ্ছেন, তখন কিন্তু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিতে বেশ ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ১০৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। অন্তত এ পরিসংখ্যান বলছে, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসানের দায় রপ্তানির ওপর দেওয়া হলেও বাস্তবতা তা নয়।
নিঃসন্দেহে কাঁচা চামড়ার রপ্তানি বাজারে এক যুগ আগের রমরমা ভাব এখন নেই। বিশেষত বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে। সে সমস্যা কাটাতেই রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পকে সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়া হয়। কিন্তু ২১ বছরেও এই চামড়া শিল্পনগরকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। ফলে বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে চীন। কম দামে বাংলাদেশি চামড়া তারা কিনে নেয়।
এ অবস্থা জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। এটি বড় ব্যবসায়ীদের ছোট চামড়া ব্যবসায়ীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে সাহায্য করছে– সেটি স্পষ্ট। না হলে হেমায়েতপুরের এ অচলাবস্থা প্রায় দুই যুগ ধরে চলত না।
এখানেই সরকারের ভূমিকা নিয়ামক হয়ে আসে। তাদের বোঝা উচিত, গতানুগতিক পন্থায় চামড়ার একটি দর নির্ধারণ করে বসে থাকলেই চলে না। তা বাস্তবায়ন ও তদারক করতে হয়। আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, হেমায়েতপুরে যে বর্জ্য শোধনাগার-সংক্রান্ত জটিলতা, সেখানকার কারখানাগুলো পরিবেশ সার্টিফিকেট পাচ্ছে না। সে সমস্যার সমাধান দ্রুতই হওয়া উচিত।
মনে রাখতে হবে, কোরবানিই হলো সারাবছরের চামড়া সংগ্রহের প্রধান উৎস। তদুপরি এ চামড়ার প্রধান হকদার গরিব মানুষ। ফলে বছরের পর বছর চামড়া নিয়ে তেলেসমাতির অর্থ শুধু জাতীয় লোকসানই নয়, গরিব মানুষের হক নষ্ট করাও বটে।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস য় দ র আড়তদ র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
বিদেশ থেকে অলংকার আনায় কড়াকড়ি, দেশের বাজারে সোনার দামে আরও অস্থিরতার শঙ্কা
বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দিন দিন সোনা আরও দামি হচ্ছে। সোনার আকাশছোঁয়া দামের জন্য বিয়েশাদির মতো পারিবারিক অনুষ্ঠানে অলংকার কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত ক্রেতারা। জুয়েলারি ব্যবসা আরও সংকটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। অথচ মুক্তবাণিজ্যের এই যুগে বিশ্ববাজারের চেয়ে অনেকটা বেশি দামে সোনার অলংকার কিনতে হয় বাংলাদেশের ভোক্তাদের।
দেশের বাজারে এখন ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৬ টাকা। ২০২৪ সালের শেষের দিকেও দাম ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৬ টাকা। এর মানে, ছয় মাসের ব্যবধানে সোনার দামের ভরি বেড়েছে ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা।
আসুন দেখা যাক, দুবাই ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের সোনার দাম কত বেশি? দুবাই জুয়েলারি গ্রুপ নামে জুয়েলার্স সমিতির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গতকাল সোমবার ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি ছিল ৪ হাজার ৩১৮ দিরহাম, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৭৭ টাকা। ভারতের বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া দর বলছে, দেশটিতে গতকাল সোনার গয়নার দোকানে প্রতি ভরির দর ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৬৫ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩২ টাকা। এর মানে, ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনা বাংলাদেশের চেয়ে দুবাইয়ে ২৮ হাজার ৬৫৯ টাকা এবং ভারতে ১৬ হাজার ৯০৪ টাকা কমে কেনা যায়।
বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে সোনার দামের এত ব্যবধানের বিষয়ে জুয়েলার্স সমিতির নেতারা ঘুরিয়েফিরিয়ে কয়েকটি কথাই বলেন, সোনা বেচাকেনায় অন্য দেশে ‘কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ থাকলেও বাংলাদেশে নেই। আবার বাণিজ্যিকভাবেও সোনা আমদানি হয় না। ব্যাগেজ বিধিমালায় শুল্ক দিয়ে বিদেশ থেকে আসা সোনা দেশের চাহিদার বড় অংশ মেটায়। তার বাইরে পুরোনো অলংকার দিয়েও কিছুটা চাহিদা মেটানো হয়। অবশ্য অবৈধ পথেও অনেক সোনা আসে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশে সোনার ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পরের বছর বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয়। পরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। শুরুতে একাধিক প্রতিষ্ঠান কয়েকটি চালানে সোনা আমদানি করেছিল। তবে ধীরে ধীরে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। মূলত ডলার–সংকট, অনুমতি পেতে সময়ক্ষেপণ ও ভ্যাটের কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারান ব্যবসায়ীরা।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যাগেজ বিধিমালার আওতায় সোনা আনার সুযোগ কমিয়ে অর্ধেক করা হয় (২৩৪ গ্রাম থেকে কমিয়ে ১১৭ গ্রাম)। পাশাপাশি ভরিপ্রতি শুল্ক দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়।
সেই ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ বিধিমালায় সোনা আনার ওপর আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এত দিন বিদেশ থেকে ফেরার সময় আগে প্রতিবার সর্বোচ্চ ১১৭ গ্রাম ওজনের একটি করে সোনার বার আনা যেত। এবার সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এখন কোনো যাত্রী বছরে একবারই শুল্ক দিয়ে একটি সোনার বার আনতে পারবেন। এ ছাড়া সোনার বার আনার ক্ষেত্রে প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) শুল্ক ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে একটি সোনার বার আনার জন্য ৫০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে।
শুধু সোনার বার নয়, কড়াকড়ি করা হয়েছে সোনার গয়না আনার ক্ষেত্রেও। আগে একজন যাত্রী বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময় যতবার খুশি ততবার ১০০ গ্রাম ওজনের সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারতেন। এবার সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে একজন যাত্রী বছরে মোট ১০০ গ্রাম ওজনের সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। ইতিমধ্যে বিধানটি কার্যকর হয়েছে।
জুয়েলার্স সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেহেতু বৈধ পথে সোনা আমদানি হয় না, দেশে সোনা পরিশোধনের কোনো কারখানাও নেই, সেহেতু ব্যাগেজ বিধিমালায় অলংকার আনায় কড়াকড়ি আরোপটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়নি। এতে অবৈধ পথে সোনা আসা বাড়বে। তখন দাম নিয়ে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
জানা যায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সোনা ও রুপার অলংকারের বিক্রিতে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ, ডিলারদের কাছে ব্যবসায়ী পর্যায়ে সোনা কেনায় ভ্যাট অব্যাহতি, সোনা আমদানিতে বিমানবন্দরে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু, সোনা পরিশোধন কারখানার জন্য ১০ বছরের কর অব্যাহতিসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়েছিল জুয়েলার্স সমিতি। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক্-বাজেট আলোচনায় সোনার আমদানি সহজ করে ব্যাগেজ বিধিমালায় সোনার বার ও অলংকার আনায় কড়াকড়ি করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব দেন সমিতির নেতারা। শেষ পর্যন্ত এনবিআর শুধু এ প্রস্তাবটি আমলে নেয়।
জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে জুয়েলার্স সমিতির নির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সোনা আমদানি সহজ না করে শুধু ব্যাগেজ বিধিমালায় সোনার বার ও অলংকার আনায় কড়াকড়ি আরোপ করায় সংকট বাড়বে। সোনার সরবরাহ কোথা থেকে আসবে। আমদানি হচ্ছে না। পরিশোধনের কারখানাও নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, অবৈধ পথে সোনা আসা অর্থাৎ চোরাচালান বাড়বে।