মহাকাশে শক্তিশালী বিস্ফোরণের খোঁজ
Published: 11th, June 2025 GMT
বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে মহাকাশে এখন পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের দাবি, মহাকাশে চরম মাত্রার পারমাণবিক ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত (ইএনটি) আবিষ্কার করা হয়েছে। এই মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে ১০০টি সূর্যের সমতুল্য শক্তি নির্গত হতে পারে। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে এই বিস্ফোরণের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক বিস্ফোরণের এই নতুন শ্রেণি চিহ্নিত করেছেন। একে চরম মাত্রার পারমাণবিক ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত বলা হচ্ছে। বিগ ব্যাংয়ের পর থেকে দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী ঘটনা হচ্ছে এই বিস্ফোরণ। এসব ঘটনা ঘটে যখন বিশাল নক্ষত্র দূরবর্তী ছায়াপথের কেন্দ্রে সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণগহ্বরের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এসব নক্ষত্র আমাদের সূর্যের ভরের কমপক্ষে তিন গুণ বেশি থাকে।
এসব বিস্ফোরণ থেকে ১০০টি সূর্য তাদের সমগ্র জীবদ্দশায় যত শক্তি নির্গত করে, তার সমতুল্য শক্তি নির্গত হয়। বিশাল মহাজাগতিক দূরত্ব ধরে এই বিস্ফোরণের প্রমাণ দৃশ্যমান হয়। নতুন এই আবিষ্কার মহাবিশ্বে নক্ষত্র ও কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে গতিশীল মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করবে।
বিজ্ঞানী হিংকল ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে নির্গত দীর্ঘস্থায়ী অগ্নিতরঙ্গ নিয়ে কাজের সময় ইএনটির প্রথম খোঁজ পান। এ বিষয়ে হিংকল বলেন, ‘আমরা এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন নক্ষত্রকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছি। অন্যদিকে ইএনটি বেশ ভিন্ন। এসব বিস্ফোরণ আমরা সাধারণত যা দেখি, তার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি উজ্জ্বলতায় ঘটে। বছরের পর বছর ধরে এসব বিস্ফোরণের আলোকিত প্রমাণ থাকে। সবচেয়ে উজ্জ্বল পরিচিত সুপারনোভা বিস্ফোরণের চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদন করে।
গাইয়া১৮সিডিজে নামের ইএনটির তথ্য বিশ্লেষণের পর এসব তথ্য জানা গেছে। এটি পরিচিত সবচেয়ে বড় সুপারনোভার চেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে ২৫ গুণ বেশি শক্তি নির্গমণ করেছে। সাধারণত বিভিন্ন সুপারনোভা মাত্র এক বছরে সূর্যের ১০ বিলিয়ন বছরের সমান শক্তি নির্গমণ করে। অন্যদিকে ইএনটি ১ বছরে ১০০টি সূর্যের সমান শক্তি বিকিরণ করে।
সূত্র: এনডিটিভি
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের কোন পদ্ধতি বেশি কার্যকর
নারীরা বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী, তাই জাতীয় সংসদে অর্ধেক প্রতিনিধিত্ব থাকা তাঁদের ন্যায্য অধিকার। নারীরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হলে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারলে, তাঁদের অধিকার সুনিশ্চিত ও সর্বক্ষেত্রে তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। তাঁদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান এবং তাঁদের মেধা, সৃজনশীলতা ও কর্মক্ষমতা কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়, যার মাধ্যমে দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। বাংলাদেশের নারীদের পশ্চাৎপদ অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা’র অঙ্গীকার করা হয়েছে।
২.বর্তমানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে, যা মোট আসনের মাত্র ১৪ শতাংশ। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রসারিত করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে আসনসংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়। কমিশন প্রতি তিনটি সংসদীয় আসন নিয়ে নারীদের জন্য একটি আসন সৃষ্টি এবং সেসব আসন থেকে নারীদের সরাসরিভাবে নির্বাচিত হওয়ার প্রস্তাব করে। এই পদ্ধতি বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে বিদ্যমান। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারীদের আসনের আয়তন হবে সাধারণ আসনের তিন গুণ। তবে এ পদ্ধতিতে নারীদের আসন নির্ধারিত থাকবে এবং প্রতিবার নারীরা একই আসন থেকে অন্য নারীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
অন্যদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সংসদের আসনসংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০-তে উন্নীত করে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে ১০০টি আসনে নারীদের সরাসরিভাবে নির্বাচিত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে প্রথম মেয়াদে ৪০০টি সংসদীয় আসনের ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং এসব আসন থেকে শুধু নারীরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরাসরিভাবে নির্বাচিত হবেন। অন্য ৩০০ আসন থাকবে উন্মুক্ত, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।
দ্বিতীয় মেয়াদে অন্য ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে এবং আগের সংরক্ষিত ১০০টি আসন উন্মুক্ত আসনে পরিণত হবে। তৃতীয় মেয়াদে অপর ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে এবং আগের সংরক্ষিত ১০০টি আসন উন্মুক্ত হয়ে যাবে। চতুর্থ মেয়াদে বাকি ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে এবং আগের সংরক্ষিত ১০০টি আসন যথারীতি উন্মুক্ত আসনে পরিণত হবে। এভাবে চারটি মেয়াদে বা ২০ বছর মেয়াদে সম-আয়তনের প্রতিটি নির্বাচনী আসন থেকে একজন নারী সরাসরিভাবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। এ ধরনের পদ্ধতি ভারতের পঞ্চায়েতে (স্থানীয় সরকারে) বিরাজমান।
ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে প্রতি মেয়াদে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষিত হতে পারে লটারির মাধ্যমে, যার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পরবর্তী চার মেয়াদের জন্য কোন কোন আসন নারীদের জন্য নির্ধারিত থাকবে, তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করবে। আরেকটি বিকল্প হতে পারে আসনের ক্রমানুসারে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম মেয়াদে আসন নম্বর ১, আসন নম্বর ৫, আসন নম্বর ৯ এবং এভাবে আসন নম্বর ৩৯৭ পর্যন্ত গিয়ে মোট ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে।
দ্বিতীয় মেয়াদে আসন নম্বর ২, আসন নম্বর ৬, আসন নম্বর ১০ থেকে শুরু করে আসন নম্বর ৩৯৮ পর্যন্ত গিয়ে আবারও মোট ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তৃতীয় মেয়াদে আসন নম্বর ৩, আসন নম্বর ৭, আসন নম্বর ১১ থেকে শুরু করে আসন নম্বর ৩৯৯ পর্যন্ত মোট ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। চতুর্থ মেয়াদে অবশিষ্ট ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংলাপের সময়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দল নীতিগতভাবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ১০০টি করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। তবে বড় কয়েকটি দলের এ সম্মতি ছিল শর্তসাপেক্ষ। কয়েকটি দল নারীদের জন্য ১০০টি সংরক্ষিত আসনের ব্যাপারে সম্মত যদি এ আসনগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পাওয়া ভোটের হারের অনুপাতে অর্থাৎ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে বিতরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি দল যদি সংসদ নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে সেই দল ১০০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ২০টি পাবে।
অন্য একটি পক্ষ ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার ব্যাপারে সম্মত, যদি এসব আসন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পাওয়া আসনসংখ্যার ভিত্তিতে বিতরণ করা হয়। এ ব্যবস্থায় একটি দল যদি সংসদ নির্বাচনে ১৫০টি আসন পায়, তাহলে সেই দল ১০০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ৫০টি পাবে। প্রসঙ্গত, এটিই আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থা, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
লক্ষণীয়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সাম্প্রতিক সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১০০টি আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে মোট চারটি প্রস্তাব টেবিলে হাজির হয়েছে। প্রস্তাবগুলো হলো: ১. বিদ্যমান ৩০০ আসনের প্রতি তিনটি আসন একত্র করে ১০০টি নতুন আসন সৃষ্টি এবং সেগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা; ২. সংসদের আসনসংখ্যা ৪০০ করে সেগুলো থেকে ১০০টি আসনে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে নারীদের নির্বাচিত করা; ৩. সংসদের আসনসংখ্যা ৪০০ করে তা থেকে ১০০টি আসন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলগুলোর মধ্যে বিতরণ করা এবং ৪. সংসদের আসনসংখ্যা ৪০০ করে তা থেকে ১০০টি আসন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের হারের ভিত্তিতে অর্থাৎ বিদ্যমান পদ্ধতিতে দলগুলোর মধ্যে বিতরণ করা।
৩.এ চার বিকল্প প্রস্তাবের মধ্যে কোনটি সত্যিকার অর্থে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে, তা নির্ভর করবে কয়েকটি শর্ত পূরণের ওপর। প্রথমত, সুনির্দিষ্ট সংরক্ষিত আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে এগুলো যেন নিতান্তই আলংকারিক পদে পরিণত না হয়।
দ্বিতীয়ত, সংরক্ষণ পদ্ধতিটি যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, যার ফলে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারীরা সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত পুরুষ প্রতিনিধিদের মতো একই ক্ষমতা প্রয়োগ, একই দায়দায়িত্ব পালন এবং একই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
তৃতীয়ত, সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তি যেন যোগ্যতা হয়, যাতে যোগ্য নারীরা পরে সাধারণ আসনে থেকে পুরুষদের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে পারবেন, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যাবে।
চতুর্থত, সংরক্ষণ পদ্ধতি যেন ‘ব্রডবেজড’ বা ব্যাপকভিত্তিক হয়, যা বিরাটসংখ্যক নারী নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
পঞ্চমত, সংরক্ষিত আসন যেন ফায়দা বা অনুগ্রহ প্রদানের হাতিয়ারে পরিণত হয় এবং এসব আসনের প্রতিনিধিদের দলীয় প্রধানদের পরিবর্তে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ষষ্ঠত, সংরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে যেন দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি না হয়। প্রসঙ্গত, বর্তমানে সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের জন্য পৃথক কোনো আসন না থাকায় সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ আসনের নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে তাদের দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের সমস্যায় পড়তে হয় এবং সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে অসহযোগিতা ও বাধার সম্মুখীন হন। সপ্তমত, সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের লেনদেন বা মনোনয়ন-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি না হয়।
প্রসঙ্গত, নারীসমাজ ও সচেতন নাগরিকেরা বহুদিন থেকেই নারীদের জন্য নির্দিষ্ট আসন থেকে সরাসরি নির্বাচনের দাবি করে আসছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোও এই দাবির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করে: ‘সংসদে নারীদের আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন ও ক্ষমতায়নের জন্য তাদের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে এবং মহিলা আসনে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ একইভাবে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে বিএনপি জাতীয় সংসদে নারীরা যাতে অধিক হারে ‘নির্বাচিত’ হতে পারেন, তার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে।
ওপরের আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত ঘূর্ণমান পদ্ধতিই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সর্বাধিক কার্যকর ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব থাকে না, এতে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নারীদের জন্য সম-আয়তনের নিজস্ব আসন থাকে। তাঁরা সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিতদের মতো সমসুযোগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা উপভোগ করেন এবং দলীয় প্রধানদের পরিবর্তে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হন।
এতে যোগ্য নারীরা, পাঁচ বছরের মেয়াদকালে নিজ যোগ্যতায় ‘কন্সটিটিউয়েন্সি’ গড়ে তোলে, পরবর্তী সময়ে সাধারণ আসন থেকে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে পারেন, ফলে ২০ বছরের নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যাবে। এতে ব্যাপক পরিসরে নারী নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং সংরক্ষিত আসন আর ফায়দা প্রদানের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে না। তাই ঘূর্ণমান পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে সারা দেশে একঝাঁক নারী নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
সংবিধান সংশোধন কমিশন প্রস্তাবিত সংরক্ষণ পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে তিনটি সাধারণ আসনকে একত্র করে একটি সংরক্ষিত আসন সৃষ্টি করা হবে, তাই এটি হবে নারীদের জন্য বৈষম্যমূলক। তাই এ পদ্ধতি আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্যভাবে নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি।
এ ধরনের সংরক্ষণ ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদে প্রচলনের পর বহু নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এগিয়ে আসে, পরে যে উৎসাহে ব্যাপকভাবে ভাটা পড়ে এবং প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। পক্ষান্তরে, ঘূর্ণমান পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে ভারতের পঞ্চায়েতে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। যেমন ভারতীয় পঞ্চায়েতের তিন স্তরে গ্রাম, মধ্য (পঞ্চায়েত সমিতি) এবং জেলায় মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ২০০২ সালে প্রায় ৫ লাখ ৮৬ হাজার থেকে ২০০৮ সালে প্রায় ১০ লাখ ৪০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়েছে ১৩ হাজার ৩০০ থেকে ২১ হাজার ৩৫১ জনে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সংরক্ষিত ১০০টি নারী আসন রাজনৈতিক দলকে বিতরণ করা হলে এটি হবে আরও কম কার্যকর। কারণ, এর ফলে নারীদের জন্য নির্ধারিত আসন থেকে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ থাকবে না। এর মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক নারী নেতৃত্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকবে না। এ ক্ষেত্রে নারী সংসদ সদস্যদের ওপর দলের আধিপত্য আরও নিরঙ্কুশ হবে এবং মনোনয়ন-বাণিজ্যের আশঙ্কাও থেকে যাবে।
উল্লিখিত এবং বর্তমানে ব্যাপকভাবে আলোচিত চারটি বিকল্প প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে কম কার্যকর হলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর আসনসংখ্যার হারে বিতরণ করা, যা বর্তমানে বিদ্যমান। এই পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনগুলো হবে সম্পূর্ণরূপে আলংকারিক এবং এসব পদে আসীন ব্যক্তিদের যোগ্যতার প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক। বস্তুত এতে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ থাকে না, ফলে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দলের নেতাদের অনুগ্রহ বা ফায়দা হিসেবেই দেওয়া হয়, যা একটি অমর্যাদাকর ব্যবস্থা। তাই এ পদ্ধতি নারী নেতৃত্ব বিকাশে অতীতে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই রাখতে পারেনি। এ ছাড়া এই পদ্ধতিতে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আরও নিরঙ্কুশ হয়। সর্বোপরি এতে মনোনয়ন-বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আরেকটি সংরক্ষণ পদ্ধতিও অনেক দিন ধরেই আলোচনায় রয়েছে, যা হলো রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক আসনে যেমন এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা। এ পদ্ধতিতে নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন, কিন্তু এর একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো যে দলগুলো এমন সব আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে, যেখানে তাঁদের জেতার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া বড় দলের পক্ষে, যাদের প্রতি নির্বাচনী এলাকায় অনেক প্রার্থী রয়েছে, উল্লেখসংখ্যক আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে সম্মত হওয়া সহজ হবে না।
৪.উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে ঘূর্ণমান পদ্ধতিই সারা দেশব্যাপী বিরাটসংখ্যক নারীর নেতৃত্ব বিকাশের উৎকৃষ্টতম উপায়। এর মাধ্যমে নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে এবং ভবিষ্যতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যাবে। তবে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সংরক্ষণের কারণে পুরুষদের ‘আসন’ হারানোর শঙ্কা। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট আসন কোনো ব্যক্তির জন্মগত অধিকার নয়। এ ছাড়া আমাদের বর্তমান সংবিধানেই জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের সমসুযোগ ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। তাই রাজনীতিতে নারীদের বর্তমান পশ্চাৎপদতা দূরীকরণের লক্ষ্যে তাদের অগ্রাধিকার প্রদান আমাদের সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার যথাযথ প্রতিফলন ঘটবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
*মতামত লেখকের নিজস্ব