একটি বিয়ে নিয়ে দুই গ্রামবাসীর বিবাদে ঘটে সংঘর্ষের ঘটনা। হয় দুটি মামলা। এর পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হবিবপুর গ্রাম। গ্রামের দুটি বাজারে দোকানপাট বন্ধ রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামবাসী। আতঙ্কে দিন কাটছে গ্রামের নারী ও শিশুদের।

জানা গেছে, পূর্বধলার নারান্দিয়া ইউনিয়নের হবিবপুর গ্রামের বশির মিয়ার ছেলে আরিফের সঙ্গে পাইলাটী গ্রামের জুয়েল মিয়ার মেয়ের বিয়ে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে কিছুদিন ধরে বিরোধ চলছিল। প্রায় তিন মাস আগে জুয়েলের মেয়েকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেয় বশিরের ছেলে আরিফ। মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান জুয়েল। এ নিয়ে এলাকায় কয়েক দফা সালিশ বৈঠকও হয়। পরে গত ৯ জুন মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেন জুয়েল। এতে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। এরই জেরে গত ১২ জুন রাতে জুয়েলের বাড়ির পাশে রাস্তায় দুই পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে জুয়েলের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হবিবপুরের দিকে যেতে থাকে। 

অপরদিকে, হবিবপুর গ্রামবাসী জড়ো হয়ে তাদের প্রতিহত কারার প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে শ্যামগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের কয়েকজন পুলিশ রাত ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এরই মধ্যে জুয়েলের গোয়াল ঘরে আগুন দেয় দুর্বত্তরা। সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য আনসার আলী, হুমায়ুন কবীর, উত্তম কুমার ভাট, হুমায়ুন কবিরসহ উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। পরে পূর্বধলা থানা পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরই মধ্যে জুয়েলের বাড়ি, নারান্দিয়া ইউপি সদস্য মশিউর রহমান সেলিম, বশিরের বাড়িসহ হবিবপুর গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ঘরের দরাজা-জানালা, ফ্রিজ, অলমিরা, থালা-বাসনসহ আসবাব ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় শ্যামগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই উত্তম কুমার ভাট বাদী হয়ে ইউপি সদস্য মশিউর রহমান সেলিম, হবিবপুর গ্রামের আরিফ, ইসলাম উদ্দিন, হাসিম উদ্দিন, নওশাদ, আশিক, রুবেল, সুমনসহ ৩৮ জনের নামে মামলা করেন। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় ৮০-৯০ জনকে। গত ১৩ জুন পূর্বধলা থানায় মামলাটি করা হয়।

একই দিন জুয়েল মিয়া বাদী হয়ে আরিফ, ইসলাম উদ্দিন, বশির মিয়া, ইউপি সদস্য মশিউর রহমান সেলিমসহ ১৭ জনের নামে একটি মামলা করেন। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় ১০-১২ জনকে। পুলিশ মামলার আসামি রহিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। এর পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে গ্রামের পুরুষ লোকজন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। মামলার পর থেকে হবিবপুর গ্রামের দুটি বাজারে বিভিন্ন পণ্যের অর্ধশত দোকান বন্ধ রয়েছে। এতে দোকানের মালপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গ্রামের একাধিক নারী জানান, মারামারি হয়েছে ঠিকই। এতে পুলিশসহ দুই পক্ষের লোকই আহত হয়েছে। তাই বলে সবাইতো মারামারি করেনি। এখন পুলিশ ও জুয়েল মিয়ার লোকজন রাতের বেলা বাড়িঘরে হানা দেয়। শান্তিতে ঘুমাতে পারে না গ্রামবাসী। তাদের দাবি, যারা দোষ করেছে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করুক। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি বন্ধ হোক।

গতকাল মঙ্গলবার হবিবপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে– বশির মিয়া, ইউপি সদস্য মশিউর রহমান সেলিমসহ বেশ কয়েকটি বাড়ির বসতঘরের আসবাব ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিছানাপত্র। গ্রামের বেশকিছু দোকান বন্ধ। গ্রামের নারী-শিশুসহ সবার মুখে আতঙ্কের ছাপ।

হবিবপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলাম, আবদুল হেলিম, নাজিম উদ্দিন, সুফিয়া বেগম, রাশিদা আক্তার খাতুনসহ অনেকেই জানান, মারামারি হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন রাতে পুলিশ ও জুয়েল মিয়ার লোকজন এসে নারীদের ঘুম থেকে ডেকে তোলে। ভয়ে গ্রামে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। তারা খুব কষ্টের মধ্যে আছেন।

রাশিদা আক্তার বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পুরুষ লোকজন পালিয়ে বেড়াইতাছে। বাজার করার মতো কেউ নাই। ঘরের রান্না খাওয়াও ঠিকমতো করতে পারছি না। রাতের বেলায় হঠাৎ পুলিশ আইসা ডাকাডাকি করে, ভয় দেখায়।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পাইকপাড়া গ্রামের জুয়েল মিয়ার সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, তাঁর মেয়েকে বিয়ে করার জন্য আরিফ ও তাঁর লোকজন অনেক চেষ্টা করেছে। বিয়ে না দেওয়ায় তারা হামলা ও মারধর করেছে। পুশিকেও মারধর করেছে। এমনকি তাঁর বৃদ্ধ বাবার ওপরও হামলা করেছে। বাড়িতে গোয়াল ঘরে আগুন দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এসব কারণে মামলা করে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। এটা কি আমরা অপরাধ হয়েছে? যারা অপরাধ করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক– এটাই আমার চাওয়া। আমরা তাদের ওপর হামলা করিনি।’

পূর্বধলা থানার ওসি মোহাম্মদ নূরুল আলম জানান, দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ থামাতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে কয়েকজন পুলিশ আহত হয়। মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হয়। অহেতুক নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না। জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ র মব স প র বধল র ল কজন স ঘর ষ আতঙ ক

এছাড়াও পড়ুন:

রাশিয়ার কাছে ট্রাম্পের পরমাণু সাবমেরিন মোতায়েনের ঝুঁকি আসলে কতটা

সাধারণ সময়ে এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক, যুগ পরিবর্তনকারী ও ভয়জাগানিয়া বলে মনে হতো। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধকালেও কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে রাশিয়ার উপকূলের দিকে পরমাণু সাবমেরিন পাঠানোর এমন নির্দেশ দেননি।

এই ধরনের পরমাণু উত্তেজনার খেলায় আগে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নেতা জড়াননি।

সত্যি বলতে, ১৯৬২ সালে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূল থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়ে বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ১৩ দিন ধরে পুরো পৃথিবী ভয় আর অনিশ্চয়তায় কাঁপছিল।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাবিলাসী শাসনব্যবস্থার কারণে এবার তেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। এটি মোটেই কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের দ্বিতীয় সংস্করণ নয়, তা খুব স্পষ্ট।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাবিলাসী শাসনব্যবস্থার কারণে এবার তেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। এটি মোটেই কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের দ্বিতীয় সংস্করণ নয়, তা খুব স্পষ্ট।

তবে তার অর্থ এই নয় যে ট্রাম্প যা করলেন, সেটি কোনো ঝুঁকিমুক্ত সিদ্ধান্ত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অবস্থান এমনভাবে বদলেছেন, যেটা তাঁর পূর্বসূরিদের কেউই সাহস করেননি। এমনকি অনেকটা হালকাভাবেই তিনি পারমাণবিক উত্তেজনার সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখেছেন।

এখন যদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পাল্টা জবাব দিতে চান, তাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

ট্রাম্প হয়তো মনে করছেন, পুতিন তেমন কিছু করবেন না। আসলে ট্রাম্প সম্ভবত এবার রাশিয়ার কৌশলই ব্যবহার করছেন।

পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অবস্থান বদলানোকে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার সময় তিনি প্রায়ই কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেন। এই কালিনিনগ্রাদ এলাকাটি ন্যাটোর সদস্যদেশ পোল্যান্ডের সীমান্তে অবস্থিত।

২০২৩ সালে পুতিন বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেন। স্নায়ুযুদ্ধের পর এই প্রথম রাশিয়া নিজেদের দেশের বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করল। তিনি ইউক্রেনে বারবার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

আর গতকাল শুক্রবার পুতিন ঘোষণা দিলেন, রাশিয়া ওরেশনিক নামে একধরনের হাইপারসনিক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি শুরু করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ২০২৫ সালের মধ্যেই বেলারুশে মোতায়েন করা হবে। তিনি দাবি করেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানও ইতিমধ্যে বাছাই করে রাখা হয়েছে।

গত কয়েক দিনে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পের নানা হুমকি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। মেদভেদেভ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করছেন। তিনি এর আগেও পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন।

পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অবস্থান বদলানোকে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার সময় তিনি প্রায়ই কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেন।

কিছুদিন আগেও পুতিনের ভক্ত হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার হুমকিকে পাত্তা দিচ্ছেন এবং তার মোকাবিলায় পাল্টা চাল দিচ্ছেন।

অন্যভাবে বললে, রাশিয়া যেটাকে ‘কেবল হুমকি’ হিসেবে দিচ্ছে, ট্রাম্প সেটাকে ‘আসল হুমকি’ হিসেবে নিচ্ছেন। এটা অনেকটাই উল্টো পরিস্থিতি। কারণ, ট্রাম্পের সমর্থকেরা সাধারণত বলে থাকেন, তাঁর কথাকে সরাসরি না নিয়ে রূপকভাবে বুঝতে হবে।

মেদভেদেভকে উদ্দেশ করে ট্রাম্প তাঁর নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লেখেন, ‘শব্দের গুরুত্ব অনেক। আর সেগুলো অনেক সময় এমন পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যা কেউ চায় না।’

তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হুমকিকে অনেকটাই নাটকীয় ‘পারফরম্যান্স’ বলা যায়। হ্যাঁ, এটি উচ্চ ঝুঁকির, দায়িত্বহীন। তবে শেষমেশ এটি একধরনের ‘লোক দেখানো কার্যকলাপ’।

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পেছনে অন্য উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আগামী কয়েক দিনে ট্রাম্পকে ব্যাখ্যা করতে হবে, ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। দিন দিন এটির গুরুত্ব আরও বাড়ছে। কারণ, গতকাল শুক্রবার কিয়েভে রাশিয়ার এক হামলায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন।

এ ছাড়া রাশিয়ার তেল-গ্যাস কেনা দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর দ্বিতীয় স্তরের নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিকল্পনাও ট্রাম্পের জন্য কূটনৈতিক চাপে পরিণত হয়েছে।

এ সবকিছুর মাঝখানে ট্রাম্প যদি পরবর্তী সময়ে তাঁর হুমকি থেকে সরে দাঁড়াতে চান, তাহলে তিনি দেখাতে পারবেন যে সাবমেরিন মোতায়েনের মাধ্যমে তিনি রাশিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তিনি এমন একটি কৌশল নিয়েছেন, যার ঝুঁকি হয়তো বেশি, কিন্তু অর্থনৈতিক খরচ তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে যেসব মিত্রদেশকে তিনি অন্য ক্ষেত্রে পাশে পেতে চান, তাদের ওপর শুল্ক আরোপের চেয়ে এই মূল্য তুলনামূলক কম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ