ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর তেলের দামে অস্থিরতা
Published: 13th, June 2025 GMT
ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় আজ শুক্রবার ইসরায়েল হামলা চালানোয় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এতে জ্বালানির তেলের জোগানে বিঘ্ন ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। খবর বিবিসি ও রয়টার্সের।
অপরিশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচারস ৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বা ৬ দশমিক ২৯ মার্কিন ডলার বেড়ে প্রতি ব্যারেলের দাম ৭৫ দশমিক ৬৫ ডলারে উঠেছে। একপর্যায়ে দাম ৭৮ দশমিক ৫০ ডলারে পৌঁছায়, যা গত ২৭ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ। এ ছাড়া মার্কিন ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৬ দশমিক ৪৩ ডলার বা ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৭৪ দশমিক ৪৭ ডলারে উঠেছে। একপর্যায়ে দাম ৭৭ দশমিক ৬২ ডলারে উঠেছিল, যা কিনা ২১ জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মানে হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে সুপারমার্কেটে খাবারের দাম, গাড়িতে তেল ভরার খরচ, পরিবহন ব্যয়—সবকিছুর দাম বাড়বে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে একজন ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেন, ‘এখনই বলা কঠিন, তবে সম্ভবত হরমুজ প্রণালি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় সবাই উদ্বিগ্ন।’
হরমুজ প্রণালি বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথ। বিশ্বের মোট জ্বালানির প্রায় ২০ শতাংশ এই পথ দিয়েই সরবরাহ হয়। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশগুলো এই পথ দিয়েই তাদের জ্বালানি বিশ্ববাজারে পাঠায়। উত্তরে ইরান, দক্ষিণে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘেরা হরমুজ প্রণালি উপসাগরীয় অঞ্চলকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমএসটি মারকুইয়ের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশ্লেষক সল কাভোনিক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরান যদি আঞ্চলিক জ্বালানি তেল পরিকাঠামোতে পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে তেলের সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। তিনি আরও জানান, চরম পরিস্থিতিতে ইরান অবকাঠামোতে হামলা বা হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচলে বাধা দিলে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল সরবরাহ ব্যাহত করতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তেহরান। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, ইসরায়েলকে এ হামলার জন্য কঠোর শাস্তি পেতে হবে।
এদিকে ইরানে ইসরায়েলের হামলা একতরফা পদক্ষেপ হিসেবে মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বলেন, এতে ওয়াশিংটনের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তবে তেহরানকে সতর্ক করে তিনি বলেন, তারা (তেহরান) যেন মার্কিন স্বার্থ বা ব্যক্তিদের লক্ষ্য না করে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফিলিপ নভার জ্যেষ্ঠ বাজার বিশ্লেষক প্রিয়াঙ্কা সচদেবা বলেন, ইরান পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে শুধু তেলের সরবরাহ বিঘ্ন ঘটাবে না, আশপাশের অন্যান্য তেল উৎপাদকদের দেশগুলোতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল সরবর হ দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
আট কোটি টাকার প্রকল্প চালুর আগেই অচল
পদ্মা ও বড়াল নদীবেষ্টিত রাজশাহীর চারঘাট অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর অন্তত এক ফুট নামছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট এতটাই তীব্র হয়, ভ্যানগাড়িতে ট্যাঙ্ক নিয়ে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালে চারঘাট পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ গ্রহণ করে।
প্রকল্পের আওতায় ২৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন, পাঁচটি পাম্পহাউস ও ৬ লাখ ৮০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতার ওভারহেড পানির ট্যাঙ্ক নির্মাণ করা হয়। এর পর সাত বছরে চারবার প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়ানো হয়। আজও এ প্রকল্প থেকে এক ফোঁটা পানি পায়নি পৌরবাসী। উল্টো প্রকল্পের সুবিধা ভোগের আগেই যন্ত্রপাতি
অকেজো হয়ে পড়েছে। মিলেছে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ।
২০১৮ সালের ৩০ জুলাই ঘটা করে প্রকল্পকাজের উদ্বোধন করেন স্থানীয় এমপি ও তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। দরপত্র অনুযায়ী, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর। এর পর সাত বছরে চারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও কোনো স্থাপনা চালু করা যায়নি। এরই মধ্যে গত ১৩ আগস্ট প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মুক্তা কনস্ট্রাকশন।
চারঘাট পৌরসভা সূত্র জানায়, দেশের প্রথম শ্রেণির ১৯টি পৌরসভায় বিশেষ এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এডিবি এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নে তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতীকরণ প্রকল্পের (ইউজিপ-৩) আওতায় বাস্তবায়ন করা হয় প্রকল্পটি। প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয়ে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অন্তত ৪৪ হাজার মানুষ এর সুবিধা ভোগ করত।
জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পরীক্ষামূলক মাত্র এক দিন পাম্পগুলো চালু করা হয়। কিন্তু চালুর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অধিকাংশ পাইপলাইন ফেটে যায় ও বিভিন্ন পাম্প অকেজো হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দরপত্র অনুযায়ী প্রকল্পে পাঁচটি পাম্পহাউসে ২৫ হর্সপাওয়ারের পাম্প স্থাপনের কথা। কিন্তু স্থাপন করা হয়েছে ১৫ হর্সপাওয়ারের। যে ২৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে পাইপের পুরুত্ব হওয়ার কথা ৫ মিলিমিটার। কিন্তু দেওয়া হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭ মিলিমিটার পুরুত্বের পাইপ। মাটির চার ফুট নিচে পাইপগুলো স্থাপনের কথা থাকলেও মাত্র দুই ফুট নিচে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে পাম্প চালুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সব পাইপলাইন ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে। অকেজো হয়ে গেছে পাম্পও। এ ছাড়া প্রকল্পে ব্যবহৃত প্রতিটি সরঞ্জামই নিম্নমানের দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মজিবর রহমান। তিনি বলেন, পানির পাইপ ও পাম্প স্থাপনে দরপত্রের ন্যূনতম নীতিমালা মানা হয়নি। প্রকল্প চলাকালে আমাদের কাজ দেখতে দেওয়া হতো না। প্রকল্প বুঝে পাওয়ার পর দেখি পাইপ, পাম্প, পাইপ স্থাপন সবকিছুতেই অনিয়ম। এ প্রকল্প সচল করা সম্ভব নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চারঘাট উপজেলার সহসভাপতি আঞ্জুমান আরা বলেন, পানি সরবরাহের নামে প্রকল্পের টাকা লুটপাট করা হয়েছে। স্থাপনা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভেতরে সব নিম্নমানের অকেজো সরঞ্জাম। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদার, প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি টাকা ভাগাভাগি করেছে বলে শুনেছি।
পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, আমি দুই মাস আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী কাগজ-কলমে আমি থাকলেও বাস্তবে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয়নি। তার পরও আমার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন পানি সরবরাহ না হওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুক্তা কনস্ট্রাকশনের পক্ষে কাজটি করছেন বাঘা উপজেলা পৌর যুবলীগের সম্পাদক শাহিনুর রহমান পিন্টু। তিনি বর্তমানে পলাতক। জানা গেছে, পিন্টু ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ঘনিষ্ঠজন। ফলে আরও অনেক ঠিকাদারকে টপকে মুক্তা কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে পিন্টুকে কাজ দেওয়া হয়।
চারঘাট পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, ওই প্রকল্পের সব সরঞ্জাম ব্যবহারের আগেই অকেজো হয়ে গেছে। কোনোভাবেই সেই পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি সমাধানে গত ২৪ এপ্রিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আবদুল বারেক বলেন, চলমান প্রকল্পে পানি সরবরাহ সংক্রান্ত কোনো কম্পোনেন্ট ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই। ফলে প্রকল্পের আওতায় চারঘাট পৌরসভার ওভারহেড ট্যাঙ্কসহ পানি সরবরাহ লাইন সঞ্চালনের কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব নয়।