কী বলা যেতে পারে এটাকে? উইন উইন পরিস্থিতি? দুই পক্ষেরই কিছুটা ছাড়? না আগের ভুলের সংশোধন?

বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চলতি বছরের ডিসেম্বের মধ্যে নির্বাচন করার দাবি জানিয়ে আসছিল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বশেষ বৈঠকেও দু–একটি ছাড়া সবাই ডিসেম্বর–জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিল।

কিন্তু ঈদুল আজহার আগে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বললেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন নির্বাচন হবে।

নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যেও বিভক্তি ছিল বলে জানা যায়। এক পক্ষ চাইছিল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করাই শ্রেয় হবে। অন্য পক্ষের অভিমত ছিল, রাজনৈতিক দলের দাবি যা–ই হোক না কেন, এপ্রিলের আগে নির্বাচন করা ঠিক হবে না। সে সময়ে প্রধান উপদেষ্টা দ্বিতীয় পক্ষের কথা মেনে নিলেন।

কিন্তু সেই ঘোষণা সমস্যার সমাধান না করে আরও জটিল করে তুলল। বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে ডিসেম্বর–এপ্রিলের দ্বৈরথ চলতে থাকে। এ অবস্থায় সরকার একটি সম্মানজনক আপসরফা চেয়েছিল, যার প্রতিফলন ঘটল লন্ডন বৈঠকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এপ্রিলের ঘোষণায় যারা সম্মতি জানিয়েছিল, তারা কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে একমত হবেন কী না?

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।’

বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার আগ্রহেই এই বৈঠক হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, তারেক রহমানই এখন দল চালাচ্ছেন, রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললেই ভালো হয়।

বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকার—উভয়ের শুভানুধ্যায়ীরাও চেয়েছিলেন বৈঠকটি হোক। বৈঠকের আগের দিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিক, তিনি যেকোনো সময় বাংলাদেশে আসতে পারেন। গত ১০ মাসে তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে কোনো উপদেস্টা প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

সবচেয়ে ভালো হতো যদি লন্ডন বৈঠক ছাড়াই জট খোলা যেত। কিন্তু সেটা যায়নি। বাংলাদেশে স্বাভাবিক ও সহজ পথে কিছু হয় না। অনেকেই প্রশ্ন করবেন, যে সিদ্ধান্তের জন্য সরকারপ্রধানকে লন্ডন যেতে হলো, সেই সিদ্ধান্ত ঢাকায় নেওয়া গেল না কেন? যৌক্তিক প্রশ্ন।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) বৈঠকটি শুরু হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটা) বৈঠক শেষ হয়। বৈঠক শেষে তারেক রহমান ডরচেস্টার হোটেল ত্যাগ করেন।

বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টাই কথা শুরু করলেন আবহাওয়ার সুসংবাদ দিয়ে। তিনি বললেন, ‘আজ আবহাওয়াটা খুব ভালো।’ তারেক রহমান তাঁকে সমর্থন করলেন।
তাঁদের কথোপকথন ছিল অনেকটা এ রকম:
ইউনূস: খুব ভালো লাগছে।
তারেক: আমারও ভীষণ ভালো লাগছে। আই ফিল অনার্ড।
ইউনূস: আসেন। চলুন বসি।
তারেক: আপনার শরীর কেমন? ভালো আছেন?
ইউনূস: এই যাচ্ছে। টেনে টেনে যাচ্ছে।
তারেক: আম্মা সালাম জানিয়েছেন আপনাকে।
ইউনূস: অসংখ্য ধন্যবাদ। ওয়ালাইকুমুস সালাম। ওনাকেও আমার সালাম দেবেন।

নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে মতৈক্যের বিষয়টিই সরকার তথা প্রধান উপদেষ্টার বড় সাফল্য বলে মনে করি।

তবে এ ধরনের বৈঠক হয় সাধারণত দুটি পক্ষের মধ্যে। এখানে তো অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো পক্ষ হওয়ার কথা ছিল না। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল ও সংগঠনের সম্মতি ও সমর্থন নিয়েই মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারা সব সময় নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছে বলে মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে এবারও কি বিএনপির চাপের কাছে সরকার নতিস্বীকার করল কি না সেই প্রশ্নও উঠবে।

সরকারপ্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের যৌথ বিবৃতির পর নির্বাচনের দিণক্ষণসংক্রান্ত সমস্যা হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশটি তৈরি করা সহজ হবে না। সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, কোথাও সংঘাত সংঘর্ষ হলে সেনা সদস্যদেরই হস্তক্ষেপ করতে হয়।

সরকারের তিনটি অঙ্গীকার ছিল। সংস্কার, জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যার বিচার ও নির্বাচন। সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিশনগুলো ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আর সব কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব বা সুপারিশ বাস্তবায়নের সঙ্গে সংবিধান বা নির্বাচনেরও সম্পর্ক নেই। সরকার নির্বাহী আদেশে অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারে। কিন্তু দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সরকার কোনোটিতে হাত দেয়নি।

বিচারপ্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে বলে সরকারের উপদেষ্টারা জানিয়েছেন। এই বিচার নিয়েও কেউ আপত্তি করেননি। তবে বিচারটি কবে শেষ হবে, সেটা নির্ভর করে আদালতের ওপর। এখানে সরকার বলে দিতে পারে না, অমুক তারিখে অমুক মামলার কাজ শেষ করতে হবে।

তৃতীয়টি হলো নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রে উত্তরণের কোনো বিকল্প উপায় আছে বলে আমাদের জানা নেই। নির্বাচন দুই মাস পর হলে সব সংস্কার বা বিচারকাজ শেষ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এপ্রিলে নির্বাচন করার সমস্যাগুলো প্রায় সব দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সরকারপ্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের যৌথ বিবৃতির পর নির্বাচনের দিণক্ষণসংক্রান্ত সমস্যা হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশটি তৈরি করা সহজ হবে না। সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, কোথাও সংঘাত সংঘর্ষ হলে সেনা সদস্যদেরই হস্তক্ষেপ করতে হয়।

বৃহস্পতিবার যে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় পাতাবুনিয়া বটতলা বাজারে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে অবরুদ্ধ হন, তাঁকে উদ্ধার করতে আসেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বকুলবাড়ীয়া ইউনিয়নের পাতাবুনিয়া এলাকায় আয়োজিত এক স্মরণসভায় অংশ নিয়ে ফেরার পথে অবরুদ্ধ হন নুরুল হক। এ সময় পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুনের অনুসারীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁর পথ রোধ করেন, দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন।

এ বিষয়ে বিএনপি নেতা হাসান মামুন প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল হক নূর এলাকায় উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। কেউ উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেই তাঁকে মারধর কিংবা অবরুদ্ধ করতে হবে, এটা কোন আইনে লেখা আছে। তাঁরা কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিলেন?

বিএনপি বেশ কয়েকটি আসনে মিত্র দলের নেতাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য স্থানীয় নেতাদের কাছে চিঠি দিয়েছিল। অন্যান্য আসনেও কমবেশি একই রকম সমস্যা আছে।

নির্বাচনের দিনতারিখ ঠিক হওয়ার পর বল পুরোপুরি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে চলে যাবে। তখনো যদি তারা জবরদস্তি পরিহার করতে না পারে, তাহলে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন দূরের কথা, মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন করাও দুরূহ হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত র ক রহম ন উপদ ষ ট র সরক র র ব এনপ র র আগ র সদস য সমস য ইউন স প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকায় অটোমোবাইল ও কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে শনিবার

ঢাকায় দুই দিনব্যাপী অটোমোবাইল ও কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে আগামী শনিবার। এতে অটোমোবাইল, কৃষি যন্ত্রপাতিসহ হালকা প্রকৌশল খাতের ২৬টি স্টল থাকবে। পাশাপাশি শিল্পের সহায়ক প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকবে আরও ১২টি। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।

বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সহযোগিতায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করছে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)। ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় এডিসন প্রাইম ভবনের ছাদে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। এই ভবনেই বিসিআইয়ের কার্যালয় অবস্থিত।

আজ বৃহস্পতিবার বিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দুই দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী নিয়ে বিস্তারিত জানান চেম্বারটির সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী। আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি আলিমুল আহসান চৌধুরী, বিসিআইয়ের পরিচালক মো. শাহেদ আলম, এস এম শাহ আলম, জিয়া হায়দার প্রমুখ।

বিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, হালকা প্রকৌশল খাতে বাংলাদেশে বর্তমানে ছোটবড় প্রায় ৫০ হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই খাতে কাজ করেন ১০ লাখ মানুষ। হালকা প্রকৌশল খাতে স্থানীয় বাজার ১২ বিলিয়ন ডলারের হলেও দেশীয় উৎপাদকেরা অর্ধেক পূরণ করতে পারছেন। তা ছাড়া হালকা প্রকৌশল খাতের বৈশ্বিক বাজারের আকার প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক খাত আর বেশি মূল্য সংযোজন করতে পারবে না। ফলে আমাদের অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে আমাদের অন্য খাতে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে হালকা প্রকৌশল খাত পারে বড় সম্ভাবনার।

অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি আলিমুল আহসান চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে। কৃষকের বয়স বাড়ছে, তার কারণ তরুণেরা খুব কম কৃষিকাজে আসছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশের কম কৃষিকাজে নিয়োজিত। ১০ শতাংশ মানুষ বাকি ৯০ শতাংশের জন্য খাদ্য জোগান দিচ্ছে। সে কারণে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশেও কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। তবে বড় অংশই আমদানি করতে হচ্ছে।

আলিমুল আহসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে ১২০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার আছে। তার মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে মাত্র ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ। নীতিসহায়তা পেলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ