২৮ মে তারিখ সমকালে একটা চেক লিস্ট দিয়েছে-রাজনৈতিক দলেরা সংস্কার প্রস্তাবে কী কী অভিমত দিয়েছে। মূলত বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াতের প্রস্তাবনাগুলা এসেছে। এই মতামতগুলো মূলত নাগরিক কোয়ালিশনের গত মে ১১ তারিখের সংবিধান সংস্কার নিয়ে আয়োজিত সেমিনারের আগের।

ওই সেমিনারে সব রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। তাদের প্রস্তাবিত ৭ প্রস্তাবের অন্যতম মূল প্রস্তাব সংসদে একটি আনুপাতিক আসনবিন্যাস (প্রপোর্শনাল রেপরেসেনটেশন, বা পিআর) ভিত্তিক উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব যা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবিধানিক সংস্কার হিসেবে সবাই মনে করছি। পিআর নিয়ে আমাদের অনেক ধোঁয়াশা আছে, সেগুলা কাটানো জন্যই এই লেখা।

উচ্চকক্ষ কেন দরকার?

১৯৯১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী হতে ১৫১ জন এমপি দরকার হয়। আর সাংবিধানিক কারণেই-সব ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যত বাংলাদেশের রাজা বা রানি। সংসদে তেমন কার্যক্রম না থাকায় এমপিরা পুরোপুরি এলাকাভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে যায় এবং সরকারি দলের এমপিরা হয়ে উঠে লোকাল নবাব, আর বিরোধীরা করে বিক্ষোভ আর ক্ষোভের রাজনীতি। এমপিদের নির্বাচিত হওয়ার মানদণ্ড এলাকাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড, সংসদে আইন প্রণয়ন একেবারেই নয়।

ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় যারা ভোটে জিতে আসেন তারা যে ভালো সংসদ সদস্য হবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা সংবিধান পরিবর্তন করার আগেই এ চিত্র স্পষ্ট ছিল। ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি, যখন হাসিনার কর্তৃত্ব চরমে, তখন বিএনপি সংসদে যোগ্য মানুষদের নিয়ে আসার জন্য একটি উচ্চকক্ষের প্রস্তাব তোলে-যারা এক্সিকিউটিভকে জবাবদিহির মধ্যে আনবে, আইন বিশ্লেষণ করবে ইত্যাদি।

আরও পড়ুনআনুপাতিক পদ্ধতির ভোট: নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা কী বলছে১৭ অক্টোবর ২০২৪বিএনপি কি বিশদ প্রস্তাব দিয়েছিল?

না, দেয়নি। এটা মনে রাখা দরকার-সে সময় বিএনপির সঙ্গে যুক্ত থাকলেই আটক করা হতো, নির্যাতন বা গুম হওয়ার ঝুঁকি ছিল। ফলে উচ্চকক্ষের ধারণাটি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সদস্যরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তাদের ক্ষমতা কী হবে-এসব পরে নির্ধারণ করার কথা ছিল। তখনকার মিডিয়া ও এই প্রস্তাবের মূল্য বুঝতে পারে নাই, ফলে তখন এই নিয়ে আলোচনাও হয় নাই। তাদের ৩১ দফা প্রস্তাবে ও একটি সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল, যেটা এগুলো নির্ধারণ করবে। জাতীয় পার্টির ও একটা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব ছিল-কিন্তু তা মূলত ফেডারেশনভিত্তিক সরকারের মতো।

পিআর-ভিত্তিক উচ্চকক্ষ কী?

বাংলাদেশের নির্বাচনী বাস্তবতায় দলীয় প্রতীকই ভোটারদের প্রধান বিবেচ্য। পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষের উদ্দেশ্য হচ্ছে-এটা নিশ্চিত করা যে সাধারণ নির্বাচনে (অর্থাৎ নিম্নকক্ষের ৩০০ আসনে) যেসব দল যত ভোট পেয়েছে, উচ্চকক্ষে সে অনুযায়ী তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

একটা উদাহরণ দিই ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩১% ভোট আর আওয়ামী লীগ ৩০% ভোট পেয়েছিল। তাহলে যদি ১০০ সদস্যবিশিষ্ট পিআর উচ্চকক্ষ থাকত, তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পেত ৩১ ও ৩০টি আসন (কিছুটা জটিলতা থাকলেও ধারণাটা এমনই)। ২০০১ সালে বিএনপির ভোট ৪১% এবং আওয়ামী লীগের ৪০ %, তাই একই অনুপাতে আসন হতো।

বিকল্প কী?

বেশ কয়েকটি বিকল্প আছে।

১.

সরাসরি উচ্চকক্ষ সদস্য নির্বাচন। এখানে প্রশ্ন-৩০০ এমপির পাশাপাশি ১০০ উচ্চকক্ষ সদস্য কেন? একই ধরনের তাগিদ ও সীমাবদ্ধতা থাকলে, এই বিকল্প গ্রহণ করলে দেখা যাবে তারাও এলাকাভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সেখানেও স্থানীয় সংঘাতই দেখা যাবে, ভালো আইনপ্রণয়ন নয়।

২. ফেডারেশন ভিত্তিক পদ্ধতিতে, উচ্চকক্ষের সদস্যরা অঞ্চল বা বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু বাংলাদেশ তো ফেডারেশন না। যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো স্টেটভিত্তিক ভারসাম্য দরকার, আমাদের এখানে সেই বাস্তবতা বা প্রয়োজন নেই।

৩. সরকার নিজেই উচ্চকক্ষের সদস্য নিয়োগ দেবে। ইউরোপের কিছু দেশে, যেমন ব্রিটেনে হাউস অব লর্ডসে এমন ব্যবস্থা আছে। বিএনপি প্রস্তাবে হাউস অব লর্ডসের রেফারেন্স ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে বংশানুক্রমিক অভিজাত শ্রেণি নেই, তাহলে কেন এমন ব্যবস্থা চাই? এটা তো আবার দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির নতুন প্ল্যাটফর্ম হয়ে যাবে।

৪. বিএনপির আরেক প্রস্তাব ছিল-সংসদে যে দল যত আসন পেয়েছে, উচ্চকক্ষেও সেই অনুপাতে আসন পাবে। যেমন ১৯৯১-তে বিএনপি ১৪০ ও আওয়ামী লীগ ৯২ আসন পেয়েছিল, তাহলে উচ্চকক্ষে বিএনপি ৪৭ ও আওয়ামী লীগ ৩১ আসন পেত।

কোন কোন প্রস্তাব আলোচনায়?

দুটি মূল ধারণা আলোচনায় আছে। একটি হলো বিএনপির আসনভিত্তিক প্রস্তাব। আরেকটি হলো পিআর-ভিত্তিক উচ্চকক্ষ, যা নাগরিক কমিশন প্রস্তাব করেছে এবং অন্য বাকি প্রায় সব দল সমর্থন করেছে। পাশাপাশি, আলী রিয়াজ কমিশনের প্রস্তাব আছে-১০০ আসনের উচ্চকক্ষে ৫ জন রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।

আরও পড়ুনঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নির্বাচন নাকি আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, কোনটা?১৫ নভেম্বর ২০২৪কোনটাকে কী ভালো বলতে পারি?

মূল উদ্দেশ্য যদি হয়-সংসদে ভালো মানুষদের আনা, তাহলে দুটি ব্যবস্থাই চলতে পারে (বা ব্যর্থও হতে পারে)। তবে পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষ আরও কিছু বড় সুবিধা দিতে পারে। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোটের হার এবং আসনের মধ্যে অনেক ফারাক। ২০০৮-এ বিএনপি তাদের সবচেয়ে খারাপ পরাজয় দেখে, অথচ ৩২.৫ %-ভোট পায়, আর এর থেকে কম ভোটে তারা ১৯৯১ এ সরকার গঠন করে। তখন উচ্চকক্ষে পিআর থাকলে বিএনপি আরও ক্ষমতা নিয়ে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারত।

পিআর উচ্চকক্ষ ভোটের অনুপাত অনুযায়ী জনমত প্রতিফলন করতে পারে, যা সংসদের আলোচনাকে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করতে সাহায্য করবে।

উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কতটুকু?

নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাব-উচ্চকক্ষ কোনো আইন প্রণয়ন শুরু করতে পারবে না, সেটা শুধু নিম্নকক্ষ করবে। তবে সংবিধানের ৮১ ধারার অর্থ বিল বাদে অন্য যেকোনো আইনে মতামত দিতে পারবে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে-দুই কক্ষের অনুমোদন লাগবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ-৪০% ভোট পেলেও দল দু-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে সংবিধান পাল্টে ফেলা সম্ভব, এটা ঠেকাতে পিআর উচ্চকক্ষ দরকার।

এই উচ্চ কক্ষের মূল দায়িত্ব নিম্নকক্ষের সঙ্গে একটি তদারকিমূলক সম্পর্ক তৈরি করা।

উচ্চকক্ষ কোনো বিলের বিষয়ে নিম্নকক্ষের সঙ্গে একমত না হলে সেই বিল আবার নিম্নকক্ষে ফিরে যাবে এবং সেখানে তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি এবং যুদ্ধ ঘোষণা-সংক্রান্ত বিলে নিম্ন কক্ষের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকবে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত দায়িত্ব পালন করবে:

ক. সংবিধানিক ও জবাবদিহি নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা

খ. জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকাশ্য শুনানির আয়োজন

গ. নির্বাহী সিদ্ধান্তসমূহের পর্যালোচনা।

এ ছাড়াও যদি রিয়াজ কমিশনের ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল (এনসিসি) ব্যাপারে রাজনৈতিক দলেরা একমত না হয় তাহলে উচ্চ কক্ষের দায়িত্ব আর ও বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাবনা আছে। সাংবিধানিক সংস্থা (যেমন, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, কন্ট্রোলার ও মহা হিসাব নিরীক্ষক দপ্তর) এবং জবাবদিহিমূলক অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (যেমন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন, তথ্য কমিশন, এবং নতুন সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান-যেমন স্থানীয় সরকার কমিশন, পুলিশ কমিশন, জন প্রশাসন কমিশন, শ্রম কমিশন, নারী কমিশন, ন্যায়পালের কার্যালয়, স্বাধীন সংস্কার বাস্তবায়ন কমিশন) এর নিয়োগসমূহ নির্বাহী বিভাগের মনোনয়নের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।

সব জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান উচ্চকক্ষের স্থায়ী কমিটির কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। উচ্চকক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সাংবিধানিক সংস্থা এবং স্বাধীন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।

উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ বিচারিক নিয়োগ কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে এবং উচ্চকক্ষের স্থায়ী কমিটি শুধুমাত্র তাদের মনোনয়ন যাচাই করতে পারবে।

তবে অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রতিরক্ষা প্রধানসহ নির্বাহী বিভাগভুক্ত পদসমূহে সরকার নিয়োগ দেবে।

ভাবুন, যদি ভবিষ্যতের কোনো সরকার দুর্নীতিবাজ কাউকে কমিশনার বানাতে চায়-তখন ওপেন স্ক্রুটিনিতে একজন বিরোধী সদস্য তাঁকে আটকে দিতে পারবে।

এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পিআর উচ্চকক্ষ নির্বাচনী সময়ের সরকার গঠনে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) একটি কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।

কী কী এখনো ঠিক হয়নি?

অনেক কিছুই এখনো নির্ধারণ হয়নি।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটের কী হবে? তারা ৫-১০% ভোট পায়। এবার তো আওয়ামী লীগ প্রার্থীই দিতে নাও পারে, তখন ভোট স্বতন্ত্রদের যাবে-সেটা কীভাবে পি আর উচ্চকক্ষে যাবে?

আবার, কেমন ভোটে একটি দল উচ্চকক্ষে প্রবেশ করবে? প্রফেসর আলী রিয়াজ বলছেন-কমপক্ষে ১% পেতে হবে, অন্যথায় কোনো আসন নয়। বদিউল আলম মজুমদার সাহেব প্রস্তাব করেছেন ৩ %। কম রাখলে ছোট দল ঢুকে পড়বে, বেশি রাখলে আবার একদলীয় উচ্চকক্ষ হয়ে যাবে।

কমিটি গঠনের নিয়ম, কত আসনে আইন পাস হবে, প্রার্থী তালিকা কখন প্রকাশ হবে, প্রার্থীদের যোগ্যতা-এসব নিয়েও স্পষ্টতা দরকার।

তবে এই ব্যবস্থার আসল পরীক্ষা হবে বিরোধী সদস্যদের দিয়ে। তারা যদি ভবিষ্যতে নিম্ন কক্ষের এমপি হতে চায়, তাহলে এলাকাভিত্তিক কাজেই ডুবে যাবে-তখন পুরো ব্যবস্থাটাই ব্যর্থ হতে পারে।

পিআর উচ্চকক্ষ ম্যাজিক না। কিছুই ম্যাজিক না। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে নাগরিক সচেতনতাই প্রধান। যদি অযোগ্য লোককে দল মনোনয়ন দেয়, তাহলে পুরো উচ্চকক্ষই অর্থহীন। তারপরও আশার জায়গা আছে-বিএনপি যে উচ্চকক্ষ প্রস্তাব করেছে, যা বোঝায় যে মানসম্মত আইনপ্রণেতা দরকার সেটা তারা বুঝতে পেরেছে। পরের আলোচনাতে আশা করব তাদের বাকি প্রশ্ন গুলোর উত্তর পেয়ে এই প্রস্তাবনাতেও রাজি হবে।

সুবাইল বিন আলম জ্যোতি রাহমান নাগরিক কোয়ালিশনের সংগঠক

*মতামত লেখকদ্বয়ের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র প রস ত ব ন ম নকক ষ ব যবস থ ব এনপ র ত ব কর আম দ র র জন ত আওয় ম আসন প সরক র সদস য ক ষমত দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক

নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।

ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’

সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।

প্রতিবাদ, বিক্ষোভ

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।

‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।

পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।

দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।

সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।

সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।

কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ