‘লন্ডন বৈঠকে’ ক্ষুব্ধ জামায়াত বয়কট করল ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ
Published: 17th, June 2025 GMT
শুধুমাত্র বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণের প্রতিবাদে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বয়কট করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
সংবিধান সংস্কারে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঈদের ছুটির পর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু হয়। তিন দিনব্যাপী এ সংলাপে ৩০ রাজনৈতিক দল ও জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি, এনসিপিসহ অন্যন্য দল এলেও আসেনি জামায়াত।
দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এতদিন সংলাপে প্রতিনিধিত্ব করা ড.
আগামীকাল বুধবার এবং পরশু বৃহস্পতিবারও সংলাপ চলবে। জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে আজকের সংলাপ বয়কট করা হয়েছে। কাল থেকে আলোচনায় ফিরবে জামায়াত। তবে অতীতে সংলাপে প্রতিনিধিত্ব করা একজন নেতা সমকালকে বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশন নিশ্চয় আজকের সংলাপের পর জানতে চাইবে, জামায়াত কেন যোগ দেয়নি। তখন জামায়াত দলীয় অবস্থান তুলে ধরবে। ঐকমত্য কমিশনের জবাব সন্তোষজনক হলে জামায়াত সংলাপে ফিরবে।’
জানা যায়, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে- সরকারের এ অবস্থানকে জামায়াত সমর্থন করলেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপে রেখেছিল। এপ্রিলের প্রথমার্থে নির্বাচনের ঘোষণাও দলটি প্রত্যাখান করেছিল।
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি সাপেক্ষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।
পরে দলের নির্বাহী পরিষদের বৈঠক থেকে এ যৌথ বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে ৫ আগস্টের পর বিএনপির নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় থাকা জামায়াত। দলটি বলে, যৌথ বিবৃতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে আমরা মনে করি। এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে।
জামায়াত ১৪ জুন বিবৃতিতে বলেছিল, সরকার প্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু একটি দলের সঙ্গে আলাপে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। জামায়াত আশা করে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবেন। সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করবে।
লন্ডন বৈঠকের বিষয়ে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সমকালকে বলেছিলেন, জামায়াতই প্রথম বলেছে, রমজানের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। তাই নির্বাচনের যে নতুন সময়সীমা বলা হচ্ছে, এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সরকার যেভাবে শুধু বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, তা অগ্রহণযোগ্য। বিএনপিকে তোয়াজ করতে লল্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে– ঠিক আছে। কিন্তু আলোচনার পর ঢাকায় সর্বদলীয় বৈঠক করে রমজানের আগে ভোটের ঘোষণা দিলে সব দল এবং সরকারের জন্য ভালো হতো। লন্ডন বৈঠকের পর ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের কাছে বার্তা গেল– বিএনপিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে ইউনূস সরকার। এ বার্তার কারণে অন্য দলগুলো নির্বাচনের মাঠে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিবন্ধকতায় পড়বে। এক-এগারো সরকারের তথাকথিত ‘সেফ এক্সিট’ পরিকল্পনার কারণেই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ অস্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। এবারও তা হবে।
জামায়াত নেতারা সমকালকে বলেন, যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে– সরকার এবং বিএনপি সমশক্তি। জামায়াতসহ অন্যরা গৌণ। এর প্রতিবাদেই জামায়াত সংলাপে যায়নি। যদি সরকার সবদলের প্রতি সমান আচরণ না করে, তবে জামায়াত সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে কী তা ভাববে। জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ সমকালকে বলেন, ‘আজ আমরা সংলাপে যাচ্ছি না।’
৩ জুন মুলতবির পর আজ শুরু হওয়া সংলাপে ৭০ অনুচ্ছেদ, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচর পদ্ধতি এবং কোন কোন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়া হবে; এ বিষয়ে আলোচনা চলে। সব ইস্যুতেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মতবিরোধ রয়েছে।
জামায়াতের অবস্থান ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের কাছাকাছি। মৌলিক সংস্কারেও দলটির একই অবস্থান। সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত একজন জামায়াত নেতা সমবালকে বলেছেন, ‘বিএনপি সংস্কারের প্রতি পদে পদে বাধা দিচ্ছে। জামায়াত যথাসম্ভব ছাড় দিয়ে নিজের অবস্থান বদল করেছে ঐকমত্যের স্বার্থে। তারপরও সরকার বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে, একপ্রকার স্বীকার করে নিয়েছে বিএনপি চাইলে সংস্কার হবে। নয়তো হবে না। বিএনপি যেসব বিষয়ে রাজি হবে, শুধু সেগুলোতেই ঐকমত্য হয়েছে ধরে জুলাই সনদ হবে। তাই সংস্কারের সংলাপ এখন অর্থহীন।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ম য় ত ইসল ম ঐকমত য ক ম শ গ রহণয গ য র অবস থ ন ব এন প র সময়স ম রহম ন সরক র ব এনপ সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
বিশেষজ্ঞদের থেকে পাওয়া মতামত অনুযায়ী জুলাই সনদের সংবিধান–সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো কার্যকর করতে সরকারের কাছে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারি করার সুপারিশ উপস্থাপন করতে পারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বুধবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায় হিসেবে কমিশন সরকারের কাছে যেসব সুপারিশ পেশ করবে, তার মধ্যে এটি হতে পারে অন্যতম। তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’-এর সংবিধান সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত পরামর্শ বা অভিমত পাওয়া গেছে। তাঁদের আগে প্রস্তাবিত দুটি বিকল্প, ‘গণভোট’ ও ‘সংবিধান আদেশ’-এ পর্যায়ে সমন্বিত করে তাঁরা একটি চূড়ান্ত অভিমত দিয়েছেন। এতে তাঁরা বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ দফা অনুসরণ করে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদের সংবিধান–সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো কার্যকর করা যায় এবং উক্ত ‘সংবিধান আদেশ’ একটি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করতে পারে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রস্তাবিত গণভোট আয়োজনের বিষয়টি বর্ণিত সংবিধান আদেশে উল্লিখিত থাকবে এবং গণভোট আয়োজিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শটি রাজনৈতিক দলগুলোকে অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, পাশাপাশি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে পরামর্শ চাওয়ার বিষয়েও মতামত দিয়েছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তবে ভিন্নমতও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এর পাশাপাশি আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে একধরনের অনানুষ্ঠানিক অনুরোধ পেয়েছি যে তাঁরা তাঁদের নিজেদের মধ্যে আলাপ–আলোচনা করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আসার চেষ্টা করছেন। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছুটা সময় দিতে চাই, যেটা তারা অনুরোধ করেছে, পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে যেন বিকল্পগুলো কমিয়ে আনতে পারে। এ বিবেচনায় আমরা আজকের আলোচনা মুলতবি করেছি।’
আলোচনার মধ্য দিয়ে সরকারকে একাধিক বিকল্প সুপারিশ করতে চান জানিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ছয়টি ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে একটি মোট সাতটি সুপারিশ আছে, যেটা আমরা কমিয়ে আনতে চাচ্ছি। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা যদি কমিয়ে আনা যায়, তবে সেটা বাস্তবায়ন করতে সরকারের জন্য সহজতর হবে।’
সেই বিবেচনা থেকে বুধবারের আলোচনা মুলতবি করা হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। আমরা আশা করছি, আগামী মাসের শুরুতেই আমরা আবার মিলিত হব।’
কমিশনের প্রধান ও প্রধান উপদেষ্টা এ উল্লিখিত সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের জন্য নিউইয়র্ক যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এ আলোচনাটা অব্যাহত রেখে এমন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছাতে চাই, যেন যখন তিনি ফিরে আসবেন, তখন আমরা যেন তাঁর কাছে সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারি। যদি আমরা সবাই একমত হতে পারি বা কমিশন এ সুপারিশগুলো যখন উপস্থাপন করার অবস্থায় উপনীত হবে, তখন আমরা তা উপস্থাপন করব।’
ব্রিফিংকালে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এদিনের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।